
প্রারম্ভিক কথা
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ সাপেক্ষে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং তদানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীও নির্বাচিত হইবার যোগ্যতা রাখেন। সুতরাং বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক নিজেকে নকল/ভাবী প্রধানমন্ত্রী গণ্য করিয়া রাষ্ট্রে কী কী সংস্কার চান সেটি নিঃসঙ্কোচে বলার সংস্কৃতি চালু করিবার মানসে “আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে যাহা করিতাম” এই সিরিজ শুরু করিয়াছি। নির্ধারিত বিরতির পর-পর আমি কিছু কর্তব্য-কাজ এ লেখাটিতে যুক্ত করিবো। বাংলাদেশের মানুষকেও আমি এই ভাবে “ভাবী প্রধানমন্ত্রী” হিসাবে তাহাদের আশু করণীয় শেয়ার করিবার আহ্বান জানাই। আমি আমার আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাব্য কর্মসূচিগুলি তুলিয়া ধরিবো, আপনারাও আপনাদের এজেন্ডা তুলিয়া ধরেন। মানুষের মনোজগতে একটু হইলেও ধাক্কা দিতে হইবে যে এই দেশটা কোনো পরিবারের, ব্যক্তির, বা তাহার বাবার না। আপনারও। আপনিও দেশটাকে নিয়া স্বপ্ন দেখিতে পারেন। আপনার মতো করিয়া বদলাইয়া দিবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিতে পারেন।
“আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে যাহা করিতাম”: পর্ব-১
কর্তব্য ১:
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাৎসরিক বাজেট প্রায় ৩৮০০ কোটি টাকা, অর্থাৎ দিনে ১০ কোটি এবং মাসে প্রায় ৩০০ কোটির টাকারও বেশি!! যেখানে দেশের ৪০ ভাগের বেশি মানুষের দৈনিক গড় আয় ২৫০ টাকার নিচে এই রকম একটি গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী হইয়া আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে আমার পিছনে জনগণের বাৎসরিক ব্যায় ১২ কোটি টাকা বা তারও কমে নামাইয়া আনিবো। জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া আমার জন্য কোন “বিশেষ কার্যালয়” থাকিবে না। আমি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নাম করিয়া মাসে ৩১৯ কোটি টাকা খরচ করিবো না। আমি সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত অফিসে অফিস করিবো। আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে আমার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত খরচ ১ লক্ষ টাকা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাবতীয় মাসিক খরচ ১ কোটি টাকাও যাতে অতিক্রম না করে সে ব্যাপারে সচেষ্ট হইবো। আমি প্রতি মাসে আমার ব্যক্তিগত ও স্টাফদের খরচের তালিকা জনগণের জ্ঞাতার্থে সচিবালয়ের প্রধান ফটকে ঝুলাইয়া দিবো এবং দেশের বড় দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় খরচের বিস্তারিত তুলিয়া ধরিবো।
কর্তব্য ২:
রাষ্ট্রীয় সম্পদের চুরি ও দুর্নীতি রোধে জনগণের সম্পদ লুটের দায় প্রমাণিত হইলে যাবজ্জীবন কারদণ্ডের বিধান রাখিয়া একটি আইন প্রণয়নের প্রস্তাব উত্থাপন করিবো। জনগণের সম্পদ চুরিকে জঘন্য অপরাধ গণ্য করিয়া ১০০ দিনের মধ্যে বিচারের আইন করিতে সচেষ্ট হইবো। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে বিচার বিভাগসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত যেকোনো কর্মচারি দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের দায়ে জড়িত হইলেও একই বিধান করিবো। অর্থাৎ জনগণের কর্মে নিয়োজিত রাষ্ট্রের সকল কর্মচারি (রাজনীতিক, আমলা, বিচারবিভাগরে সকল কর্মচারি (বিচারপতিসহ)) জনগণের সম্পদ তছরুফ ও লুণ্ঠনের সাথে জড়িত প্রমাণিত হইলে যাবজ্জীবন সাজার ব্যবস্থা রাখিয়া আইন প্রণয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করিবো। ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিচারপতিগণ যাহাতে সর্বোচ্চ সততা ও পেশাদারিত্বের সাথে বিচারকার্য পরিচালনা করিতে পারেন তাহার জন্য রাষ্ট্রের বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে “ন্যায়বিচার ন্যায়পাল পর্ষদ” গঠন করিবো।
কর্তব্য ৩:
সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে যেসব সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে (যেমন- মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, তথ্য কমিশন, সিএন্ডএজি কার্যালয়, ন্যায়পাল প্রভৃতি) সেগুলোতে অবসরপ্রাপ্ত আমলা নিয়োগের বিধান আইনীভাবে রহিত করিবো। এগুলোতে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আবেদন করিতে হইবে না। বরং সরকার যোগ্য ব্যক্তিদেরকে একটি পদ্ধতির মধ্য দিয়া এবং জনগণের সস্মতি সাপেক্ষে নিযুক্ত করিবে। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য প্রথমে একটি সার্চ প্যানেল গঠন করিবো এবং সার্চ প্যানেলের সদস্য কারা হইতে পারে তাহাদের নাম সুপারিশ করিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি, সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবি, মূলধারার সকল রাজনৈতিক দলের প্রধানদের নিকট একটি প্রশ্নপত্র পাঠাইবো এবং তাহাদের মনোনয়নের ভিত্তিতে অনধিক ১০ সদস্যের একটি সার্চ প্যানেল গঠন করিবো। এই সার্চ প্যানেলের সদস্যরা হইবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবি, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, এবং বিশিষ্ট আইনজীবিগণ। সার্চ প্যানেলের কার্যপরিধি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইবে এবং এই প্যানেলের সকল সভা বেতার এবং টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হইবে। প্যানেলের সদস্যরা কিছু সূচক তৈরি করিবেন এবং সেসব সূচকের উপর জনগণের উন্মুক্ত মতামত আহ্বান করিবেন (ওয়েবসাইটের মাধ্যমে)। সকল মতামত চূড়ান্ত বিচার-বিশ্লেষণের পর সার্চ প্যানেল প্রকাশ্যে, টিভিতে সরাসরি নিয়োগের সূচকগুলো তুলিয়া ধরিবেন এবং দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য হইতে প্রতিটি পদের বিপরীতে ৩টি করিয়া নাম সুপারিশ করিবেন। সকল প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হইবে। সার্চ প্যানেলের সুপারিশকৃত তিনটি নাম জনগণের সম্মতির জন্য গণভোটে প্রদান করা হইবে এবং জনগণ তাহাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করিবার মাধ্যমে এই সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান সরাসরি নির্বাচন করিবেন। এই উপায়ে আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল ও দায়বদ্ধ একটি সরকার কাঠামো গড়িয়া তুলিবো। আমার প্রতি আনুগত্য নয় বরং দেশের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি, জনগণের প্রতি আনুগত্যকে সর্বাগ্রে রাখিয়া একটি জনমূখী সরকার ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিবো।
কর্তব্য ৪:
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সকল স্তরে আইনবিভাগ, বিচার, ও নির্বাহী) আমার পরিবারের যেকোনো পর্যায়ের কাহারো নিয়োগ নিষিদ্ধ করিবো। তাহারা দেশের বাকী সাধারণ নাগরিকদের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি-বাকুরি করিবেন, কিন্তু স্বার্থের দ্বন্ধ তৈরি হয় এর বিন্দুমাত্র সুযোগ কাহাকেও দেওয়া হইবে না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কয়েক-ডজন আত্মীয় স্বজন যেভাবে সরকার ও দলে আসীন হইয়া একটা বিশাল পরিবারতন্ত্র কায়েম করিয়াছে, আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে একজনও এ ধরনের সুযোগ পাইবে না। কেবল আমার আত্মীয়-স্বজনদের অপকর্ম বা দুর্নীতির সুযোগ রহিত করিতে আমি আমার ব্যক্তিগত খরচে একটি ছোট্ট অফিস নির্বাহ করিবো যাহাতে নিয়োজিতদের কাজ হইবে সার্বক্ষণিক হটলাইন চালু রাখিয়া এ ধরনের যেকোনো অভিযোগ গ্রহণ করা। প্রতিমাসে এ ধরনের পাওয়া সকল অভিযোগের তালিকা ও নিষ্পত্তি একটি উন্মুক্ত ও সরাসরি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশের জনগণকে জানানো হইবে।
“আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে যাহা করিতাম”: পর্ব-২
কর্তব্য ৫:
আমি বাজেট প্রণয়নের জন্য দেশসেরা অর্থনীতিবিদদের ১০ সদস্যের সমন্বয়ে একটি বাজেট প্রণয়ন কমিটি গঠন করিতাম। বর্তমানের মতো এটি সচিবালয়ের আমলাদের রুটিন কাজে পরিণত করিতাম না। হ্যাঁ, আমলাদের সম্পৃক্ততা অবশ্যই জরুরি এবং তাহারা সম্পৃক্তও থাকিবেন, কিন্তু সেটি হইবে তাহারা যেভাবে সম্পৃক্ত থাকিবার কথা ঠিক সেইভাবে – অর্থাৎ তাহাদের কাজ হইবে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করা, প্রয়োজন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যোগান দেওয়া। দেশের পরিকল্পনার সাথে যুক্ত থাকিবেন দেশ সেরা বিশেষজ্ঞ, গবেষকগণ। আমলাদের কাজ হইবে তাহাদের কাজে সহযোগিতা করা। বিশেষজ্ঞ প্যানেল দেশের শীর্ষ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-সহ এবং সরকারি-বেসরকারি থিংকট্যাংকের বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করিয়া দেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং দেশীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বিবেচনা করিয়া বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে খাতওয়ারী কোন-কোন বিষয় উন্নয়ন অগ্রাধিকার পাইবার উপযুক্ত সেইভাবে বাজেট প্রস্তাবনা তৈয়ার করিবেন। দুঃখজনকভাবে যে কাজটি এখন আমলারা করিয়া থাকে। তাছাড়া বাজেটে রাজস্ব ও অনুন্নয়ন ব্যায়ের খাতগুলিও যৌক্তিকীকরণ, প্রয়োজনে কাটছাট করিবার যেকোনো সুপারিশকে গুরুত্বের সহকারে বিবেচনা করিতাম। তবে প্রস্তাবিত বাজেটের চুল-চেরা বিশ্লেষণ এবং জনগণের জন্য যাহা সর্বোত্তম সেইসব বিষয় জনগণের প্রতিনিধিদের মতামতের প্রতিফলন যাহাতে ঘটে সেজন্য বাজেট অনুমোদনে আমি সংসদের উপর প্রদত্ত ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করিতাম। ইহা করিবার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোকে সত্যিকার অর্থে, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাজেট পর্যালোচনা এবং বিস্তারিত সুপারিশ প্রণয়নের আহ্বান জানাইতাম। তাহারা যাতে সার্বিক দিক বিবেচনা করিয়া বাজেটের খাতওয়ারী সুপারিশ করিতে পারে সেজন্য তাহাদেরকে সংশ্লিষ্ট সুপারিশের প্রাক্কলিত ব্যয় এবং সেগুলো বাস্তবায়নে আয়ের উৎস সম্পর্কেও বিস্তারিত পরিকল্পনা তুলে ধরার আহ্বান জানাইতাম। সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন পর্যায়ে বাজেট বিশ্লেষণ এবং মতামত প্রদানের জন্য আমি একটি সমন্বিত ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করিতাম এবং সংসদীয় কমিটিগুলো নিজেরাও যাহাতে বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে পারে সে বন্দোবস্ত করিতাম যাহাতে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে জনগণের প্রতিনিধিদের সুবিবেচনা-প্রসূত দৃঢ় মতামত থাকে এবং মূলত বাজেট-বিষয়ক প্রতিটি বিচার-বিশ্লেষণ, বরাদ্দে তাহাদের মতামত প্রাধান্য পায়। বিশেষ করিয়া বিরোধী দলের সদস্যদের যেকোনো যৌক্তিক প্রস্তাব গ্রহণে আমি অগ্রাধিকার প্রদান করিবো। তবে আমার সংসদের জনপ্রতিনিধিগণ সত্যিকারের নির্বাচিত হইবেন, অনির্বাচিত কিংবা মধ্যরাতের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন কেউ সংসদে বসিবে না এবং বাজেট প্রণয়নের কাজে যুক্ত থাকিবে না। এইভাবে আমি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটিতে দেশসেরা বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাইবার সুযোগ রাখিবো পাশাপাশি তাহাতে জনগণের অভিপ্রায় সঠিকরূপে প্রতিফলিত হইবার নিমিত্তে জনপ্রতিনিধিদের বিচার-বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়া বাজেট প্রণয়ন করিবো। বর্তমানের মতো আমলাদের তৈয়ারকৃত সুটকেস বাজেট এবং রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টের নকল প্রতিনিধিদের “প্রস্তাবের পক্ষে সবসময় হ্যাঁ” বলিবার মাধ্যমে অনুমোদন গ্রহণ করিতাম না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার ভূমিকা হইতো ”ফেসিলিটেটিং দ্যা মিটিং অব দ্যা বেস্ট এন্ড বা ব্রাইটেস্ট মাইন্ডস” অর্থাৎ দেশসেরা যোগ্যতম মানুষগুলোকে তাহাদের কাজ করিবার সুযোগ করিয়া দেওয়া। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মতো “আমিই সবজান্তা সমশের”-এর ভূমিকা পালন করা নহে। আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিটি কাজে [কেবল কথায় নয়] বাস্তবে সত্যিকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য সংসদের মূল অধিবেশনের মতো সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোর প্রতিটি সেশন সরাসরি বেতার ও টেলিভিশনে সম্প্রচার করিবো যাহাতে জনগণ দেখিতে ও শুনিতে পারে তাহাদের প্রতিনিধিরা কি নিয়া, কার স্বার্থে, কেন কথা বলিতেছেন।
কর্তব্য ৬:
দেশের আমলাতন্ত্রে ল্যাটারাল এন্ট্রি নিয়া বহু অপ্রয়োজনীয় আলাপ ও বিতর্ক তৈরি করা হইয়াছে। আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে, সংসদ সদস্য হিসেবে এবং অন্যান্য সংসদ সদস্যদের সহযোগিতায়, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট সংশোধনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞদের একটা নির্দিষ্ট মেয়াদে সরকারে নিযুক্ত করিবার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করিতাম। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশে এইরকম ব্যবস্থা রহিয়াছে। আমাদের দেশেও ইহা না করিবার কারণ নাই। আমরা যদি উত্তম দেশ গড়িতে চাই তাহা হইলে দেশের সেরা মানুষগুলোকে সরকার পরিচালনায় ব্যাপক হারে অন্তর্ভুক্ত ও সম্পৃক্ত করিতে হইবে। ইহার মাধ্যমে মানুষেরও একটা ভুল ভাঙিয়া যাইবে যে সরকারি পেশাজীবি না হইয়া নির্দিষ্ট খাতে গবেষক, বিশেষজ্ঞ হইলে দেশের মানুষের জন্য কাজ করিবার সুযোগ বেশি। এতে করিয়া রাষ্ট্রীয় কাজে সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিন্তার সম্মিলন ঘটিবে এবং দেশসেরা মেধাবীরা তখন সরকারি করণিক না হইয়া আরো বেশি করিয়া বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞানী, সফল উদ্যোক্তা, বড় আইন বিশারদ হইবার চেষ্টা করিবে।
“আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে যাহা করিতাম”: পর্ব-৩
কর্তব্য ৭:
বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় সামরিক ও বেসামরিক সহযোগিতার ৫০ বছর মেয়াদি অন্তত ১০টি প্রকল্প গ্রহণ করিতাম। এসব প্রকল্পের আওতায় অ্যারোনেটিক্স, রকেট সায়েন্স, সিগনাল ইন্টেলিজেন্স, রাডার গবেষণা, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ন্যানো-টেকনোলোজি, নিউক্লিয়ার সায়েন্স প্রভৃতি বিষয়গুলো পড়ানো, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, গবেষণা, এবং ব্যাক-এন্ড ও ফ্রন্ট-এন্ডে এ বিষয়ক শিল্প তৈরি (প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশের সাথে যৌথভাবে) প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১০টি বিশেষায়িত বিজ্ঞান গবেষণা ইন্সটিটিউট তৈরি করিতাম। এই ইন্সটিটিউটগুলো সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং দেশের সেরা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যৌথ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হইবে।
দেশের শীর্ষ দশ জন সামরিক জেনারেল ও কৌশলগত চিন্তক এবং শীর্ষ দশজন প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক (যার পাঁচ জনকে নেওয়া হবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব খাতে নিয়োজিত বাংলাদেশী গবেষকদের থেকে) নেতৃত্বে অন্তত ১০টি ডুয়াল-ইউজ হাইটেক বিজ্ঞান প্রকল্প গ্রহণ করিতাম যেগুলোর বাস্তবায়নে সামরিক বাহিনী ও বুয়েটসহ আরো পাঁচটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে সামরিক গবেষণা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত করিয়া একসাথে একটি কর্মকাঠামো তৈয়ার করিয়া দিতাম। এসব বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পড়ানোর জন্য বিভাগ চালু, গবেষণা জার্নাল চালু, পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হইবে এবং সেগুলোতে দেশী-বিদেশী সেরা গবেষক ও বিজ্ঞানীদের পৃথিবীর সর্বোচ্চ বেতন কাঠামোর অনুরূপ বেতনে নিয়োগ করা হইবে (তাহাদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা বেতন কাঠামো তৈরির মাধ্যমে)। প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায়োগিক গবেষণার জন্য রাশিয়া/চীন/যুক্তরাষ্ট্র (যার কাছ থেকেই সহায়তা পাওয়া যায়) সর্বাধুনিক ল্যাব তৈরি, এই দেশগুলোর উপর্যুক্ত বিষয়ের প্রথম শ্রেণির গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যৌথ গবেষণার ও বিনিময় চুক্তি সম্পাদন করিতাম। পুরো প্রকল্পের জন্য একাধিক পর্যায়ে রাষ্ট্রের অন্তত এক বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠন করিতাম এবং শুরুতেই ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করিতাম।
এ বিষয়ক বিস্তারিত চিন্তা ও পরিকল্পনা যথাসময়ে প্রকাশ করা হইবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন ব্যতিরেকে কোন জাতির পক্ষে মাথা উঁচু করিয়া দাড়ানো সম্ভব নহে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এদেশের বামন রাজনীতিবিদগণের পক্ষে ভিশনারি হইয়া তাহাদের শাসন ক্ষমতার মেয়াদ কিংবা তাহাদের জীবদ্দশার চেয়ে বেশিদূর দেখা সম্ভব হয় নাই। কারণ এসব প্রকল্প জেনারেশনাল এবং একজন শাসক এসব প্রকল্প গ্রহণ করিলে তার জীবদ্দশায় এটির সুফল সে নাও দেখিয়া যাইতে পারে, কিন্তু পুরো জাতি এতে উপকৃত হইতো।
আমার বিবেচনায় ৫০ বছর মেয়াদি এই দশটি প্রকল্পের একাডেমিক, গবেষণা এবং ব্যাক-এন্ড ও ফ্রন্ট-এন্ড শিল্প তৈরিতে প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এক বা দুই হাজার কোটি কোটি টাকা খরচ হইবে। আমাদের দেশে বর্তমানে একজন ছাত্রলীগের জেলা পর্যায়ের নেতাও দুই হাজার কোটি টাকা লোপাট করিতেছে বলিয়া আমরা খবর পাই। সেজন্য টাকা কোন বাধা হইবার কথা নয়। সমস্যা অন্য জায়গায় – সেটি হচ্ছে দেখিবার চোখ, চিন্তার দূরদৃষ্টি, এবং সাহস।
হ্যাঁ, এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে কাজ শুরু করা মাত্রই আমাদের প্রতিবেশী মোড়ল রাষ্ট্রটির মাথা খারাপ হইয়া যাইতে পারে এবং তাহারা নানা স্যাবোটাজ ও প্রতিবন্ধকতা তৈয়ার করিতে পারে (যেমনটি তাহারা আমাদের রূপপূর পারমাণবিক প্রকল্প নিয়া করিতেছে – তাহারা এটি নিয়া এতই উদ্বিগ্ন যে এর ইন্সপেকশনে তাহাদের লোক নিযুক্ত করিয়াছে বলিয়া শোনা যাইতেছে)। সেই জন্য দেশপ্রেমিক ভিশনারি সেনা কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক খুঁজে বাহির করাটা একটা চ্যালেঞ্জ হইতে পারে – কারণ বিদ্বান যদি দুর্জন হয় এবং তাহাদের যদি দেশের প্রতি অঙ্গীকার না থাকে তাহা হইলে তাহাদের দ্বারা এ প্রকল্পে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি সাধিত হইতে পারে। সেজন্যই এই প্রকল্পের ডিজাইন ডুয়াল পারপাসের হইবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাহিরে দেশের প্রতি অঙ্গীকার সম্পন্ন সেরা ১০ জন বিজ্ঞানী ও গবেষক পাওয়া যাইবে।
পুনশ্চ: পৃথিবীজুড়েই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জটিল গবেষণার সম্মুখসারিতে থাকে সামরিক গবেষণাগার গুলো। পৃথিবীতে যে ক’টি দেশ আধুনিক প্রযুক্তির শিখরে সে ধরনের সবকটি দেশের দিকে তাকান যে তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় নেতৃত্বে রয়েছে সামরিক গবেষণা কেন্দ্রগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট (ডার্পা) একটি উদাহরণ মাত্র। একইভাবে, আপনারা ইসরায়েল, রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন, তুরস্ক এবং আমাদের প্রতিবেশী ভারতের দিকে তাকালে একটি প্যাটার্ন দেখবেন যে সামরিক বাহিনীর গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিয়েছে। হ্যাঁ, এসব গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে সেসব দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংযোগ রহিয়াছে, যাহার মাধ্যমে একই গবেষণা থেকে সিভিলিয়ান প্রযুক্তিও তাহারা বাহির করে। সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তিতে নিযুক্ত করার অন্যতম কারণ তাহাদের ডিসিপ্লিন, এবং রাষ্ট্রের কৌশলগত বিকাশে তাহাদের অংশীদারত্ব।
[চলমান…]
[…] via “আমি প্রধানমন্ত্রী হইলে যাহা করিতাম”… […]
LikeLike