সীমানার বড়াই, নকল রাষ্ট্র ও জনগণের অধিকারহীনতা

Source: Wikipedia

[খবর: গোয়াইনঘাট সীমান্তে গুলিতে আবার বাংলাদেশি নিহত
https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1666534/গোয়াইনঘাট-সীমান্তে-গুলিতে-আবার-বাংলাদেশি-নিহত/]

“বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আহমেদ ইউসুফ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তে অবৈধ চলাচল রোধে করোনা–পরিস্থিতির মধ্যেও টহল ও নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় সীমান্তবর্তী এলাকার বাংলাদেশি নাগরিকদের অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ না করার জন্য বারবার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। এ কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা এড়ানো যাচ্ছে না।”

এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোন কর্মচারির ভাষা হতে পারে না। জনগণের কর্মচারি, রক্ষাকারী হিসেবে জনগণকে রক্ষা করতে পারার ব্যর্থতা নিয়ে এরা লজ্জিত হয় না, কৈফিয়ত দেয় না, বরং তাদের হত্যাকাণ্ডকে যৌক্তিকীকরণ করে, সাফাই গায়। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত প্রায় ৫০ বছর বয়সী একটি রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে লজ্জাকর আর কিছু হতে পারে না। দুনিয়ার কোন দেশে সীমান্তে অনুপ্রবেশের দায়ে এভাবে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয় না – ইসরায়েল ছাড়া।

এমনকি আধুনিক রাষ্ট্রের তথাকথিত নিরাপত্তার বিবেচনায়, যদি কোনো দেশের সীমানা দিয়ে কেউ “অবৈধ অনুপ্রবেশ” করেও থাকে, তাকে প্রথমে অহিংস উপায়ে আটক করার চেষ্টা করতে হবে। তবে আটকের ক্ষেত্রে সীমান্ত চৌকিদারদের জীবনের ঝুঁকি থাকলে বল প্রয়োগের বিধান রয়েছে তবে সেটিতেও জীবন সংহারী উপায়ে নয় যদি না অনুপ্রবেশকারী সশ্রস্ত্র হয় এবং আটককারীর জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়। কিন্তু এই যে আমাদের তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র অপর বন্ধু রাষ্ট্রের নিরস্ত্র, জীবিকার দায়ে সীমান্ত পার হওয়া জনগণকে দিনে-রাতে গুলি করে লাশ উপহার দেয়, এমন বন্ধুত্ব দিয়ে জাতি কী করবে?

আমেরিকা-মেক্সিকো বর্ডারে অনুপ্রবেশের দায়ে এভাবে গুলি করলে দৈনিক কয়েক শ লাশ পড়বে। আমেরিকার কি বন্দুক নাই, নাকি তাদের বন্দুক ভারতের বন্দুকের চেয়ে কম শক্তিশালী? আসল কথা হচ্ছে, ভারতীয় সরকারের কাছে বন্ধু বাংলাদেশী মানুষের জীবনের দুই পয়সা দাম নাই এবং তারা যে সুযোগ পেলেই এদেশের মানুষকে খুন করবে সেটি প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে যায়। ভাবতে অবাক লাগে, এই একই ভারত রাষ্ট্র ১৯৭১ সালে আমাদের বাঁচার সংগ্রামে সহযাত্রী ছিলো। উদ্দেশ্য যাই হোক, তাদের সহায়তা ছাড়া আমাদের সংগ্রাম কঠিনতর হতো। কিন্তু বর্তমান ভারত রাষ্ট্র হেজিমোনিক, বন্ধুর-প্রতিবেশির রক্তের নেশায় আচ্ছন্ন – ঘরে ও বাইরে সবখানে। ভারতীয় দখলদার বাহিনী কাশ্মীরে গত দু’মাসে শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। ১৯৭১ সালে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে লিপ্ত বাঙালিকে সহায়তা আর ২০২০ সালে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করা কাশ্মীরিদের হত্যা করা যেন একই ভারতের দুই রূপ। কোনটি আসল চেনাই দায়।

একজন নিরস্ত্র মানুষ পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সীমানা পার হলে খুন হতে হবে এমনটা জানলে সীমান্তের ধারণার আদি চিন্তকরা কোনোদিন সীমান্ত তৈরির প্রশ্নটিই তুলতেন কিনা কে জানে। আগে রাজ্য ছিলো, সাম্রাজ্য ছিলো, সেগুলোর সীমা-পরিসীমাও ছিলো। কিন্তু মানুষের চলাচলের কোন সীমানা ছিলো না, কোনো পাসপোর্ট-ভিসা ছিলো না। এই নিয়ন্ত্রিত সীমানার ধারণাই তৈরি হয়েছে মাত্র কয়েক শ বছর হলো। তথাকথিত ভারতীয় সীমানার বয়স তো আরো কম – মাত্র ৭০ বছর। অথচ মানুষের অভিবাসনের, সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস হাজার বছরের। মানুষের হাজার বছরের ইতিহাসে মানুষ কি সীমান্ত মেনে, পাসপোর্ট-ভিসা করে দেশ-দেশান্তরী হয়েছে? অভিবাসন গড়েছে? আর্য-অনার্য-দ্রাবিড়দের মিশ্রণ হয়েছে? এখন আমরা আধুনিক হয়েছি, রাষ্ট্র তৈরি করেছি, সীমানা তৈরি করেছি, এবং ছোট লোকের মতো সেখানে কাঁটাতারের বেড়া, দেয়াল নির্মাণ করছি। এই নিয়ন্ত্রিত, পাহারা দেওয়া সীমানা তৈরির পিছনে প্রধান যুক্তি ছিলো মানুষ থেকে মানুষের নিরাপত্তা বিধান। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের আদিম সহিংস প্রবৃত্তি থেকে এক জনগোষ্ঠী থেকে অপর জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা।

কিন্তু গত একশ বছর ধরে বৈধ-অবৈধ পন্থায়, বল-প্রয়োগের মাধ্যমে, কিংবা কলোনিয়াল ধাত্রীগিরিতে এমন বহু রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে যেগুলো এমনকি রাষ্ট্রের আধুনিক ধারণার সাথেই অসঙ্গতিপূর্ণ। জোর-জবরদস্তি করে বহু মানুষকে বলা হয়েছে তোমরা এই সীমানার অংশ। কাশ্মীরে হয়েছে, উত্তর ভারতে হয়েছে, দক্ষিণে হয়েছে, বালুচিস্তানে, পাঞ্জাবে হয়েছে, বাংলায় হয়েছে, প্যালেস্টাইনে হয়েছে, হিজাজে হয়েছে, কুর্দিস্তানে হয়েছে। এভাবে সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষের উপর জোরপূর্বক সীমানা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। নকল রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে ভুরিভুরি। কখনো বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিকদের দ্বারা, কখনো শক্তিপ্রয়োগে, কখনো ছল-চাতুরি করে। তাতে মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো না, ছিলো ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিক, এলিট, বিশ্বাসঘাতকদের অংশগ্রহণ। সম্পূর্ণ স্বেচ্চাচারি প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতার সমীকরণে বিভিন্ন “জনগোষ্ঠী”-কে একটি সীমান্তের জেলখানায় বন্দী করে ফেলা হয়েছে এবং সেই জেলখানাটি রক্ষা করতে বন্দুকওয়ালাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এভাবে বহু রাষ্ট্র মূলত মানুষকে ক্ষমতাহীন, অধিকারহীন করার প্রকল্প বৈ আর কিছু নয়। এসব রাষ্ট্র আগামী একশ বছরে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। মানুষের সংগ্রামে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আমাদের উপমহাদেশের বড় রাষ্ট্রটিও এই প্রক্রিয়াতেই গড়ে উঠেছে। বাকী রাষ্ট্রগুলোও কমবেশি তাই। এ অঞ্চলে গণমানুষের সংগ্রামে গড়ে উঠা জন-আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র বোধহয় একটিই – বাংলাদেশ। কিন্তু সে রাষ্ট্রটিই আমরা টিকিয়ে রাখতে পারবো কিনা সে গুরুতর প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। আবারো সেই রাজনীতিকদের বিশ্বাসঘাতকতায়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান