প্রক্রিয়াগত ও সুসংহত গণতন্ত্র: আমাদের অবস্থান

গণতন্ত্রের নানা প্রকারভেদ আছে, তার মধ্যে মৌলিক কিছু প্রকার হচ্ছে: প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্র (procedural democracy), বনাম সুসংহত গণতন্ত্র (consolidated/ substantive democracy)। অথবা পরোক্ষ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র (representative democracy), বনাম প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র (direct democracy) প্রভৃতি। আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার খাতিরে আজকে আমরা প্রথম দুটি প্রকার ও সেগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে আলাপ করছি।

১। প্রক্রিয়াগত (procedural) গণতন্ত্র-কে অনেকে ভোটের গণতন্ত্র বলে থাকে। অর্থাৎ এ ধরনের রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অনেক কিছুই সঠিকভাবে কার্যকর থাকে না। কী কী? যেমন, আইনের শাসন দুর্বল থাকে, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি থাকে, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের মত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আগ্রাহ্য থাকে প্রভৃতি। এটিকে কিছু পর্যবেক্ষক ‘অনুদার গণতন্ত্র’ (illiberal democracy) হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু এ ধরনের গণতন্ত্রে নির্বাচনটা ঠিক মতো হয়, অর্থাৎ চার বা পাঁচ বছর পরপর জনগণের সম্মতিতে সরকার গঠিত বা পরিবর্তিত হয় এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ থাকে। এটি গণতন্ত্রের ন্যূনতম কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। গণতন্ত্রের বাকী শর্তগুলোতে অগ্রগতি নির্ভর করবে এই প্রথম ও পূর্বশর্তটি কার্যকর কিনা অর্থাৎ দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় কিনা। কোনো রাষ্ট্রে একটি দীর্ঘ, লম্বা সময় ধরে প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্রের “প্রক্রিয়াটি” অর্থাৎ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনটি চালু থাকলে ধীরে ধীরে সেই গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করতে পারে বা করার সুযোগ থাকে।

২। সুসংহত (consolidated/ substantive) গণতন্ত্র – উপরের প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্র চালু থাকলে ধীরে ধীরে একটা পর্যায়ে একটা রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়। আইনের শাসন দৃঢ় হয়, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা শক্ত হয়, এবং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ে। এভাবে একটি গণতন্ত্র সুসংহত হয়।

তো পুরো বিষয়টি একটি প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের পর আমরা প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্রের এই “প্রক্রিয়াটিই” কেবল শুরু করেছিলাম। ধীরে ধীরে এক-পা, দু-পা করে এগোচ্ছিলাম। এই এগোনোর গতি বা রূপান্তর প্রক্রিয়ার গতি নির্ভর করে কোন রাষ্ট্র বা সমাজের সামজিক-সাংস্কৃতিক সূচক ও অন্তর্নিহিত শর্তগুলোর উপর। এই প্রক্রিয়ায় কারো দুই দশক, কারো চার দশকও লাগতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রের ট্রেনটি লাইনচ্যুত করা যাবে না, অর্থাৎ প্রক্রিয়াটি (অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনটি) চালু রাখতে হবে, অতঃপর হাটিহাটি পা-পা করে এগিয়ে যেতে হবে। গণতন্ত্র সুসংহত হতে দেরি হচ্ছে কিংবা অগ্রগতি দৃশ্যমান নয় এই অজুহাতে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগত শর্তটিকে বাতিল করা যাবে না।

১৯৯০-সালের পর বাংলাদেশের মানুষ কেবল প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্রের পথে প্রথম পদক্ষেপ ফেলেছিলো। দেশের বহু মানুষ একটি সুসংহত গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিলো। মানুষের অধিকারের স্বপক্ষের একটি রাষ্ট্র স্বপ্ন দেখেছিলো। যুদ্ধ করে, ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া একটি রাষ্ট্রের জনগণের জন্য এটি নিশ্চয়ই খুব বেশি চাওয়া নয়। ১৯৯০ সালের পর গত তিন দশকে মানুষের এই আশা ও আকাঙ্ক্ষা নিশ্চয়ই বারবার হোঁচট খেয়েছে (১৯৯৬, ২০০৭ সালে)। কিন্তু এই এক-পা এগোনো কিংবা দুই-পা পিছানোর রাজনীতিতে আমাদের প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্তটি, অর্থাৎ সুষ্ঠু, অবাধ, ও নিরপেক্ষ নির্বাচনটি ২০০৮ পর্যন্ত টিকে ছিলো। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের এই প্রক্রিয়ার সুবিধা নিয়েই ক্ষমতায় ফিরে আসে। কিন্তু তারা ক্ষমতায় ফিরে এসে পুরো প্রক্রিয়াটির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার জন্য যা-যা প্রয়োজন তার সব করেছে। তারা পুরো প্রক্রিয়াটিকেই হত্যা করেছে ফেলেছে। যার ফলে গণতন্ত্র সুসংহত করা দূরে থাক আমাদেরকে প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ন্যূনতম শর্ত – একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের দাবী করতে হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে আমরা আবারো ১৯৯০-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে গিয়েছি যেখানে আমাদেরকে গণতন্ত্রের মৌলিক ও প্রক্রিয়াগত শর্তটি আদায়ের সংগ্রামে ফিরে যেতে হচ্ছে।

1 thoughts on “প্রক্রিয়াগত ও সুসংহত গণতন্ত্র: আমাদের অবস্থান”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান