বাংলাদেশে কিংমেকারের হাতবদল: সামরিক বাহিনী থেকে পুলিশ

Source: Pritzker Military Museam

বাংলাদেশে কিছু পুলিশ সদস্যের অপকর্ম সবসময়ই ছিলো। মন্দের সংখ্যা বেশি থাকলেও, ভালো পুলিশও ছিলো। ১৯৯১ পরবর্তী গণতান্ত্রিক পরিক্রমায় রাজনৈতিক জোটগুলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার করলেও দ্বিদলীয় রাজনৈতিক দ্বৈরথে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পুলিশকে নতুন করে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করে। ১৯৯০ পূর্ববর্তী সামরিক সরকারের সময় যা কিছু মন্দ ছিলো প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্রের ‍যুগে তার কোন উন্নতি তো হয়ইনি, বরং কোথাও কোথাও চরম মাত্রায় বেড়ে গেলো।

কিন্তু একটা জায়গায় পুলিশ পুলিশই ছিলো। তারা ছিলো ক্ষমতাসীনদের লাঠিয়াল বাহিনী। কিংমেকার কখনোই নয়। ১৯৯০ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় কিংমেকারের ভূমিকায় সবসময়ই ছিলো জলপাই বাহিনী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারের সময় তাদের ভূমিকা গণআকাঙ্ক্ষার সমার্থক ছিলো, অর্থাৎ সদ্য বিদায় নেওয়া সরকারি দলের গুণ্ডামিতে জনগণের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, এবং জনগণ যখন হাজারি-ওসমান-ডেভিডদের দাপটে কোনঠাসা, তখন সামরিক বাহিনীর সরব ও আপাত “নিরপেক্ষ” (সদ্য বিদায় নেওয়া সরকারের নীলনকশার বিপরীতে যে তারা কাজ করেছে সেটিই বিপ্লবাত্মক) উপস্থিতি মানুষকে সাহস জুগিয়েছে, ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তনে উৎসাহিত করেছে। সে বিবেচনায় সামরিক বাহিনীর এ নিরপেক্ষ ভূমিকা কিংমেকারের কম কিছু নয়। তাদের নিরপেক্ষতাও একটা জোরালো অবস্থান। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় ২০০৯ সালের পর। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা প্রলম্বিত করার লোভে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়। তাদের ক্ষোভ তিনমাসের টেকনোক্রেট ওই মন্ত্রীসভা ছিলো না, বরং কিংমেকার সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার হতাশা থেকে তারা এটি করে। তারপর যেটি হলো সেটি বিস্তারিত বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমি আমার সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণটি এখানে তুলে ধরছি।

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই খুবই সচেতনভাবে সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক সংঘাত মোকাবেলায় ব্যবহার করেনি। এর মূল কারণ তারা সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার একটি অংশীদারিত্ব তৈরি হোক সেটি তারা চায়নি। এই অংশীদারিত্ব তৈরি হলে তাদের হস্তক্ষেপ বাড়বে সম্ভবত এই বিবেচনায় তারা এমনকি বড় জাতীয় সংকটগুলো থেকেও সামরিক বাহিনীকে দূরে রাখে। যেমন, ২০১৩ সালের হেফাজত ইসলামের শাপলা চত্ত্বরে অবস্থানের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর কর্মসূচিটি মোকাবেলায়ও তারা সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেনি। এছাড়া ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতা ও দেশ অচল হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে তারা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেনি। তারা সরকারের বৃহত্তর সংকটগুলো মোকাবেলা একদিকে সেনাবাহিনীর ব্যবহার এড়িয়ে গিয়েছে অন্যদিকে সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন লাভজনক উন্নয়ন প্রকল্পে লোভনীয় বেতন ও সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। যার ফলে সামরিক বাহিনীতে উল্টো নির্ভরশীলতার সমীকরণ তৈরি হয়েছে যেখানে সামরিক বাহিনীর একটা অংশ মনে করেছে সরকার গঠন বা টিকিয়ে রাখায় আমাদের কোনো ভূমিকা না থাকলেও আমরা সুবিধাভোগী হচ্ছি, সুতরাং সেটি মন্দ নয়।

যদিও সরকার পরিচালনায় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করারও কথা নয় (বিএনপি’র শাসনামলে ক্লিনহার্টের অনুরূপ কিছু), বাংলাদেশে ১৯৯০ পরবর্তী নির্বাচনের সময়গুলোতে সামরিক বাহিনীর কিংমেকারের ভূমিকা ছিলো স্পষ্ট। এটি সম্পূর্ণ বদলে যায় ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনীর ক্ষমতা সংকুচিত করে নামে মাত্র নির্বাচনী দায়িত্বে নিযুক্ত করে। আওয়ামী লীগ একাজটি করে তাদের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ হিসেবে যে সেনাবাহিনীকে কোনোভাবেই ক্ষমতার অংশীদার (স্টেক) করা যাবে না কিংবা তাদের মধ্যে এ ধারণা দেওয়া যাবে না যে তারা সরকারকে কোনো সুবিধা দিয়েছে। বরং উল্টোভাবে তাদেরকে যা পারো দিয়ে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ কর।

সেনাবাহিনীকে কিংমেকারের ভূমিকা থেকে সরাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে পুলিশকে ক্ষমতায়ন করতে হয়েছে। অত্যন্ত সুকৌশলে সামরিক বাহিনীর স্থলে পুলিশকে ক্ষমতার অংশীদার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত ইসলামকে মোকাবেলায়ও যেকারণে পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এভাবেই সরকারের পুলিশ নির্ভরতা ক্রমাগত বেড়েছে। ক্ষমতার জটিল হিসেব-নিকেশে আওয়ামী লীগ এ ব্যবস্থাটিকে নিরাপদ বিবেচনা করেছে। কারণ পুলিশকে ক্ষমতার অংশ করা হলে প্রতিদান হিসেবে বড়জোড় পুলিশ অফিসারদেরকে অবসরের পর রাষ্ট্রদূত করা লাগবে, কিংবা এম.পি./মন্ত্রী করা লাগবে – কিন্তু পুলিশের পক্ষে সামরিক বাহিনীর মতো ক্ষমতাকেই চ্যালেঞ্জ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও যেকারণে পুলিশের উপরই শেখ হাসিনার ভরসা ছিলো।

তবে গত ১০ বছরে পুলিশকে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা ক্ষমতার সিড়ি হিসেবে ব্যবহারের চূড়ান্ত রূপটি ছিলো ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। এতদিন পুলিশ শেখ হাসিনার ক্ষমতা নিরঙ্কুশকরণে পার্শ্ব চরিত্রের ভূমিকায় থাকলেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পুরোপুরি কিংমেকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সরকার ও পুলিশ একাকার হয়ে যায়। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আমি নিজে অন্তত একাধিক সংসদীয় আসনের নির্বাচন ও পুলিশের ভূমিকা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি। কিভাবে তারা সরকার দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী ও নিষ্ক্রিয় নেতাদের নিজেরা আপোষের চেষ্টা করেছে, সরকারপন্থী বিদ্রোহী ও নিষ্ক্রিয় কিন্তু শক্তিশালী নেতাদের টাকা/ঘুষ বিতরণ ও মধ্যস্ততার দায়িত্ব পালন করেছে, অথবা টাকায় কাজ না হলে হুমকি দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে, কিংবা কীভাবে বিরোধী দলীয় প্রার্থীর নেতাকর্মীদের অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঘরবাড়ি ছাড়া করেছে। তবে সবচেয়ে গুরুতর যে কাজটি তারা করেছে সেটি হলো নির্বাচনের পূর্ব রাতেই (৩০ ডিসেম্বর রাতে) প্রায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ব্যালট কাস্ট করে ফেলে। বাংলাদেশে ও সমকালীন বিশ্বে এটি একটি নজিরবিহীন কারচুপির ঘটনা। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারিখটিই বাংলাদেশের পুলিশের মনোজগত সম্পূর্ণরূপে বদলে দেয়। তারা ভাবতে শুরু করে যে তারাই আসল কিংমেকার। তারা ইচ্ছে করলে সরকার অদল-বদল করতে পারে। আওয়ামী লীগের বহু স্থানীয় নেতাও তাদের অহম ও ঔদ্ধ্যতের কাছে বন্দী হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের এই ঔদ্ধত্য ও অহমটি ছিলো বড় বিপর্যয়েরও ইঙ্গিত।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অন্য আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে। নির্বাচনের দায়িত্ব পালনে সারাদেশে সামরিক বাহিনীকে নিয়োগ করা হলেও তাদেরকে একেবারেই ক্ষমতাহীন, নিধিরাম সর্দার করে রাখা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম ছাড়া তাদের একপাও না নড়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়, এমনকি চোখের সামনে সন্ত্রাস-সহিংসতা-অনাচার ঘটতে দেখলেও। এভাবে হাত-পা বাধা অবস্থায় সেনাবাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করার বিধান ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম প্রয়োগ করে। যদিও ২০১৪ সালে আদতে কোনো নির্বাচনই হয়নি যার ফলে এ কৌশলের কার্যকরতা বুঝা যায়নি। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে এর সফল প্রয়োগ হয়েছে। তবে যেটির জন্য এমনকি সেনাবাহিনীও প্রস্তুত ছিলো না সেটি হলো তাদেরকে সাক্ষী গোপাল রেখে পুলিশ দিয়ে ভোট ডাকাতি করা। সেনাবাহিনীর বহু কর্মকর্তা ও হাজার-হাজার সদস্য সে রাতে বিরোধী দল, সাধারণ মানুষের অসংখ্য ফোন কল পেয়েছে যে ওমুক বাড়িতে, তমুক স্কুলে রাতেই সিল মারা হচ্ছে। আমি নিজে একাধিক কল করেছি সেনাবাহিনীর কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের। কিন্তু তারা তাদের অপারগতা প্রকাশ এবং চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। এই কিছু করতে না পারার অক্ষমতা এবং পুলিশের মতো বেসামরিক একটি বাহিনীর গুণ্ডামি, ডাকাতি চোখের সামনে সংঘটিত হওয়ার পরও শক্তিশালী বাহিনী হয়েও কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা সামরিক বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে কিংমেকারের ভূমিকা পালনের পর থেকে বাংলাদেশ অন্য পুলিশ দেখছে। এ পুলিশ কেবল ধরাকে সরা জ্ঞানই করে না, বরং শাসক দলের নেতাদেরও ধমক দেয় যে “আমরাই তোদের ক্ষমতায় এনেছি”। যেখানে শাসক দলের বহু নেতাই পুলিশের ঔদ্ধত্য ও অনুকম্পাধীন, সেখানে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। এই সীমাহীন ঔদ্ধত্যই তাদেরকে লাগাম ছাড়া করে দিয়েছে। যেকারণে প্রদীপের মতো একজন ওসি দুই বছরে ২০০-এর কাছাকাছি খুন করেও রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পায়। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে।

এসব বিবেচনায় আমি মনে করি ২০২০ সালের ১ আগস্ট ছিলো এই সীমাহীন ঔদ্ধত্যেরই একটি মঞ্চায়ন। সেদিন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিজের পরিচয় দেওয়ার পরও এসআই লিয়াকত, ওসি প্রদীপ তাকে “বুঝিয়ে” দিতে চেয়েছে যে “চালকের” আসনে আসলে কারা এবং ভেবেছিলো যে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সামরিক বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই যেহেতু তারা ভোট কারচুপি করে সরকারই গঠন করে ফেলতে পেরেছে সেখানে একজন মেজর সিনহাকে খুন করা কোন ব্যাপারই নয়! মোটের উপর ক্ষমতা বলে কথা।

মেজর সিনহার খুন নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করছেন। আমার বিবেচনায় মেজর সিনহা ২০১৮ সাল পরবর্তী পুলিশ বাহিনীর সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও অহমের বলি হয়েছেন। যে কারণে এসআই লিয়াকতের তাচ্ছিল্য মুখ ফুটেই বেরিয়ে গিয়েছে যে “এরকম মেজর” সে অনেক দেখেছে। কিংবা ওসি প্রদীপের পরামর্শদাতা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আল্লাহ বখ্স চৌধুরীরর ভাষায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা খুন করলে “এত ডরের কী আছে!” কিন্তু এই লিয়াকত, প্রদীপ, ও আল্লাহ বখ্স চৌধুরীরা হিসেব করতে ভুলে গিয়েছে যে আন্তঃবাহিনী সংঘাত বেধে গেলে তাদের সকল হিসেবই উল্টে যেতে পারে। তাদের কিংমেকার হওয়ার খায়েশ মিটে যেতে পারে; বরং পুরনো হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে দেওয়ার বিষয়ও চলে আসতে পারে।

পুলিশ একটা রাষ্ট্রে সবসময়ই পেরিফেরাল বা প্রান্তিক শক্তি যারা ক্ষমতার সহায়ক। তারা বিদ্যমান রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনীর ছায়ায় কাজ করে। ছাপিয়ে যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে ২০১৪ পরবর্তী সময়ে পুলিশের এই যে সবাইকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠার আকাঙ্ক্ষা এটি অত্যন্ত অস্বাভাবিক এবং যার ফলে এই ফেনোমেনন ক্ষণস্থায়ীই হওয়ার কথা। আমি মনে করি মেজর সিনহা হত্যা বাংলাদেশে পুলিশের যে রামরাজত্ব কায়েম হয়েছে সেটির লাগাম টেনে ধরার একটি সুযোগ। যদি এবারে এটি করা না যায় এবং তাদের পুনরায় কিংমেকার হওয়ার শখ জাগে, তাহলে তারা ও তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক দল/গোষ্ঠীর দুর্দিন আসন্ন।

1 thoughts on “বাংলাদেশে কিংমেকারের হাতবদল: সামরিক বাহিনী থেকে পুলিশ”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান