৩০ ডিসেম্বর ২০১৮: বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও একটি দলের অপমৃত্যু

৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে অনেকটা প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতিকে জায়েজ করতে এক শ্রেণির সরকার সমর্থক ইনিয়ে-বিনিয়ে এটা বলার চেষ্টা করেন যে জামাত, কিংবা বিএনপি তাদের চরিত্রগত কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য বিষফোঁড়া এবং জার্মানীর নাৎসীদের মতো তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে না পারলেও কঠিন করে দিতে হবে, যাতে তারা আর কোনোদিন ক্ষমতার স্বাদ না পায়। এই যুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে হাজারো যুক্তি-পাল্টা যুক্তি রয়েছে। তথাপি, তর্কের খাতিরে সরকারি সমর্থক গোষ্ঠীর বক্তব্য যদি কেউ মেনে নিয়েও থাকে, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সামনে উত্তম রাজনৈতিক বিকল্প কি ছিলো? বিএনপি-জামাত-কে শায়েস্তা করা? না-কি জনগণের বিরুদ্ধে দাড়ানো? যেকোনো বুদ্ধিমান লোকই প্রথম উত্তরটি বেছে নিবে। বিএনপি-জামাতের রাজনীতি যদি আওয়ামী লীগের জন্য অসহনীয় বা আপত্তিকর হয়েই থাকে (ধরে নিলাম সঙ্গত কারণেই), সেক্ষেত্রে দলটির জন্য যৌক্তিক পদক্ষেপ হতো বিএনপি কিংবা জামাতকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া বা নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা। এবং সে কাজের জন্য যতরকম আইনী বা অন্যান্য বাধা-বিপত্তি থাকে সেগুলো অনুসরণ করে তাদের কেউ যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে না পারে সে ব্যবস্থা করা। সরকারি দলের ইশারায় যেখানে সবকিছু হচ্ছে, সেখানে তারা একাজটি খুব সহজেই করতে পারতো। নিদেনপক্ষে তারা যেটি করেছে তার তুলনায় এটি বহুগুণে বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ হতো।

একটা পক্ষকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে তারা যে দল বা গোষ্ঠী বা পক্ষকে তাদের জন্য ‘নিরাপদ‘ মনে করে (সেটি সিপিবি কিংবা চরমোনাই পীর, কিংবা হেফাজত – যারাই হোক না কেন) তাদের জন্য নির্বাচনী মাঠ উন্মুক্ত করে দিতে পারতো এবং নির্বাচনের দিন জনগণকে এই নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে টিকে থাকা প্রার্থীদের মধ্য থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দানের সুযোগ করে দিতো। এতে জনগণের একটা অংশ অবশ্যই অসন্তুষ্ট হতো, কিন্তু সে অসন্তুষ্টি থাকতো প্রক্রিয়া নিয়ে, তাদের ভোটাধিকার প্রদানের সুযোগ নিয়ে নয়। এটি হতে পারতো শাসক দলের এক প্রকার ড্যামেজ কন্ট্রোল। লড়াইটা সীমাবদ্ধ থাকতো শাসকদল আওয়ামী লীগ ও বিরোধীপক্ষ বিএনপি-জামাত-এর মধ্যে। এই লড়াইয়ে হয় শাসক দল বিরোধী পক্ষকে কুপোকাত করে ইরানীয় স্টাইলে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু করতো যেখানে প্রার্থী বাছাইয়ে শাসক দলের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগটি অবারিত থাকতো এবং জনগণ উপলভ্য পছন্দগুলোর মধ্য থেকেও মন্দের ভালো কাউকে বেছে নেওয়ার একটা সুযোগ বা সান্ত্বনা পেতো। অথবা বিরোধী পক্ষ জনগণের একটা অংশকে সংগঠিত করে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে এই উদ্যোগ রুখে দিতে সফল হতো — অথবা ব্যর্থ হতো।

কিন্তু শাসক দল আওয়ামী লীগ যেটি করেছে সেটি অবিশ্বাস্য, নজিরবিহীন। নজিরবিহীন এই জন্য নয় যে তারা বিএনপি-জামাত-কে ১০টি আসনও দেয়নি বা একেবারে কাবু করে দিয়েছে, বরং এজন্য নজিরবিহীন যে আওয়ামী লীগ নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে। এবং সবচেয়ে বড় কুড়ালটিই মেরেছে। প্রকাশ্যে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রকারান্তরে বিএনপি-জামাতের যতটা না ক্ষতি করেছে তারচেয়ে বড় ক্ষতি করে দিয়েছে নিজেদের। তারা জনগণের কাছ থেকে দেশের মালিকানা ছিনতাই করার অভিযোগে অভিযুক্ত হলো। যে দল মানুষের অধিকার আদায়ের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব করতো, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় তারা তাদের প্রায় ৭০ বছরের রাজনৈতিক অর্জনকে প্রায় ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান বা জেনারেল এরশাদের সাথে নন-জেনারেল প্রধানমন্ত্রীর কোনো তফাৎ তো নেই-ই, বরং আয়রন লেডির ঘাড়ে গুম, ৫০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট এবং তার সাথে জনগণের ভোটাধিকার হরণের ভারী বোঝা! নজিরবিহীনভাবে জবরদস্তিমূলক ভোট ডাকাতির মাধ্যমে দলটি একপ্রকার জনগণের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে দাড়িয়ে গেছে। তারা নির্বোধের মতো ভাবছে যে এতে তারা বিএনপি-জামাত-কে বিরাট শায়েস্তা করে ফেলেছে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে – ৩০ ডিসেম্বরের কলংকিত নির্বাচনটি কেবল বিএনপি-জামাত কিংবা ঐক্যফ্রন্টই প্রত্যাখ্যান করেনি, বরং সরকারি জোটের বাইরে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রতিটি দল ও জোট (বাম জোট, ইসলামি শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ অন্য প্রায় সবাই) এই নির্বাচনকে ভোট ডাকাতি, রাতের ভোটের নির্বাচন বলেছে। এই নির্বাচনের ফলে শাসক দল যে বৈধতার সংকটে পড়লো তার জন্য দলটিকে কতটা চড়া মূল্য গুণতে হয় সেটি সময়ই বলে দিবে – আমি অশনিসংকেত দেখি। আমার বাবা-চাচাদের মতো বঙ্গবন্ধুর বহু সহকর্মী যারা দলটিকে হাতে ধরে গড়ে তুলেছেন, ধারণ করেছেন নিজেদের হৃদয়ে — ৭০ বছর বয়সী ঐতিহ্যবাহী দলটির এই করুণ পরিণতি তাদেরকে বাকরুদ্ধ করেছে, তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ করেছে।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নির্বাচন হলো বিজয়ী যেকোনো দলের জন্য একটি রক্ষাকবচ। নির্বাচন-উদ্ভূত বৈধতার ফলে শাসক দল শত ঝড়-ঝঞ্জার মুখেও একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিশ্চিন্ত থাকে যে তারা একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছে এবং এ সময়ের মধ্যে অগতান্ত্রিক কিছুর চেষ্টা হলে বেশিরভাগ জনগণ তাদের পক্ষে থাকার কথা। কিন্তু জালিয়াতির নির্বাচন বা জনগণের ম্যান্ডেট-বিহীন কোনো সরকারের জন্য এই রক্ষাকবচটি থাকে না। তাদের প্রতিটি দিন, মুহূর্ত কাটে ভয়ে, শংকায় যে কখন কোন দিক থেকে কি হয়। তাদের এই অনিশ্চয়তা, ভয় ও শংকার ফলে তারা সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকে। ক্রমান্বয়ে তাদের এই ভয় তারা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। তারা ভয় দিয়ে শাসন করতে চায়। একটি প্রাণহীন পাতা ঝরে পড়ার শব্দেও তাদের মসনদ টলে ওঠে। এই ভয় থেকেই দেশে-দেশে স্বৈরতন্ত্রের পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম হয় যেখানে তারা সবকিছুকে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার কাঠামোর মধ্যে না দেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হিসেবে দেখে। জোর করে দমিয়ে দিতে চায়। এই ভয় থেকে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দানব করে তোলে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হিসেবে গড়ে তোলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি আগেও একাধিকবার এসেছে যখন শাসকদের পতনে সিংহভাগ জনতা আফসোস করেনি বরং উল্লাস করেছে। বর্তমানটা বড্ড বেসামাল। আমি বলি এরা লাইফ সাপোর্টে আছে। একজন মানুষ লাইফ সাপোর্টে দুই দিনও বাঁচতে পারে ১০ বছরও। কিন্তু দিনশেষে এটি একটি জিন্দালাশ। শেষের ক্ষণ গোণা মাত্র।

যেহেতু জনগণ এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ হারায়, সেহেতু লড়াইটা আর জনগণের মধ্যেই থাকে না — বরং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নিপতিত হয়। সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কৌশলের লড়াইয়ে বড় কূটকৌশলের কাছে ছোট কৌশলীরা একদিন হেরে যাবে। বড় বন্দুকের নলের কাছে ছোট বন্দুকওয়ালারা ধরাশায়ী হবে। জনগণহীন লড়াইয়ে যা হয়।

০৬ ফেব্রয়ারি ২০১৯

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান