ইসরায়েলের সাথে কিছু আরব রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বনাম ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ

Image: Mustafa Hassona/Anadolu Agency/Getty Images

বাহরাইনও আরব আমিরাতের পথ ধরে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে ডোনাল্ড ট্রাম্প আসন্ন নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে তার পররাষ্ট্র নীতির সাফল্য দেখাতে এই “অবলা” আরব দেশগুলোকে চাপের মুখে (আন্ডার ডিউরেস) ইসরায়েলের সাথে তাদের এতদিনকার চলে আসা গোপন সম্পর্ক ওপেন করতে বাধ্য করেছে। ফিলিস্তিনিদের অধিকার অর্জনে কোনরূপ অগ্রগতি ছাড়াই আরব দেশগুলোর এই স্বাভাবিকীকরণকে অনেকে ইসরায়েলের বিজয় হিসেবে দেখলেও, প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যের আগামীর রাজনীতিতে এগুলোর কি আদৌ কোন ভূমিকা রয়েছে? চলুন একটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক।

প্রথমত, যে দেশগুলো ট্রাম্পের চাপের মুখে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বাধ্য হচ্ছে, সেদেশগুলো আদতে মধ্যপ্রাচ্যের গত ১০০ বছরের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোন খেলোয়াড় কখনোই ছিলো না। ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় এবং ইসরায়েলকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে যে চারটি বড় যুদ্ধ হয়েছে (১৯৪৮, ৫৬, ৬৭, ৭৩ সালে) তার কোনটিতেই এই ”শেখ রাজতন্ত্রগুলো” কোন সক্রিয় পক্ষ ছিলো না। তারা ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আদতে সামনে থেকে কখনোই কোন ভূমিকা পালন করেনি। এসব লড়াইয়ের সম্মুখে ছিলো মিশর, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান। মিশর সিনাই ফিরে পেতে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। পশ্চিম তীর নিয়ে সমঝোতার অংশ হিসেবে জর্ডানও সেটি করেছে। সুতরাং সত্যি বলতে মধ্যপ্রাচ্যের গত ৭০ বছর ধরে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন ঘিরে যে অনিষ্পন্ন সংকট বিদ্যমান, তার উপর এই শেখতন্ত্রগুলোর আচরণের প্রভাব সামান্যই। এমনকি সৌদি আরব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও এই অঞ্চলের সংঘাত কাঠামো ও ভূরাজনৈতিক হিসেব-নিকেশে মৌলিক কোন পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি না।

সুতরাং এ অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক সংকটে এই দেশগুলো মূখ্য ভূমিকায় না থাকায় এরা আগামীর সংকট-সংঘাতে বিশেষ কোন রাজনৈতিক অবস্থানে থাকার সম্ভাবনা নিতান্তই কম। জেরুজালেম ফিরে পেতে মুসলমানরা জাতিগতভাবে আবারো সংঘাতে জড়াবে কিনা সেটি নির্ধারণে এই আরব দেশগুলোর (সিরিয়া ও ইরাক ছাড়া) ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবেই প্রান্তিক হওয়ায় আগামীতেও সেই চিত্রটি বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আমার বিবেচনায় ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়, মুসলমানদের আল-আকসা উদ্ধারের লড়াই এই দুটি ঐতিহাসিক সংঘাতের আগামীর গতিপ্রকৃতি নির্ভর করবে মূলত তুরস্ক ও ইরানের উপর। তুরস্ক ও ইরানকে ঘিরেই মধ্যপ্রাচ্যের আগামীর ক্ষমতা কাঠামো গড়ে উঠছে ও ভূরাজনৈতিক মেরুকরণও সেভাবে গড়ে উঠবে। বড় কোন যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়লে, এই দেশ দুটিই আগামী ৫০-১০০ বছর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ভাগ্যনিয়ন্তা থাকার কথা। সামরিকীকরণও সেভাবেই এগোচ্ছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে আরব শেখদের বর্তমান আচরণের ব্যাখ্যা কী। দুটো বিষয়: প্রথমত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান, আরব আমিরাত ও সৌদি আরবসহ যেসব শেখতন্ত্র এখনো টিকে আছে এরা ঐতিহাসিকভাবেই ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চদের বসিয়ে যাওয়া দালাল। এর মধ্যে কুয়েত ও কাতার দলছুট হয়েছে। ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চদের দিন পুরাবার কারণে এই শেখ পরিবারগুলোর নতুন কেবলা এখন ওয়াশিংটন। এমনকি নিজ দেশের জনগণের উপরও চেপে বসা এসব শেখদের এখন পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার পেছনেও পশ্চিমাদের ভূমিকা রয়েছে। এরা আঞ্চলিক ক্ষমতার বিচারেও অনুল্লেখযোগ্য। বরং নিজেদের গদি রক্ষায় এরা সারাক্ষণ ত্রটস্ত থাকে এবং এরা মনে করে এদের গদি রক্ষায় ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তা আবশ্যক। দ্বিতীয়ত, ইরান ও শিয়া-সুন্নী বিরোধ। এটিও আরব শেখদের ইসরায়েল ও পাশ্চাত্যমুখী করেছে। তবে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানীদের অবস্থান এই ডাইকোটোমি ভাঙতে সহায়তা করেছে এবং ইরান আরব দেশগুলোতে অনেক সুন্নী আন্দোলনের সাথে মৈত্রী করেছে (হামাস, মুসলিম ব্রাদারহুড অন্যতম)।

সুতরাং যারা ভাবছেন আরব আমিরাত, বাহরাইনের ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট ও সংঘাতের চিত্র বা ভূরাজনীতি খুব বেশি বদলে যাচ্ছে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে খুব বিপ্লবী কিছু ঘটছে, ব্যাপারটা এমন নয়। বরং বাস্তবতা হচ্ছে ইরানের পাশাপাশি তুরস্কও মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠার কারণে ইসরায়েলের ক্ষমতা কাঠামোয় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সিরিয়াকে বলকানাইজেশন (ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ভাগে ভেঙে ফেলা) করার তাদের যে প্রকল্প সেটি মাঠে মার যাওয়ায় নর্দার্ন ফ্রন্ট নিয়েও নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর রবার্ট ফিস্ক সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে কয়েক বছর আগে এক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পশ্চিমাদের ও ইসরাইলিদের পরিকল্পনার বিপরীতে সিরিয়া যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হবে এবং সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইরানের তত্ত্বাবধানে এক শক্তিশালী আর্মির উত্থান ঘটবে। সিরিয়ান আর্মির নতুন গড়ে ওঠা দুর্দমনীয় “টাইগার ফোর্স” বাহিনী কিংবা এর লিজেন্ডারি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুহেইল আল হাসান যেন রবার্ট ফিস্কের ভবিষ্যদ্বাণীকেই সত্য প্রমাণ করছে।

যার ফলে এতদিন গাজায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের মেরে ট্রিগার হ্যাপি ইসরাইলীদের এখন উত্তর সীমান্তে রাশিয়ার প্রশিক্ষিত কয়েক লাখ সিরীয় সেনা, যারা আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই গোলান উপত্যকা ফেরত চাইবে, এবং লেবাননের দুর্দর্ষ গেরিলা বাহিনী হিজবুল্লাহকে (যাদেরকে বিশ্বের অনেক কনভেনশনাল আর্মির চেয়ে শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করা হয়) মোকাবেলা করতে হবে। এছাড়া হামাস ও হিজবুল্লাহর পৃষ্ঠপোষক ইরান একই প্রক্রিয়ায় ইরাক ও সিরিয়াতেও নতুন হিজবুল্লাহ বাহিনী গড়ে তুলছে, এসব বাহিনীকে নিশানাভেদী গাইডেড মিসাইলে সজ্জিত করছে, পাশাপশি ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি গড়ছে – এগুলোই ছিলো ইসরায়েলের এতদিনকার বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। তাদের নতুন চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে গত কয়েক বছরে তুরস্ক ক্রমবর্ধমানভাবে প্যালেস্টাইন ও জেরুজালেম বিষয়ে যেভাবে সক্রিয় হয়েছে সেটি। যার ফলে আমার বিবেচনায় ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের আগামী রাজনীতি, সংঘাত মূলত তুরস্ক-ইসরায়েল-ইরান বলয়ে ঘুরপাক খাবে।

প্যালেস্টাইন বা জেরুজালেম প্রশ্নের নিষ্পত্তি কিভাবে হবে?

আমি মনে করি মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট ফিলিস্তিনের বিষয়টি সমাধান না হওয়ার কারণ শক্তির ভারসাম্যহীনতা। পশ্চিমাদের, বিশেষ করে বিশ্ব মোড়লদের একচ্ছত্র সমর্থন পাওয়া ইসরায়েল এ অঞ্চলের বিরোধী আরব দেশগুলোর দুর্বল সামরিক শক্তি সম্পন্ন দেশগুলোকে খুব বেশি পাত্তা দেয়নি। যার ফলে বারবার যুদ্ধে জড়িয়েও কিছু আরব দেশ ফিলিস্তিনীদের অধিকার তো ফিরে পায়ইনি, বরং নিজেদের ভূখণ্ড খুঁইয়েছে। এই শক্তির ভারসাম্য যতদিন প্রতিষ্ঠা না পাবে ততদিন ফিলিস্তিনিদের অধিকার ফিরবে না।

তবে এ স্ট্যাটাস কো বা অচলাবস্থার বিপরীতে গত ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে ইরান, এবং সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক। এ দুটি দেশের সামরিক সক্ষমতা ইসরায়েলের একচ্ছত্র ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে পারে। বিশেষ করে ইরানের সংগঠিত আঞ্চলিক ছোট-ছোট প্রক্সিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার প্রায় নতুন বিন্যাস তৈরি করেছে। তথাপি, ইসরায়েল তাদের আকাশ যুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার কারণে এখনো পূর্ণাঙ্গ শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। তুরস্কের পুনরুত্থান ও নতুন ভূমিকা এই অচলাবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ করবে।

আমি মনে করি মধ্যপ্রাচ্যে আগামী দিনে বাহরাইন, আমিরাতের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কের মতো খুচরো ঘটনাবলী নয়, বরং দুটি ঘটনা পুরো আঞ্চলিক রাজনীতিকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করে দিবে:

(১) যেদিন ইসরায়েলের এয়ার সুপারিয়রিটি বা আকাশ যুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব শেষ হবে অর্থাৎ হয় ইরানীরা (এবং পরবর্তীতে ইরাক, সিরিয়া ও হিজবুল্লাহ) আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়ত্ত করবে যার ফলে ইসরায়েলি বিমান তাদের খেয়ালখুশীমতো যেখানে ইচ্ছা বোমা মারতে পারবে না অথবা তুরস্ক আগ্রাসীভাবে ইসরায়েলের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে (কারণ ইসরায়েলের সামরিক শক্তিকে যেকোনো মানদণ্ডে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা তুরস্কের রয়েছে); এবং

(২) মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্ধী যেকোনো একটি দেশ যেদিন সেকেন্ড-স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি সম্পন্ন নিউক্লিয়ার ডিটারেন্স প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

আমি মনে করি এই দুটি ঘটনা ঘটার কয়েক বছরের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে (কারণ ইসরায়েল হয় বুদ্ধিমত্তার সাথে নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নিবে, অথবা আত্মঘাতি যুদ্ধে জড়িয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে)।

1 thought on “ইসরায়েলের সাথে কিছু আরব রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ বনাম ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ”

Fahim Sikder এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল