বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে

বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদের দিকে যাত্রায় অনেকে যখন পশ্চিমাদের পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছেন, অথবা তারা এখনো কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ার সমালোচনা করছেন, আমার বাংলাদেশী বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আপনাদের সামনের সমূহ বিপদ পশ্চিমাদের পদক্ষেপ নেওয়া বা না নেওয়ার তুলনায় অনেক অনেক বেশি। চলুন দেখে নেওয়া যাক ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখের পর আপনাদের সামনের সম্ভাব্য বিপদ কী কী:

বিপদের চিত্র

১। গত এক দশক ধরে, শেখ হাসিনা ও তার ভারতীয় প্রভূগণ বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া রাষ্ট্রের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানের উপর তাদের নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি তারা করেছে এসব প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ও স্বাধীন কর্মকর্তাদের ধীরে ধীরে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের পছন্দমাফিক কর্মকর্তাদের পদায়ন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেদের লোকজন নিয়োগ করার মাধ্যমে। বিডিআর বিদ্রোহে সশস্ত্র বাহিনীর আধিপত্যবাদ-বিরোধী এক বিরাট অংশকে পরিকল্পিত ও নৃসংশভাবে খুন করার পর দুর্বল হয়ে পড়া সামরিক বাহিনীকে কব্জায় নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। কিন্তু সামরিক বাহিনীর মধ্যম পর্যায়ের বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা অদ্যাবদি শেখ ডায়নাস্টি ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের কাছে মাথানত না করায় সামরিক বাহিনীকে এখনও পুরোপুরি কব্জায় নেওয়া যায়নি। ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখের তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ ডায়নাস্টি ও ভারতীয় আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী আগামী ৫ বছরে তাদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করবে এবং সামরিক বাহিনীতে তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। এটি তারা করবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেদের দলীয় ও পছন্দনীয় লোকবল নিয়োগ দিয়ে এবং স্বাধীনচেতা কর্মকর্তাদের একে-একে বাহিনী থেকে বিদায়ের মাধ্যমে। লিখে রাখেন, আগামী ৫ বছর হবে শেখ ডায়নাস্টি ও ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠানের উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাল।

রাজনৈতিক পরিণতি

২। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, শেখ হাসিনা ও ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠানের উপর এই নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিণতি কী হতে পারে। এর উত্তর হচ্ছে আপনারা যা ভয় পাচ্ছেন, সেটি। একটি একদলীয়, নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে অনির্দিষ্টকাল শেখ হাসিনা/ তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে শেখ পরিবার সিরিয়ার বাশার আল আসাদ, জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে, উত্তর কোরিয়ার কিম জং, কিংবা চিলির পিনোশের মতোর শাসন গেঁড়ে বসবে যেখানে শেখ হাসিনা মারা যাওয়ার পর তার মেয়ে বা ছেলে উত্তরাধিকার হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করবে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদীরা এই নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে। শেখ পরিবার পৃথিবীর অন্যান্য স্বৈরশাসকের মতোই নিজ দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষের দ্বারা ঘৃণিত হবে, কিন্তু ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও সামরিক বাহিনীর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সংঘাত ও প্রাণহানির বিনিময়েও এই পারিবারিক শাসন টিকিয়ে রাখবে।

শেখ পরিবারের শেষ গন্তব্য কোথায়?

৩। তারপর কী হবে? আমার অনুমান, জাগতিক নিয়মে একটা পর্যায়ে শেখ পরিবারের ক্ষমতার কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হবে। কিন্তু পৃথিবীর সব নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকদের মতোই বাংলাদেশীয় স্বৈরতন্ত্রও একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সহায়তায় নিজে-নিজে টিকে থাকায় পারঙ্গম হয়ে উঠবে। এ ধরনের শাসনে সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি অংশ ক্ষমতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠায় শাসক ধীরে-ধীরে নিজে ওই ক্ষমতা বলয়ের হাতে নিজেই বন্দী হয়ে পড়ে। দিনশেষে শেখ পরিবারের পরিণতিও তাই হবে। অর্থাৎ তারা হারুন-বিপ্লব গংদের ক্ষমতা বলয়ের হাতে বন্দী হয়ে পড়বে এবং জনগণের যেকোনো সংগঠিত প্রতিরোধকে নৃশংসভাবে দমনে সামরিক বাহিনীর একটি অংশকে নিয়োজিত করবে। একাজে তাদের পুরোপুরি সহায়তা করবে ভারতীয় আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী যারা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের সমস্ত রন্দ্রে-রন্দ্রে নিজেদের অনুপ্রবেশ ও ছদ্ম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতির এক কঠিন সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেবল নামে টিকে থাকবে কিন্তু এর সার্বভৌমত্ব নিয়ন্ত্রণ করবে ভারতীয় আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী। তারা সরাসরি সৈন্য না পাঠিয়েও এদেশে তাদের তাবেদার শেখ পরিবারের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ বজায় করবে।

বাংলাদেশে ভারতীয় কর্তৃত্ববাদের ফলাফল কি হবে?

ফলাফল চিন্তা করলে আপনি আঁতকে উঠবেন। দেশে ভারতের ন্যূনতম সমালোচনাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হবে এবং মানুষ ভারতের সমালোচনা করতে ভয় পাবে। ভারত-বিরোধী কোন স্বাধীনচেতা মানুষ বাংলাদেশে বড় পদে আসীন হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। দেশের ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ ভারতীয় বড়-বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে কাজ করবে এবং নিজেদের মুনাফার লোভে তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদ মাথা পেতে নেবে। রাষ্ট্র, প্রসাশন, সামরিক বাহিনীর সর্বত্র ভারতীয় চরদের আনাগোনা হবে উন্মুক্ত এবং দেশপ্রেমিক যেকোনো ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে অপদস্ত করে অপসারণ করা হবে। মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের ৮০ শতাংশ ‘বুদ্ধিজীবি’ ভারতীয় গোয়েন্দাদের টাকায় বিক্রি হবে। এমনসব সংস্থা ও গোষ্ঠী নাগরিক সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন করবে যারা ভারতীয় গোয়েন্দা পরিকল্পনার অংশ। যার ফলে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ইন্টেলিজেনশিয়ার একটা বড় অংশ ভারতের সপক্ষে সক্রিয় জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখবে বা রাখতে বাধ্য হবে। বাকী ২০ শতাংশ বুদ্ধিজীবি স্বাধীন মত নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করবে, কিন্তু তারা প্রতিনিয়ত হেনস্তার শিকার হবেন। এভাবেই কোন আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ছাড়াই ভারতীয় আধিপত্যবাদ অনানুষ্ঠানিকভাবে এই দেশে তাদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।

কোন প্রতিরোধ কি হবে না?

৪। এই চরম বৈরি পরিস্থিতিতে মধ্যমপন্থী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীগুলো চরম দমনপীড়নের মুখে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, অনেকে হারিয়ে যাবে। রাজনৈতিক ইসলামপন্থী দলগুলো এই ভারতীয় আধিপত্যবাদের শক্ত বিরোধী হিসেবে গড়ে উঠবে। কিন্তু তাদেরকে দীর্ঘসময় নির্যাতন-নিপীড়নের একটি চরম বৈরি সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার দেশজ সংগ্রাম গড়ে উঠবে, কিছুটা পশ্চিমা, কিছুটা চৈনিক সহায়তায়। কিন্তু এই লড়াইয়ের ব্যাপকতা এত ব্যাপক হবে যে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের অনুরূপ হতে পারে। পার্থক্য হচ্ছে এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ প্যালেস্টাইন ও কাশ্মীরের পরিণতিও বহন করতে পারে, অর্থাৎ ভারতীয় আধিপত্যবাদের হাত থেকে মুক্তি মেলা কঠিনতর হতে পারে।

শেখ হাসিনা ও তার সভাসদরা কি এই সমূহ বিপদ সম্পর্কে অবগত?

৫। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য হচ্ছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীরাসহ যারা এই বর্তমান রেজিমের সঙ্গে থেকে বাংলাদেশকে এই ভয়ংকর পরিণতির সম্ভাব্য পথে নিয়ে যাচ্ছে তাদের কিয়দাংশ লোকও এখনও এই বিপদ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। এটি যেন ১৭৫৭ সালের মীরজাফরের পুনঃচিত্রায়ন! ব্রিটিশদের সহায়তায় ক্ষমতা দখল, ক্ষমতার মোহে অন্ধ মীরজাফর স্বাধীনতার অস্তমিত সূর্যকে দেখতে পাননি। একইভাবে প্রায় ২৬৭ বছর পর শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগ ভারতীয়দের সহায়তা ক্ষমতার মসনদ দখল ও পাকাপোক্ত করার স্বপ্নে বিভোর। তারা ভুলে গেছে এই পূর্ব বাংলার মানুষের কয়েকশ’ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের কারণ। তারা ভুলে গেছে এই রাষ্ট্রের টিকে থাকার সবচেয়ে বড় রশদ, এবং এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঝুঁকির উৎস। এতসব ভুলে মচ্ছবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার পথ হারাতে বসেছে। খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই কি একে উদ্ধার করা যাবে?!

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান