হেফাজত, আহমদ শফী ও “আওয়ামী মুসলিম লীগ”-এর পুনর্জন্ম

ছবি: যুগান্তর

হেফাজত ইসলামীর ২০১৩ সালের ৫ মে ঘটনার পর আমি বাংলাদেশের অন্তত ১০টি জেলার গ্রামে-গঞ্জে গবেষণার কাজে ঘুরে বেড়িয়েছি। তখন ”হাজার-হাজার আলেম হত্যার” কথা শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। সেজন্য, ব্যক্তিগত অনুসন্ধিৎসা মেটাতে, যেখানেই গিয়েছি এ ঘটনার প্রভাব নিয়ে আমি আম-জনতার সাথে কথা বলে বুঝতে চেয়েছি সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে কিভাবে দেখছে। একটা বিষয় আমাকে অবাক করেছে যে সত্য-মিথ্যা যাই হোক, খেটে খাওয়া, রাজনীতির মারপ্যাচহীন, সাধারণ মানুষের একটা বিরাট অংশ বিশ্বাস করেছে যে ২০১৩ সালের ৫ মে তারিখে শাপলা চত্ত্বরে আওয়ামী লীগ শত-শত কোরআনের হাফেজ, আলেমকে খুন করেছে।

এরকম এক সফরে এক অশতীপর বৃদ্ধ মহিলার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। স্বামী, সন্তানসন্ততিহীন ষাটোর্ধ্ব নারী। লাঠি ভর করে এ বাড়ি, ও বাড়ি সাহায্য চেয়ে বেড়ান। আমি যে গৃহস্থের বাড়িতে গিয়েছিলাম সে বাড়িতেও তিনি সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। কৌতুহলবশত আমি হেফাজতের ওই ঘটনা নিয়া তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি যা বললেন তা হলো: ”শেখ হাসিনা আলেম মেরে শ্যাস করে দিছে। তার উপর আল্লহর গজব পড়ুক।” তাঁর উত্তরটি আমাকে যুগপৎভাবে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং প্রোপাগাণ্ডার শক্তি সম্পর্কে অবাক করেছে। বলাই বাহুল্য, দলীয় রাজনীতির সংস্পর্শতাহীন বেশিরভাগ কাছেই আমি এ ধরনের উত্তর পেয়েছিলাম। বৃদ্ধ ওই নারীর এই খেদোক্তি বাকী বেশিরভাগ সাধারণ মতামতের প্রতীকি হয়ে রইলো।

আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে মনে হয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মে’র পর সারা দেশে আওয়ামী লীগ প্রায় রাজনৈতিক মৃত্যুর মুখোমুখি চলে গিয়েছিলো। ৫ মে ঘটনা পরবর্তী চারটি সিটি কর্পোশন নির্বাচনে হেফাজত রাজনৈতিকভাবে যে অতি তৎপর ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলো তার পরিণতিতে আওয়ামী লীগের অনেক মানদণ্ডে “সফল” মেয়ররাও (বরিশালের কিরন, খুলনার খালেক) এমনকি শক্ত সাংগঠনিক অবস্থান নিয়েও পরাজয় বরণ করে। এ ঘটনার তাৎপর্য ছিলো ব্যাপক।

আমি মনে করি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে পড়তে পারেন অনেকেই সেভাবে পারেন না, যেটি তার এ যাবৎ টিকে থাকারও মন্ত্র। তিনি এ ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করেই দুটো কাজ করলেন: (১) আওয়ামী লীগকে বাম ফ্রিঞ্জদের কবল থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হলেন এবং (২) হেফাজতের সাথে র‌্যাপ্রোচমেন্টে গেলেন।

এ দুটো কাজে তিনি সফল। হেফাজতের কিছু নেতাকে ধরপাকড় করলেও পরে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন ও “যথাযোগ্য মর্যাদা” দিতে চেয়েছেন। তবে বড় ব্যাপার হলো তিনি মোটাদাগে আহমদ শফীসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে আস্থায় নিতে চাইলেন। হেফাজতের অনেক দাবি মেনে নিলেন। যেমন: পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করলেন, কওমী ডিগ্রির স্বীকৃতি দিলেন, হাটহাজারি মাদ্রাসাকে টাকা-পয়সা-জমি সবই দিলেন (যা নিয়ে বিরোধের উৎপত্তি); অনেক তথাকথিত “নাস্তিক ব্লগারদের” হয়রানি, গ্রেফতার, মামলা-হামলা দিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য করলেন; এবং সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো শফী সাহেবদের নিকট নিজেদেরকে প্রায় নিঃশর্তভাবে সমর্পন করলেন – আপনারা বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, বড়-বড় মন্ত্রী, প্রশাসনের কর্মকর্তারা শফীসাহেবের দরবারে ছুটে গিয়ে যেভাবে কদমবুচি করলেন ও তাকে তৃপ্ত রাখতে চাইলেন সেটি অনেক বড় বার্তা। অর্থাৎ “হুজুর আপনাদের মতের বাইরে আমরা যাবে না”। তো হেফাজত ও শফী সাহেবদের নিকট আওয়ামী লীগের এই আত্মসমর্পন তাদের রিয়েলিস্ট নীতি, বাস্তববাদী রাজনীতি। শফী সাহেবকে কিছু লোক ভুল করে দালাল বললেও তিনি আসলে আওয়ামী লীগের মতো দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষমতায় থাকা একটা সেক্যুলার দলকে তাঁর নিকট মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছেন, তাঁর অনেক দাবী মানতে বাধ্য করেছেন – এটিই আহমদ শফী সাহেবের সাফল্য ও লিগেসি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, শফী সাহেবদের দাবি মেনে শেখ হাসিনা কি ভুল করেছেন? আমি মনে করি প্রশ্নটি যতটা না ভুল বা শুদ্ধের তার চেয়ে বেশি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অস্তিত্বের ছিলো। ২০১৩ সালের ৫ মে’র পর আওয়ামী লীগ যে খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিলো সেখান থেকে তাদের নিকটতম পরিণতি ছিলো বাংলাদেশের বামদের মতো হওয়া। বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতি করা দলগুলোতে এত-এত জ্ঞানীগুণি মানুষের সমাবেশের পরও এদেশের মূল ধারার রাজনীতিতে তাদের কোন জোরালো অবস্থান তৈরি না হওয়ার কারণ আমার মতে, মানুষের মাঝে একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা যে তারা “ইসলাম বিরোধী”। আমার ব্যক্তিগত অনুমান (ভুলও হতে পারে) যে বামরা জানে না যে তারা সমস্যাটি জানে না। কারণ বিগত ৫০ বছর ধরে বাম রাজনীতি এত-এত ত্যাগী নেতাকর্মী, পণ্ডিতদের আশীর্বাদ পেয়েও কেন দেশের ১ শতাংশ মানুষের সমর্থনও আদায় করতে পারেনি তার কোন নির্মোহ বিশ্লেষণ ও সেমতে বাম রাজনীতির কোন মডারেশন চোখে পড়েনি।

আওয়ামী লীগকে বাম রাজনীতির এই একই ট্র্যাপ থেকে আপাতদৃষ্টিতে বাঁচিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার জন্য উনাকে হয়তো শফি সাহেবের পদতলে আশ্রয় নিতে হয়েছে, তাঁর দাবি মেনে নিতে হয়েছে, কিন্তু আপাত যে “ইসলাম বিরোধী” বদনাম, ও বামপন্থীদের পরিণতি বরণ করার যে ঝুঁকি উপস্থিত হয়েছিলো, সেটি মোকাবেলায় উনার এই দূরদৃষ্টির প্রশংসা আপনাকে করতেই হবে। হ্যাঁ উনার বর্তমান অগণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিণতিতে আওয়ামী লীগ কোথায় গিয়ে স্থান নিবে সেটি আমাদেরকে দেখতে হবে, কিন্তু ইসলাম-বিরোধী ট্যাগ নিয়ে আওয়ামী লীগ মূল ধারার রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতো।

আমার বিবেচনায় ২০০৭-০৮ সাল যদি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের স্বকীয় যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিকদের অচ্ছুৎ করার সফল প্রকল্প হয় (তথাকথিত সংস্কারপন্থী ট্যাগ দিয়ে), ২০১৩ সালের ৫ মে ঘটনাকে বলতে হবে আওয়ামী লীগের তার পূর্বতন সংস্করণ আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে পুনর্যাত্রার সূচনা। সেখানেই আহমদ শফী সাহেব ও হেফাজতের মূল সাফল্য।

পুনশ্চ: আওয়ামী লীগ, ১৯৭১ ও বাংলাদেশের জন্মকে যারা জোর করে ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালি সংস্কৃতির ধারক বলে মনে করেন তারা অনুগ্রহ করে জেনে রাখুন যে ইসলামের এই প্রভাব বাংলার মূল ধারার রাজনীতিতে সবসবময়ই প্রধান ছিলো। এদেশে বাম ফ্রিঞ্জরা কখনোই নির্বাচনী রাজনীতিতে জিতে নাই বা কোন ফ্যাক্টর ছিলো না। এদেশের নাঙাভুখা কৃষক ও শ্রমিকরা ধর্ম নিয়া সংবেদনশীল। তারা ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট না দিলেও ধর্মহীন হিসেবে ট্যাগ পাওয়া কোন রাজনীতিকে এ মাটিতে প্রশ্রয় দেয় নাই। কেন দেয় নাই? গবেষণা করে বের করেন।

একটা সূত্র দিচ্ছি কেবল: পাশ্চাত্য শিক্ষিত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাষানীরা যখন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট করলেন, তাঁদের ঘোষিত ২১ দফা কর্মসূচীর প্রথম দফা ছিলো: “কোরআন-সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামী সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।” হেফাজত শুধু বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে থাকা একটি স্পেসকে রিক্লেইম করেছে। নতুন কিছু উদ্ভাবন করে নাই। শেখ হাসিনা আহমদ শফী সাহেবের পদতলে আশ্রয় নিয়েছেন নিজের স্বার্থে, কেবল তার দলকে আপাত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়াসে। শফী সাহেবকে তিনি কোন বিশেষ ফেবার করেন নাই। ইতিহাস এভাবেই ঘুরে-ফিরে আসে। দত্ত-কবিরদের মতো আওয়ামী লীগের যেসব পার্শ্ব-চরিত্র রয়েছেন এবং শফী সাহেব ও হেফাজতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন, তারা জেনে রাখুন যে শেখ হাসিনা আপনাদের চিন্তাকে পাত্তা দেয় না, আপনারা শেখ হাসিনার চিন্তার চেয়ে খাটো!

1 thoughts on “হেফাজত, আহমদ শফী ও “আওয়ামী মুসলিম লীগ”-এর পুনর্জন্ম”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান