বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা: যে প্রশ্ন করতে হবে, যে উত্তর চাইতে হবে

আবরার হত্যা কি একটি সামাজিক অপরাধ? অন্য দশটি খুনের মতো একটি সাধারণ খুন? আবরারের প্রকৃত খুনী কারা? ওই গরিব ভ্যানচালক বাবার সন্তান আকাশ? আকাশ কেন আবরারকে খুন করবে? আকাশরা কেন খুন করে? খুন করে কি পায়? আকাশদের ধরে ফাঁসি দিলে আবরাররা আর খুন হবে না? আপনি-আমি এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানি? না জানলে জানতে হবে। কেন, কোন কারখানায় আকাশরা তৈরি হয়? কেন, কার নির্দেশে, কার স্বার্থ রক্ষায় আকাশ-অমিত সাহারা খুন করে? এবং কেন আবরারদের খুন হতে হয়?

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে প্রায় ৫ বছর থাকার অভিজ্ঞতা ও ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিজ্ঞতা থেকে এ প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজেছি। উত্তর, উপসংহারগুলো নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত পর্যক্ষেণ থেকে টানা। স্বীকার করি অন্যদের অভিজ্ঞতা ভিন্নও হতে পারে। যেকোনো ভিন্নমতকে স্বাগত। আমরা যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই সেখানে মুক্ত আলাপ-আলোচনা থাকবে। যেখানে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প বা হকি খেলার স্টিক খেলার সরঞ্জাম হিসেবেই ব্যবহৃত হবে, খুন করার হাতিয়ার হিসেবে নয়।

১। প্রথম ও মৌলিক প্রশ্ন: ছাত্রলীগ কী একটি ছাত্র সংগঠন?

উত্তর: সবাই জানেন যে ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালে একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এবং বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনে এ সংগঠনটির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় চিন্তার যে পুনর্গঠন দরকার, নতুন বাস্তবতার নিরিখে দলীয় নীতি, আদর্শ, কর্মসূচির যে সামঞ্জস্য বিধান দরকার সেটি কি হয়েছে? আমার বিবেচনায় হয়নি। চিন্তার জড়তা, বন্ধ্যাত্ব, ও দেউলিয়াত্ব ছাত্রলীগকে একটি স্বাধীনচেতা, গৌরবোজ্জ্বল সংগঠন থেকে আওয়ামী লীগের মতো একটি পেটি বুর্জোয়া সংগঠনের বি টিম বা পেটোয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি বলতে যা বুঝায়, অন্তত আমি যা বুঝি, বর্তমান ছাত্রলীগ তার ধারেকাছেও নেই। বর্তমান ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কোনো আন্দোলন বা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার বা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের উপর কোনো প্রকার চাপ সৃষ্টি করে এরূপ উদাহরণ দুর্লভ। সুতরাং বিদ্যমান বাস্তবতায় ছাত্রলীগ আদৌ কোন ছাত্র সংগঠন কিনা বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

২। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে: বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রলীগ মূলত কী করে? ‍

উত্তর: এক কথায় বর্তমানে ছাত্রলীগের প্রধান কাজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের নিযুক্ত পাহারাদার হিসেবে কাজ করা। এর পাশাপাশি তারা ক্যাম্পাস ও আশেপাশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, এমনকি চুরি-ছিনতাই ‘ব্যবসার‘ নিয়ন্ত্রণেরও কাজ করে।

৩। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারকে পাহারা দেওয়া কেন আবশ্যক বা প্রয়োজন?

উত্তর: সরকার বা সরকারি দল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়।

৪। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে?

উত্তর: সহজ উত্তর – শিক্ষার্থীরা যাতে সরকার বিরোধী কোনো প্রতিরোধ আন্দোলনের অংশ হতে না পারে সেজন্য। সীমিত সম্পদ এবং জনসংখ্যাবহুল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে সুশাসন নিশ্চিত করা এমনকি যেকোনো আদর্শ গণতান্ত্রিক সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের প্রধান দুটি দল আভ্যন্তরীণভাবে চরম অগণতান্ত্রিক। যেকারণে এমনকি ১৯৯০-২০১৪ গণতান্ত্রিক ক্রান্তিকালেও (democratic transition) বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের অপশাসনের কারণে গণআন্দোলনের ভয়ে ত্রটস্থ থাকতো। ছাত্র ও শ্রমিকরা শ্রেণিগতভাবে যেকোনো বড় রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের মূল চালিকা শক্তি। যার ফলে মিল-কারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিকভাবে এসব আন্দোলনের সূতিকাগার। ঠিক একই কারণে অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক শক্তি বা পক্ষগুলো তাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে যেকোনো সংগঠিত ক্ষোভ-বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ, দমনের অংশ হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একচ্ছত্র আধিপত্য বা দখলদারিত্ব বজায় রাখতে চায়। বাংলাদেশে ২০১৪-পরবর্তী ‘একনায়িকাতন্ত্রের‘ শাসনামলে শাসকদের এই ভয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা ও তার জের বাড়ার কথা বা বেড়েছে বলেই প্রতীয়মান।

৫। ছাত্রলীগ কিভাবে অগণতান্ত্রিক শাসনের পাহারাদার হিসেবে কাজ করে?

উত্তর: টর্চারসেল বা নির্যাতন কক্ষ তৈরি, সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের পঙ্গু করা, খুন করা, কিংবা নিদেনপক্ষে মেরে হল থেকে বের করে দেওয়া। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগের জন্য বিব্রতকর, হুমকিস্বরূপ এরূপ সংগঠিত যেকোনো প্রতিবাদ, বিক্ষোভ যাতে দানা বাঁধতে না পারে তা নিশ্চিত করা। কিংবা দানা বাঁধলে তা নৃশংস উপায়ে দমন করা। এগুলো নিশ্চিত করার প্রিএম্পটিভ বা প্রাক-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ছাত্রলীগকে শিক্ষার্থীদের ভয় দেখাতে হয় কিংবা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয় যাতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে সত্যি-সত্যি ভয় পায়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের নির্যাতন কক্ষগুলোর কাজ এটি। এখানে শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে শাসানো, মারধর করা, হাত-পা ভেঙে দেওয়া, এবং চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে খুন করার মাধ্যমে এই ভয়ের ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। এই ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টির ফলেই বুয়েট ছাত্র আবরারের রুমমেট, সহপাঠীরা জানছে, দেখছে যে তাদের বন্ধুকে নির্মমভাবে পেটানো হচ্ছে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। তারা জানে কিছু বললে তারা এর পরবর্তী শিকার হবে।
দ্বিতীয় যে পদ্ধতিতে ছাত্রলীগ তার ‘জননী‘-কে কিংবা শাসকদল আওয়ামী লীগকে সেবা দিয়ে থাকে তা হলো যদি কোনো কারণে দেশে/শিক্ষাঙ্গণে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধে কিংবা শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে সেটিকে হামলা, আক্রমণ, এবং আইনশঙ্খলা রক্ষাকারী (পড়ুন ‘বিনষ্টকারী‘) বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত প্রতিবাদকে নৃশংস উপায়ে দমন করা।

প্রথম পদ্ধতি, অর্থাৎ টর্চারসেল হচ্ছে উপরের ক্ষমতার ডেলিগেশন – অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে জননী বা আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতার এই নির্দেশ বাস্তবায়নে যা করা দরকার ছাত্রলীগ তা করবে। আপাতদৃষ্টিতে সেই নেত্রী বা নেতা সরাসরি কাউকে নির্যাতন বা খুনের নির্দেশ দেন না, কিন্তু তিনি বা তারা যা চান (নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাঙ্গণ) তা বাস্তবায়নের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে নির্যাতন। নির্যাতন ছাড়া কাউকে ভয় পাইয়ে দেওয়া যায়? অবশ্যই না। সুতরাং এই যে জননী মায়াকান্না করছেন, জানেন না বলছেন, সন্ত্রাস-নির্যাতনকে নিন্দা জানাচ্ছেন – জেনে রাখুন এগুলো চূড়ান্ত ভণ্ডামী। প্রকৃতপক্ষে ছাত্রলীগের জননী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তার নির্দেশ, আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যদি কাউকে খুনও করতে হয়, ছাত্রলীগের কর্মী/গুণ্ডারা তা করবে। যে ছাত্রলীগ কর্মী ‘আদেশ‘ পালন করবে না, সে নিজেও ওই নির্যাতনের শিকার হবে (বুয়েটের এক ছাত্রলীগ কর্মীর সাম্প্রতিক জবানবন্দী পড়ুন)।

মানে কী দাড়ালো? এসব নির্যাতন-খুন ছাত্রলীগের যেসব কর্মী বাস্তবায়ন করে থাকে, অন্যান্য সামাজিক অপরাধের ন্যায় বিষয়গুলো তাদের ব্যক্তিগত কোনো রেশারেশি বা শত্রুতার পরিণতি নয়। যার ফলে এসব খুনের প্রকৃত দায়বার সুপারিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির আওতায় ছাত্রলীগকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে যারা ব্যবহার করছে কিংবা যারা যেকোনো মূল্যে শিক্ষাঙ্গণ ‘নিয়ন্ত্রণ‘ করতে চায়, তাদের। এসব খুনের দায়ে তাদের বিচার হওয়ার কথা। দেশে কোনোদিন সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেলে, তা হবেও।

দ্বিতীয় যে উপায়ে ছাত্রলীগ শিক্ষাঙ্গণে ‘নিয়ন্ত্রণ‘ বজায় রাখে তা হলো শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ যদি ‘মাত্রা‘ ছাড়িয়ে যায় তা সন্ত্রাসী কায়দায়, নৃশংস উপায়ে দমন করা। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রলীগের গুণ্ডা, হেলমেট বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া, কিংবা ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দানা বাঁধলে তাদেরকে পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করা এই দ্বিতীয় উপায়েরই ‘কার্যকর‘ ব্যবহার। এর নির্দেশনা উপর থেকেই আসে। অর্থাৎ ছাত্রলীগ আদিষ্ট হয়ে ছাত্র আন্দোলন ‘বন্ধ‘ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে – হেলমেট, গুলি, বোমা, চাপাতি – যখন যা লাগে তা ব্যবহার করে। শাসক নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে ত্রটস্থ থাকে, ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে, এবং যার ফলে ‘যেকোনো উপায়ে শিক্ষার্থীদেরকে শায়েস্তা করে আন্দোলন ভণ্ডুল করে।

৬। ছাত্রলীগের ক্ষমতার উৎস কী?

উত্তর: শাসকদলের সর্বোচ্চ নেতা, ছাত্রলীগের জননী (নাম নিলে নাকি বিপদ আছে)। আপনারা সবাই জানেন তিনিই ছাত্রলীগের দণ্ডমূণ্ডের কর্তা। তিনিই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বেছে নেন। তিনিই সিদ্ধান্ত দেন কখন কেন্দ্রীয় সম্মেলন হবে, কাকে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক করবেন। যেহেতু তার অবৈধ শাসন রক্ষা করাই ছাত্রলীগের কাজ, তাদের ক্ষমতার মূল উৎসও তিনি। আপনারা জানেন ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের গণভবনে অবাধ প্রবেশাধিকার ছিলো। কেন? বুঝে নেন। তবে জেলা-উপজেলা ইউনিটগুলোর পৃষ্ঠপোষক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগ/যুবলীগের নেতারা। তারা স্থানীয় অনেক রাজনীতিক, সংসদ সদস্য, চেয়ারম্যান – এদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করে বিধায় তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় ছাত্রলীগের অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন।

৭। ছাত্রলীগ কিভাবে সদস্য সংগ্রহ করে? কারা ছাত্রলীগ করে? কেন করে?

উত্তর: আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে ছাত্রলীগের সদস্যরা তিনটি গ্রুপ থেকে আসে। প্রথম গ্রুপটি মফস্বল, গ্রাম থেকে আসা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গরিব, কৃষক, ভ্যানচালক পিতার সন্তান। আর কিছু মফস্বলের মধ্যবিত্ত তরুণ। এরা মেধার প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে থাকার জায়গার সংকটে পড়ে। বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক নিয়মে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আবাসিক হলে সিট পাওয়ার কথা থাকলেও ছাত্রলীগ এই সিট বরাদ্দ নিয়ন্ত্রণ করে। তারা ওই রাস্টিক/গ্রাম্য ছেলেমেয়েগুলোকে হলে সিট দেওয়ার বিনিময়ে মিছিলে যেতে বাধ্য করে। ছাত্রলীগ করতে বাধ্য করে। আমি নিজেও হলে থাকার কারণে ছাত্রলীগের বহু মিছিলে যেতে বাধ্য হয়েছি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অশ্লীল নেতা-নেত্রীদের নামে উৎকট শ্লোগান ধরতে বাধ্য হয়েছি। বমি আসলেও। আমার বিবেচনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ করা বেশিরভাগ রিক্রুট এ গ্রুপ থেকে আসে।
দ্বিতীয় গ্রুপটি একটু বেশি ধুরন্ধর, ক্যারিয়ার-কেন্দ্রিক। তারা জানে ছাত্রলীগ করলে সরকারি চাকুরি-বাকুরি পাওয়া, টেন্ডারবাজি করে পয়সা কামানো, হলে ফাও খাওয়া, এমনকি ক্যাম্পাসে চুরি-ছিনতাইয়েরও লাইসেন্স পাওয়া যায় (অবিশ্বাস হলে পত্রিকার পুরনো সংখ্যা উল্টে দেখেন ক্যাম্পাসে ছিনতাইয়ের দায়ে ছাত্রলীগ কর্মী আটকের খবর)। এরা তাদের স্বার্থ হাসিলে ছাত্রলীগ করে এবং বেশিরভাগ তাদের স্বার্থ হাসিল করেও নেয়।

তৃতীয় গ্রুপটি একটু ভিন্ন। কিছু শিক্ষার্থী আদর্শিক কারণেও ছাত্রলীগ করে। তবে তারা সংখ্যায় নিতান্তই কম। এরা কেউ পৈতৃকসূত্রে আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগ করে/করতে চায়, কেউ তাদের নেতা-নেত্রীদের সত্যিকার ভালোবেসে ছাত্রলীগ করে। আমার বিবেচনায় ছাত্রদলের সাথে ছাত্রলীগের পার্থক্য এই তৃতীয় গ্রুপটি। ছাত্রলীগের মধ্যে যদিও এই তৃতীয় গ্রুপটি একেবারেই হাতে গোনা, ছাত্রদলের মধ্যে এ সংখ্যা আরো কম। অন্যদিকে বাম বা ডানপন্থী ছাত্রসংগঠন গুলোতে এই তৃতীয় গ্রুপটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ।

উপসংহার কী দাড়ালো? আবরার একটি সংঘটিত রাজনৈতিক অপরাধের বলি। এটি আর দশটি সামাজিক অপরাধের মতো নয়। এটি সাধারণ খুন নয় যে খুনে অংশ নেওয়া কয়েকজনকে যাবজ্জীবন বা ফাঁসি দিয়ে দিলেই খুনটির প্রকৃত বিচার করা হয়ে যাবে।

যারা বলছেন ও ভাবছেন যে আবরারের হত্যাকাণ্ড আর দশটা সামাজিক অপরাধের মতোই একটা অপরাধ এবং খুনীদের ধরে বিচার করলেই এটি বন্ধ হবে বা কমে যাবে তাদেরকে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হবে। এটি যেহেতু একটি সংগঠিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, এর সমস্যাটি কাঠামোগত, গভীরে ব্যাপৃত। এজন্যই এটিকে সাধারণ খুন বলে চালিয়ে দেওয়া, ‘জননী‘র দাবি নিয়ে বিচার করতে চাওয়া আসলে মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো। আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রথম দায় ছাত্রলীগের। দ্বিতীয় এবং মূল দায় আওয়ামী লীগের, তাদের শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের, এবং যারা এই কাঠামোর মধ্যে অপারেট করে তাদের সবার।

পরিশেষে যারা আবরা হত্যার বিচার চান এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়াতে চান, তাদের সকলের উদ্দেশ্যে দু‘টি প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই:

১। এ ধরনের খুন বন্ধ করার জন্য যে রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রয়োজন তা কি আছে?

২। আওয়ামী লীগ কি বলবে যে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার পাহারাদার দরকার নাই? (ছাত্রলীগ অবশ্যই থাকতে পারে, তবে সেটি শিক্ষার্থীদের সংগঠন হিসেবে, কোনো অবৈধ শাসকের পাহারাদার হয়ে নয়)

উপরের উত্তরগুলো যদি না হয়, সেটি হবে শিক্ষাঙ্গণে খুন-রাহাজানি বন্ধে সমাধানের পথে প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু উপরের প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে ছাত্রলীগের ‘জননী‘র মতো মিথ্য আবেগ দিয়ে আবরারের খুনকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, একটি সামাজিক অপরাধ গণ্য করে এই খুনের বিচার ও সমাধান চান তা এ ধরনের অপরাধকে নিবৃত্ত করবে না। জনরোষ এড়াতে শাসকরা হয়তো এ ধরনের ঘটনার সাময়িক লাগাম টানতে পারে, কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতা টিকে থাকলে ছাত্রলীগ খুন করবেই, সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতন করবেই – কারণ এটিই তাদের অস্তিত্বের সম্পূরক, তাদের মূল কাজ, টিকে থাকার মন্ত্র (raison d’etre)।

ছাত্রলীগ খুন, নির্যাতন না করলে শিক্ষাঙ্গণগুলোতে অবৈধ রেজিমের পাহারাদারিত্ব নিশ্চিত করা যাবে?

এটুকু বুঝে থাকলে গোড়ায় হাত দেন। ক্ষমতার প্রশ্নটি নিষ্পত্তি করুন। কারণ সেটি অনিষ্পন্ন রেখে বাকী সব বাকোয়াজ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান