আয়মান সাদিক, অবৈধ শাসকের ডিভাইড এন্ড রুল নীতি, এবং মুসলমানদের করণীয়

In politics, nothing happens by accident. If it happens, you can bet it was planned that way.” – Franklin D. Roosevelt

১। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কাদের মোল্লার রায়কে ঘিরে শাহবাগে “বিচার চাই” শ্লোগানে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিলো। এক অদ্ভূত ঘটনা ছিলো সেটি। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে সরকার, তদন্ত করেছে সরকার, অনুগত বিচারক নিয়োগ করেছে সরকার, বিচার করেছে সরকার, বিচার মানি না বলেছে সরকার, পুনরায় বিচারের দাবি করেছে সরকার, অতঃপর আইন সংশোধন করেছে সরকার, আবার বিচার করেছে সরকার, এবং ফাঁসি দিয়েছে সরকার। পৃথিবীর আর কোথাও এরকম বিচার ব্যবস্থা পাবেন? তারপরও একটা নাটক মঞ্চস্থ করা জরুরি ছিলো, যার জন্য, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হাজার-হাজার মানুষকে শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ করে দিয়ে জমায়েত করা হয়েছিলো। এই অধমও দেখতে গিয়েছিলাম। যেখানে রাষ্ট্রে ১০ জনের মিছিল করলে পুলিশের পিটুনি নিশ্চিত, সেখানে দিনের-পর-দিন শহরের রাস্তা বন্ধ করে পুলিশের সুরক্ষায় জমায়েত করা কার ইশারা ও ইঙ্গিতে সেটি না বুঝলে আপনার দোষ। আমি সবসময়ই ১৯৭১ ঘটনার ক্লোজার চেয়েছিলাম, দোষীদের বিচার চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো বিচারিক হত্যাকাণ্ড চাইনি। এক অপরাধের বিচার করতে গিয়ে আরেক অপরাধের জন্ম হোক সেটি চাইনি। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বিচার প্রক্রিয়ায় এর পরিসমাপ্তি চেয়েছি। কিন্তু বিচারকে প্রহসনে পরিণত করে অভিযুক্ত কারো শাস্তি হোক তা চাইনি। শাহবাগের কিছুদিন পর তথাকথিত হেফাজতে ইসলামীর ব্যানারে লক্ষ-লক্ষ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে ঢাকায় আনা হয়েছে। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের মতো আমিও দেখেছি কিভাবে আওয়ামী লীগের বহু স্থানীয় নেতাকর্মী গ্রাম থেকে শহরে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জড় করার কাজে লজিস্টিক্স ও অন্যান্য সহায়তা দিয়েছিলো। মোদ্দাকথা, কাদের মোল্লার রায়, শাহবাগ, ও হেফাজত – একসূত্রে গাঁথা এবং আপনারা বিশ্বাস করেন বা না করেন (তাতে কিছু আসে যায় না) এই তিনটি ঘটনাই এক টেবিল থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছে। দেশের মানুষকে ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে বিভাজন করে অবৈধ শাসন জারির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসকের কুখ্যাত “ডিভাইড এন্ড রুল” নীতির সফল প্রয়োগ করে উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠীকে দেশের মূল সমস্যা পাশ কাটাতে ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মেতে থাকতে এই নাটক প্রযোজনা করা হয়েছিলো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অন্তরালের ক্রীড়নকদের নির্ধারণ করা এই পাতানো খেলায় আপনি, আমি না জেনে অংশগ্রহণ করেছি, ব্যবহৃত হয়েছি।

২। একটি অবৈধ শাসক টিকে থাকে মূলত বন্দুকের জোরে। তবে বন্দুকও একটা সময় পর আর কাজ করে না। সেজন্য অবৈধ শাসকের আরেকটি প্রধান অস্ত্র মানুষকে বিভক্ত করে শাসন করা। মানুষের মধ্যে বিভাজনের দিকগুলো উস্কে দেওয়া। মানুষকে অগুরুত্বপূর্ণ বা প্রায়শই অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে ব্যতিব্যাস্ত রাখা। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের যেসব দেশে দীর্ঘ স্বৈরশাসন টিকে ছিলো বা এখনো আছে সেখানে জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই বিভাজনটা প্রকট। তবে সেগুলো মূলত ট্রাইবাল সোসাইটি বা সেগুলো একাধিক বড় জাতির সংমিশ্রণে নকল, চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্র (থমাস ফ্রিডম্যান যেগুলোকে বলেছেন “ট্রাইবস উইথ ফ্ল্যাগস”) এবং ট্রাইবাল সোসাইটির আদিম প্রবৃত্তি (বেসিক ইন্সটিংট) হচ্ছে নিজেদের ট্রাইবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং সেটি অপরাপর ট্রাইবগুলোকে অবদমনের মাধ্যমেই। নাগরিকত্বের ধারণা ওইসব ট্রাইবাল সোসাইটিতে প্রোথিত নয়। যার ফলে লিবিয়ার মানুষ যতটা “লিবিয়ান” তার চেয়ে বেশি তুয়ারেগ, ওয়ারফালা, কিংবা গাদ্দাফা উপজাতির, মিশরের মানুষ আরব বা অনারব বিতর্কের বেড়াজালে বন্দী, অথবা ইরাক ও সিরিয়ায় শিয়া ও সুন্নী বিভাজন। একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী মানুষের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি দিলে এসব রাষ্ট্র একাধিক ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হতো কিংবা ফেডারেল বা কনফেডারেট শাসনতন্ত্রের আদলে মানুষ অনেক বেশি স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতো।

৩। এটি বলার অর্থ এসব বিভাজন স্বৈরশাসকদের জন্ম ও বেড়ে উঠার রসদ। কিন্তু বাংলাদেশ তো মোটাদাগে হোমোজেনাস – দেশের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ একটি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ একই ধর্ম পালন করে। সে বিবেচনায় এটি তো স্বৈরশাসকদের ক্লাসিক বধ্যভূমি হওয়ার কথা। এবং ইতিহাসে হয়েছেও তাই। এখানে কোন স্বৈরশাসক দীর্ঘদিন টেকেনি। এ ধরনের দেশে স্বৈরশাসকদের টিকে থাকতে হলে যার কারণে একটা নকল বিভাজন তৈরি করতে হয় এবং গত ৫০ বছরে একাধিক স্বৈরশাসক একট নকল বিভাজন তৈরি করার চেষ্টা করেছে ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়ে। তবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মূল ধারাকে এ ধরনের বিভাজন দিয়ে কিছুকাল বিভ্রান্ত করা সম্ভব হলেও ট্রাইবাল সোসাইটির মতো এখানে গভীর বিভাজন অসম্ভব। এখানকার যে বিভাজনটা দেখা যায় তার স্বরূপ অনেকটা রাজনৈতিক, পরিচয়ের না। আমাদের দেশে যার ফলে স্বৈরশাসকদের জন্য এই নকল বিভাজনের পাশাপাশি বিদেশী শক্তির সহায়তা লাগে। গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ একাজটি করছে মূলত পশ্চিমাদের কাছে ইসলামের জুজুকে বিক্রি করে। ভারতীয়দের কাছে ইসলামী জুজু মুখ্য নয়, তাদের কাছে মুখ্য কে তাদের দালালী করবে ও স্বার্থ সুরক্ষা করবে। ইসলামীস্টরা তাদের দালালী করলে ভারত তাদেরকেও কোলে তুলে নিবে। যদিও তারা দেখেছে যে বাংলাদেশে তাদের পরিকল্পনার মূল বাধা হয়ে দাড়িয়েছে ওই ইসলামিস্টরা। কিন্তু ১/১১-এর পর ওয়ার এন্ড টেররের যুগে পশ্চিমাদের কাছে ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যার ফলে বড় ধরনের মুসলিম কনসেন্ট্রেশন রয়েছে এরূপ রাষ্ট্রগুলো নিয়ে পশ্চিমারা উদ্বিগ্ন থাকে। এই ভয় ও উদ্বেগ আওয়ামী লীগ গত ১০ বছর বিক্রি করেছে। আমি বাংলাদেশে কাজ করা বিভিন্ন পশ্চিমা কূটনৈতিক বা এ পর্যায়ের লোকদের সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি তাদের মধ্যে সত্যি সত্যি এ ভয়টা কাজ করে এবং আওয়ামী লীগ তাদের মাঝে এই ভয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। সুতরাং সে এটা বিক্রি করে।

৪। টেন মিনিট স্কুলের আয়মান সাদিককে কে বা কারা হুমকি দিয়েছে এই পুলিশি রাষ্ট্রের পক্ষে তা বের করা ২৪ ঘন্টার বিষয়। এই প্রযুক্তি তাদের কাছে রয়েছে। কিন্তু আপনি কখনোই জানবেন না তাকে সত্যি সত্যি কে হুমকি দিয়েছে। বা আদৌ কেউ হুমকি দিয়েছে কিনা। ফেসবুকের স্ট্যাটাস কোন কিছু প্রমাণ করে না। ওই অ্যাকাউন্ট কার, কে চালায় সেটি সরকার জানে বা সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী নিজেরাই চালায়। পূর্বের ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতায় আমার অনুমান এর পেছনে সেই একই শক্তি জড়িত যারা শাহাবাগ মঞ্চ ও হেফাজত দুটোই তৈরি করেছে। তারা জানে ধর্মপ্রাণ মানুষদের একটি বড় অংশ দ্রুতই এই ধরনের প্রোপাগাণ্ডা লুফে নিবে, বহু “ধর্মপ্রাণ” মানুষের মাঝে “অনুভূতি” জেগে উঠবে এবং বহু মানুষ “কল্লা চাইবে”। এটি একটি ললিপপ ধরিয়ে দেওয়ার মতো। এবং যারা ললিপপ ধরিয়ে দিতে চেয়েছে তাদের কাজ তারা সফলভাবে করেছে। সুতরাং আপনি জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ওই ললিপপটি নিবেন কিনা কিংবা সে অপশক্তির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবেন কিনা নিজেকে সে প্রশ্ন করুন। যারা অবৈধ শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য পশ্চিমাদের দিনরাত দেখাতে চায় যে এই যে দেখ, বাংলাদেশ উগ্রবাদীদের আস্তানা এবং এই উগ্রবাদী মুসলমানদের গণতন্ত্র দিলে তারা ইসলামিস্টদের নির্বাচিত করবে, সুতরাং গণতন্ত্র দরকার নাই, আমরা জোর করে শাসন করলেও তোমরা আমাদের সমর্থন কর – আপনি জেনে বা না জেনে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছেন কিনা ভেবে দেখুন।

৫। ভারতের সমর্থন কেন গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা সবাই জানি। তারা আমাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে। তারা এদেশে হাজার-হাজার এজেন্ট ও তাবেদার পোষে, তাদের পেরোলে রাখে – এ তালিকায় সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, প্রশাসনের লোক থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরাও রয়েছে। সুতরাং দেশে ভারত চাইলেই নানা গণ্ডগোল পাকাতে পারে, স্যাবোটাজ করতে পারে, সরকারকে অস্থিতিশীল বা স্থিতিশীল করতে পারে। তারা এটি করে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে “কব্জায়” রাখতে হবে, বা তাদেরই ভাষায় বললে “বাংলাদেশকে রাডারের বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না”। কিন্তু অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন পশ্চিমাদের সমর্থন এতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন। উত্তর হচ্ছে, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য। একটি উদাহরণ, এবং সম্ভবত সবচেয়ে বড় উদাহরণ, দিচ্ছি: বাংলাদেশের রপ্তানী আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগ আসে পোশাক শিল্পের রপ্তানী থেকে। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানী করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভূক্ত দেশগুলোতে। মোট পোশাক রপ্তানীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬০ শতাংশের বেশি) যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে, এবং এই রপ্তানী সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত! অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদেরকে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার শুল্ক ছাড় দেয়। আমাদের এলিট ব্যবসায়ী শ্রেণির জন্য ইহা একটি বিশাল আয়-রোজগার। দেশের জন্য তো অবশ্যই। এই শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয় জিএসপি’র অধীন। জিএসপি অধিকার নয়, একটি প্রিভিলেজ এবং ইইউ ইচ্ছে করলে এই প্রিভিলেজ কেড়ে নিতে পারে, যেমনটি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে করেছে। সুতরাং ইইউ যদি জিএসপি কেড়ে নেয়, বাংলাদেশের এলিটদের কী অবস্থা হবে চিন্তা করুন!

৬। জনগণের সমর্থনহীন রাষ্ট্রে স্বৈরশাসকরা এলিট সেটেলমেন্টের উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু এই ইইউ কূটনীতিকরা গণতন্ত্রহীন, মানবাধিকারহীনতার জন্য বাংলাদেশকে মৃদু ভৎসনা করলেও শাস্তি দেয় না। তারা ইচ্ছে করলে জিএসপি বাতিল করতে পারতো, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারতো। তারা ইচ্ছে করলে একটি দেশকে যুদ্ধ ছাড়াই কেবল নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কিভাবে শেষ করে দিতে পারে তার উদাহরণ ইরাক, ইরান, উত্তর কোরিয়া, জিম্বাবুয়ে, ভেনিজুয়েলা। নিষেধাজ্ঞা না দিক (আমরা কেউই সেটি চাই না, কারণ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মূলত একটি দেশের জনগণকেই শাস্তি দেওয়া হয়) তারা কেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকারের চূড়ান্ত অধঃপতন রোধে তাদের এই দরকষাকষির ক্ষমতা ব্যবহার করে না? উত্তর, ওই যে উগ্রবাদী মুসলিম জুজুর ভয়! ওয়ার অন টেরর। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে এত কিছু করবে? তাদের ঠেকা কী? সঠিক প্রশ্ন। উত্তর হচ্ছে, তাদের ম্যান্ডেট, মানে তাদের নিজেদের উপর নিজেদের আরোপিত ম্যান্ডেট। সেটি কী? সেটি হচ্ছে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে বিশ্বব্যাপী তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রমের অংশ এবং তাদের প্রদত্ত সহায়তা ও প্রিভিলেজ বণ্টনের শর্ত হিসেবে দেখে। তারা এসব মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে প্রচার করে, সেগুলো প্রতিষ্ঠায় কাজ করে বলে দাবী করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব দাবির সত্যতা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিচ্যুতিও আছে।

৭। সুতরাং মুসলমান ভাইলোগ, রাজনীতির অন্ধকার দিক পাঠ করেন, দেশ-বিদেশের রাজনীতির জটিল সমীকরণ আত্মস্থ করেন, তারপর ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া দেখাইয়েন। একজন অসৎ, দুর্নীতিবাজ শাসক আপনার ঘাড়ে বন্দুক রেখে শাসন করছেন। তারা চায় যে আপনি উগ্র আচরণ করেন, তারা চায় যে আপনাদের অনেকে “ধর্মীয় উন্মাদনা” দেখিয়ে মানুষের “কল্লা চান” যাতে তারা নিজেরাই সে কল্লাটা ফেলে দিয়ে বলতে পারে “ওই যে দেখ উগ্রবাদীরা কল্লাটা নিয়েছে”। অন্ধকারে কে কার কল্লা নেয় তা আপনি জানবেনও না, কিন্তু আপনার ঘাড়েই দোষ আসবে। সেভাবেই এটি পরিকল্পনা করা। তারা চায় যে আপনি একে-ওকে কাফির বলেন, নাস্তিক বলেন যাতে তারা আপনাদের এই লাইক-শেয়ার পশ্চিমাদের কাছে বিক্রি করে আপনাকে জোরপূর্বক শাসন করতে পারে। আপনার অনুভূতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ – কিন্তু আপনি কি জেনে বা না জেনে কারো দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন? নিজেকে প্রশ্ন করতে শিখুন।

৮। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ১৪ বছরের এক কিশোর মোবাইল ফ্লেক্সিলোডের ১০০ টাকার মধ্যে ৩৫ টাকা যে সরকার নিয়ে নিবে সেটিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর “বিদবা ভাতা” [ওই কিশোর বানানে ভুল করেছে, ভুলটি ইচ্ছে করেই রেখে দিলাম] হিসেবে উল্লেখ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় তাকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নামে বাংলাদেশে যে অসভ্য একটি আইন চালু আছে তার আওতায় মামলা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই কিশোরের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হয়তো তার বন্ধুমহলের ১০০ বা ২০০ মানুষ পড়তো। কিন্তু সরকার মামলা, গ্রেফতার করে ওই কিশোরের স্ট্যাটাসটি এখন মিলিয়ন মানুষ পড়েছে, সারা বিশ্বে সংবাদ হয়েছে। লাভ হলো? আপনারাও বিষয়টি বিবেচনা করবেন। যখন কেউ “ধর্মীয় অনুভূতি”-তে আঘাত করা কোন স্ট্যাটাস শেয়ার করবে আপনার সাথে আপনি তাকে বলবেন যে তুমি হয়তো না জেনেই কোন খারাপ লোকের মতলব বাস্তবায়ন করছো, তুমি খারাপ কথা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছো। সুতরাং এসব পোস্ট নিজেরা কখনোই শেয়ার করবেন না, এবং অন্যকে শেয়ার করতে বারণ করবেন। যিনি ধর্মের অবমাননা করবেন, তার উত্তম বিচারক তো আল্লাহ। আপনি যদি উন্মাদনা তৈরি করেন আপনার সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে বহু মানুষ বহু উদ্দেশ্য হাসিল করবে। আপনি পড়ালেখা করবেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষতা অর্জন করবেন। উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবেন। উত্তম মানুষ হয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করবেন, আপনার চারিত্রিক উৎকর্ষতা দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করবেন। রাজনীতি পড়বেন, ভূ-রাজনীতির কলাকৌশল সম্পর্কে জানবেন। যাতে এই জটিল বিশ্বব্যবস্থার কূটিলতাগুলো পড়তে পারেন, সেভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারেন।

৯। মুসলমান ভাইলোগ, আপনারা এক বৈশ্বিক লড়াইয়ের নিপীড়িত অংশ। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া – সর্বত্র কেবল মুসলমান হওয়ার কারণে আপনার নিপীড়িত হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। সুতরাং আপনার রাগের, ক্ষোভের রসদ রয়েছে। কিন্তু আপনাদের রাগ, ক্ষোভ, অভিমান শোনার কেউ নেই। তথাপি লড়াইয়ে নামার আগে মাথা ঠাণ্ডা করেন। লড়াইটা অনেক বড় ও বিস্তৃত। লড়াইটা উল্টোভাবে করেন। প্রতিপক্ষ নিচে নামলে আপনি আচরণে, মর্যাদায় আরো উপরে উঠুন। আপনার মানবিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতির উত্তম দিক তুলে ধরুন। কিন্তু যদি চূড়ান্ত বিচারে লড়াই করতেই হয়, সেক্ষেত্রে গতর নয়, বুদ্ধি-বিবেচনা-জ্ঞান-বিজ্ঞান ব্যবহার করুন। যদি নিজেদের সাময়িক অক্ষমতায় দিগ্বিদিক বিবেচনা না করে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন, সেটিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে আপনাদের উপর আরো বেশি সহিংসতা করা হবে। কারণ যারা আপনার প্রতিপক্ষ, সহিংসতা করার সক্ষমতা আপনার চেয়ে তাদের অনেক বেশি।

১০। আপনি জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া এই সমীকরণ উল্টাতে পারবেন না। আর এই সমীকরণ না উল্টালে আপনি তাদের পাতা ফাঁদেই বারবার পা দিবেন। তারা চায়ই যে আপনি অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়ে যাতে রেগে যান। হিতাহিতশূন্য আচরণ করেন। কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনাদের পক্ষে বর্তমানে সময় বা সমসাময়িক ইতিহাস কোনটিই নেই। বর্তমান বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যারা দিনে-রাতে আপনার ক্ষতি করার সক্ষমতা রাখে তাদের অনেকেই আপনাকে “সন্ত্রাসী” ট্যাগ দিয়ে শায়েস্তা করতে চায়, খুন করতে চায়। সুতরাং আপনার লড়াইটা একই সাথে বেঁচে থাকার, এবং একই সাথে নিজেদের উৎকর্ষতা অর্জনের। দুটো কাজ একসাথে কঠিন কারণ আপনার উৎকর্ষতা অর্জনের চেষ্টাও অনেকে থামিয়ে দিতে চাইবে যেমনটি ইসরায়েল মালয়েশিয়ায় আততায়ী পাঠিয়ে প্যালেস্টাইনিয়ান বিজ্ঞানীকে খুন করার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে। এই জটিল, বিরূপ বিশ্বব্যবস্থায় হয় বিশ্বকে জানবেন, বিশ্বের কূটিল রাজনীতি বুঝবেন এবং নিজের করণীয় নির্ধারণ করবেন, নতুবা আরও ৫০ বছর, ১০০ বছর এভাবে পড়ে পড়ে মার খাবেন।

2 thoughts on “আয়মান সাদিক, অবৈধ শাসকের ডিভাইড এন্ড রুল নীতি, এবং মুসলমানদের করণীয়”

  1. পলিটিকস এর কিছু বই এর সাজেশন দিতে পারবেন কেউ? লেখক এর কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত এবং উৎকর্ষতা অর্জনের চেষ্টার যে কথা বলেছেন, তার সাথে আমিও একমত। আশা করি, লিখে যাবেন নিয়মিত।

    Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান