ঝর্ণা আক্তারের ক্রিকেট ও বোরকা: হবসিয়ান ফ্রি উইল যুক্তির ফাঁক

ছবি: ঝর্ণা আক্তার ও তাঁর ছেলে

ঝর্ণা আক্তার নামক এক ভদ্রমহিলার বোরকা পরে ক্রিকেট খেলা নিয়ে দেশব্যাপী নানা তোলপাড় ও আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এটি একদিক থেকে বেশ স্বাস্থ্যকর বিতর্ক যাতে আমাদের দেশে আইডেন্টিটি নিয়ে যে চলমান প্রশ্ন সেটির একটি আঙ্গিক চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

বিষয়টা নিয়ে নানামতের মানুষের সাথেই গত দুদিন আলাপ করার সুযোগে পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিগুলো নিয়ে চিন্তা করার, ভাবার সুযোগ পেয়েছি। আমার অভিজ্ঞতাটা মজার এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।

এই পর্বে চলুন দেখা যাক যারা বোরকা পরাটাকেই সমস্যা মনে করছেন তাদের পক্ষের যুক্তিগুলো কী কী কিংবা এসব যুক্তির সম্ভাব্য ফাঁকগুলোইবা কী সেটি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

এই মতাবলম্বী এক উকিল সাহেবের সাথে গতকাল ফেসবুকের একটি ছোট বিতর্কে তিনি দাবি করেছেন ধর্ম মানলে নাকি মানুষ স্বাধীন থাকে না – অর্থাৎ তার যুক্তি হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসনের জন্যই যদি মানুষ বোরকা পরে তাহলে তিনি আর স্বাধীন মানুষ নন। এবং কেউ একজন ধর্ম মানলে তিনি তার সিদ্ধান্ত কি নিয়েছেন না নিয়েছেন সেটি নাকি আর মূখ্য নয়! এবং তিনি আরেকটি দাবি করেছেন যে পৃথিবীর সকল বোরকা পরা নারীই অনিচ্ছাকৃতভাবে বোরকা পরতে বাধ্য হয় — ধর্মের কারণে নতুবা পুরুষতন্ত্রের কারণে। তো আমি তাকে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করেছি যে তার এই যুক্তি দুটো কেন অতি সরলীকরণ দোষে দুষ্ট হবে না। এছাড়া আমার বিবেচনায় উভয় যুক্তির রিজনিংই দর্শনের বিচারে দুর্বল। চলুন দেখা যাক।

সরলীকরণের প্রশ্নে আমি তাকে বলেছি যে, আপনি পৃথিবীর বোরকা পরা সকল নারীর সাথে কথা বলেন নি, কিন্তু দাবি করছেন ”কোন নারীই নিজের ইচ্ছায় বোরকা পরে না”। তিনি যেহেতু বাস্তবিক কারণেই পৃথিবীর সকল নারীর সাথে কথা বলা সম্ভব নয়, সুতরাং তার অনুসিদ্ধান্তটিকে আমি তার ”নিজস্ব পর্যবেক্ষণজাত” বলেছি এবং সেটি যে হিউম-এর ”প্রবলেম অব ইনডাকশন” দোষে দুষ্ট সেটি তাকে জানিয়েছি। কিন্তু তিনি অনড়। আমি বলেছি যে তিনি যাদের সাথে কথা বলেন নি তাদেরও পছন্দকে তিনি নিজের পর্যবেক্ষণের সাথে মিলিয়ে ফেলে যে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছেন সেটি বৈজ্ঞানিক অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নয়।

নারীদের ”স্বাধীন ইচ্ছা” নিয়ে উনার একটা অবস্থান আছে এবং তিনি উইমেন চ্যাপ্টারে এটা নিয়ে একটা লেখাও লিখেছেন। তো তার এ অবস্থানটি বেশ মজার। এটি অনেকটা হবসিয়ান ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছা তত্ত্বের মতো। তিনি জেনে বা না জেনে এই হবসিয়ান ফিলোসফির ফাঁদে পড়েছেন। এই যুক্তির ফাঁক হলো মানুষ শর্তহীনভাবে সম্পূর্ণ ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিবে এ ধরনের অনুমান করা। আমার দাবি এ অবস্থানটিই একটি ইলিউশন এবং বাস্তবে এমনটি হবার নয় কিংবা হয়ও না। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে মানুষ ধর্মের শর্তের নিকট তার স্বাধীন ইচ্ছাকে সমর্পণ করলে সেটি ব্যক্তি স্বাধীনতার লঙ্ঘন হয়। কিন্তু এ যুক্তিটি ডাবল-এজ্ড সোর্ড। এর ফাঁকে উনি নিজেই পড়বেন। কারণ একজন উকিল হিসেবে তিনি নিজেই যেভাবে জাগতিক (সংবিধান ও আইনের) শর্ত মেনে ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রার গরমে এয়ার কন্ডিশন ছাড়া বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে গিজগিজ করা মানুষের ভিড়ে পোশাকের উপর কালো গাউন পরে ঘর্মাক্ত হন, এবং তারই মতো মর্ত্যলোকের একজন মানুষকে “মাই লর্ড” বলে নিজের স্বাধীন ইচ্ছাকে সমর্পণ করেন – সেটিও আদতে কোন স্বাধীন ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ নয়। গরমের দিনে ঘর্মাক্ত হয়ে ওই কালো গাউন কেউ স্বেচ্ছায় পরে?

সুতরাং মানুষ সবসময় ফ্রি উইলে সিদ্ধান্ত নেয় এ ধরনের হবসিয়ান চিন্তা যারা করেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলছি যে, আপনি ও আমি ধর্ম, অধর্ম, বিধান ও সংবিধান, নানা কিছুর নিকট আমাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে বন্দী রেখেছি। কেবল মুসলমান নারী বোরকা পরলেই তার ব্যক্তি স্বাধীনতা চলে গেলো আর আপনি আদালতে অনিচ্ছায় কালো গাউন পরলে আপনার স্বাধীনতা ঠিক থাকলো এ ধরনের দ্বিচারিতা হয় চিন্তার সীমাবদ্ধতা (নাইভিটি) অথবা ভণ্ডামি।

একজন উকিল যেমন টাকা কামানোর জন্য তার ব্যক্তি স্বাধীনতার সাথে আপোষ করে সুপ্রীম কোর্টে গরমে কালো গাউন পরে সিদ্ধ হয় এবং রক্তমাংশের আরেকজন ব্যক্তিকে (যিনি অনেক সময় তার চেয়ে কম যোগ্য) “মাই লর্ড” বলে মাথা নোয়ান, তেমনি একজন মুসলমান নারী আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ইহকাল ও পরকালে পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় গরমের মধ্যেও বোরকা পরতে পারে, প্রার্থনার জন্য মাথা নোয়াতে পারে। কোনোটিই দোষের নয়। আপনার নিজস্ব পছন্দ কিনা সেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হওয়ার কথা। কিন্তু আপনার অপন্দনীয় কিছুকে আরেকজন পছন্দ করলে সে স্বাধীন চিন্তা করছেন না এ ধরনের চিন্তা সমস্যাপূর্ণ। আপনাদের সমস্যা আপনারা দ্বিতীয়টি দেখেন কিন্তু প্রথমটি দেখেন না।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান