
প্রাসঙ্গিক খবর:
বাংলাদেশ (ও প্রতিবেশী কিছু দেশের) মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সম্প্রতি ভারতের সাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমূলক আইন National Registry of Citizens (NRC) ও Citizenship (Amendment) Act, 2019 (CAA)-এর বিরোধীতা করে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী একটি প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি নুরুল হক ও তার সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদ-এর উদ্যোগে এ প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য চত্ত্বরে তাদের আয়োজিত সমাবেশে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ‘-এর ব্যানারে মঞ্চের সভাপতি ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন দলবল নিয়ে ডাকসুর ভিপি ও তার অনুসারীদের ওপর হামলা করে। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কর্মীরা NRC ও CAA-কে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ উল্লেখ করে ভিপি নুরুলকে কর্মসূচি পালন করতে নিষেধ করেন। ভিপি নুরুল ও তার সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তা মানতে অস্বীকৃতি জানালে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা তাঁদের মারধর ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন।
—–
‘স্বাধীন‘ বাংলাদেশে এ ধরনের একটি ঘটতে পারে তা অবিশ্বাস্য! অকল্পনীয়! খোদ ভারতেই NRC ও CAA নিয়ে ভারতেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। NRC ও CAA-এর সাথে বাংলাদেশ নামটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ক্যাব বিল আলোচনার সময় ভারতীয় সংসদে দাড়িয়ে বাংলাদেশের নামে বিষেদগার করেছে। এই দুটি আইনই অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক, বিতর্কিত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এগুলো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও জাতীয় স্বার্থের সার্থে সরাসরি সংশ্লিষ্ট।
অত্যন্ত আশ্চর্যের ও পরিতাপের বিষয় যে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা বা শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের কথা-বার্তায়, আচরণে বিজেপির মন্ত্রীদের চেয়ে ভারতকে বেশি ডিফেন্ড করে চলেছেন। ভারতের শাসকরা অসন্তুষ্ট হবেন সেজন্য বাংলাদেশ নিজের অবস্থানকে পরিষ্কারভাবে তুলে না ধরে আসন্ন একটি গভীর সংকটকে পাশ কাটিয়ে চলছেন। বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের জন্য এ যেন “ক্যাচ ২২”। তাদের প্রশ্নবিদ্ধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তারা দৃশ্যত প্রতিবেশীর সাহায্য প্রার্থী, যার ফলে তারা ভারতকে চটাতে চায় না। সেটি দেশের স্বার্থ হানি হলেও। তাদের বর্তমান অবস্থান এখন ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান দা পোপ‘ – তারা দৃশ্যত ভারতীয়দের চেয়েও বেশি ভারতীয় হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশী হিসেবে এটা আমাদের জন্য সুখকর নয়।
অবশ্য বাংলাদেশের শাসকরা এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলে কথা ছিলো। তারা একেবারে ওপারের লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদ কিংবা ভারতের ভুলভাল নীতির ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশের কেউ যাতে এ বিষয়ে কথা বলতে না পারে এটা নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা এস্টাবলিস্টমেন্ট বেশ সক্রিয়। কিন্তু তাদের হয়ে ফ্রন্টলাইনে কে সেবা দিচ্ছে, মানুষকে কে দমিয়ে দিচ্ছে সেটি অভাবনীয়! বিভিন্ন নামে-বেনামে এটি স্পষ্টতই করছে শাসক দল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লোকজন। কাশ্মীরকে ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে একবার বেনজির আহমেদ তো মানুষকে ধমক দিয়েছেন ভারত বিরোধী কথা না বলার জন্য আর এখন ছাত্রলীগের কর্মীরা বেনামে নুরুর উপর হামলা করেছে দেশের পক্ষে কথা বলার জন্য!! হোয়াট এ টার্ন এরাউন্ড অব দ্যা হিস্টরি?!! যে দল স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলো, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নকে আপেক্ষিক রেখে আরেকটি দেশের দালালী করছে?!

বাংলাদেশ ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত এক দেশ। এ দেশ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের নিপীড়িত মানুষের কথা বলবে, তাদের পক্ষে দাড়াবে। বাংলাদেশে এমনকি পাকিস্তান আমলেও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিলে-মিছিলে রাজপথ উত্তাল ছিলো। বাংলাদেশে প্যালেস্টাইনের পক্ষে রাজপথ প্রকম্পিত ছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মিছিল, সভা-সমাবেশ হয়েছে। স্বাধীনতাকামী, মানবাধিকারের স্বপক্ষের মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের অন্যায় অবিচারের বিপক্ষে দাড়াবে, কলম ধরবে – এটিই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের শাসকরা ভারতের দালালী করছে বলে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের মানুষের লড়াই-সংগ্রামে পাশে দাড়াতে পারবে না এটি অবিশ্বাস্য। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আমাদের মুক্তির সংগ্রামের সাথে উপহাস।
বাংলাদেশের পরিণতি যদি ভারতের দালালীই হবে, তাহলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশটাকে স্বাধীন করতে যারা বিভিন্নভাবে লড়াই-সংগ্রাম করেছে, তারা যুদ্ধে যাওয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতো। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান দেখে বহু মুক্তিযোদ্ধা মনে-মনে কষ্ট না পেলে, প্রতারিত বোধ না করলে অবাক হবো। পাকিস্তানী শাসক ও তাদের দালালরা ১৯৭১ সালে অপপ্রচার চালিয়েছিলো যে ভারত পূর্ব-পাকিস্তানকে কব্জায় নিতে পাকিস্তান ভাঙছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এটি প্রমাণ করতে এতটা চেষ্টা-কসরত করবে জানলে মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিতেন কি-না সন্দিহান। বঙ্গবন্ধুকে ভুল প্রমাণ ও ১৯৭১ সালের পাকিস্তানী সৈন্য ও ‘রাজাকার‘দের সঠিক প্রমাণ করার দায়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশে‘র ইতিহাসে কি চরিত্রে থাকবেন তাই ভাবছি…

আওয়ামী লীগে ও ছাত্রলীগে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক অসংখ্য মানুষ আছেন। তারা হয়তো জানেনই তাদের নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতার স্বার্থে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধের অবস্থান নিয়েছেন। বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্য অবিশ্বাস্য। তবে আমি নিশ্চিত ধীরে ধীরে অনেকেই বিষয়টি উপলব্ধি করবেন যে তাদের বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের এই সংকটে দেশের পক্ষে থাকবেন। যারাই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করবেন তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। তারা দলের চেয়ে দেশকে প্রাধান্য দিবেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে থাকবেন এই আশা করি।

পাকিস্তান আমাদের জাতীয় জীবনে ৫০ বছর আগের এক নৃশংস ইতিহাস। তাদের নৃশংসতার জন্য আমরা কখনো ক্ষমা করবো কি-না দ্বিতীয়বার ভাববো। কিন্তু তারা সত্যিই অতীত। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক গতিশীল। যে ভিয়েতনামের প্রায় প্রতিটি ইঞ্চি মাটি আমেরিকান বোমার সাক্ষ্য বহন করে, সে ভিয়েতনাম চীনের আঞ্চলিক আগ্রাসনকে মোকাবিলায়, ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণে সেই আমেরিকাকে মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ব্যক্তিগত আবেগের কোনো মূল্য দেয় না। এটি নির্মোহ সম্পর্ক, ভাবাবেগ-মুক্ত। এখানে স্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই। যারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পড়েছেন তারা জানেন কিভাবে শত্রু-মিত্র, জোট, মৈত্রি পাল্টায়।

বাংলাদেশকেও সে পথেই হাঁটতে হবে। বাংলাদেশ তার স্বার্থে, প্রয়োজনে পাকিস্তানের পেঁয়াজ আনবে কিংবা চাল। ভারত থেকে প্রয়োজনে শিল্পের কাঁচামাল আনবে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সবগুলো ছোট দেশের সামনে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন ভারত ও তার সম্প্রসারণবাদী নীতি। ভারত হেজিমোন হয়ে প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যার ফলে প্রায় সবগুলো দেশ ভারতের বিরুদ্ধে চলে গেছে। বাংলাদেশেও এই ভারত প্রশ্নটি রাজনীতির সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। প্রায় চারদিকে ঘিরে থাকা ভারতের পেটের মধ্যে থেকে বাংলাদেশ কিভাবে তার স্বকীয়তা, স্বার্থ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে চলবে এটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্ন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকেই প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুও এই প্রশ্নটি জানতেন এবং জানতেন বলেই ভারতের অপ্রিয় কাজটি করতে একটুও দ্বিধা করেননি। বিনা শর্তে, বিনা প্রশ্নে ভারতের সেনাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে ছিলেন। সেটি না করলে বাংলাদেশ আজ লেবাননের পরিণতি বরণ করতো।
তথাপি, ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক একই সাথে অনিবার্য বাস্তবতা (কারণ আমরা তাদের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত শেয়ার করি) আবার একই সাথে কৌশলগত – কারণ রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী নিরাপত্তা ঝুঁকির উৎসও ভারত। যেকারণে ভারতের সাথে বাংলাদেশের অম্ল-মধুর সম্পর্ক থাকবে। সম্পর্কের পারদ উঠানামা করবে – কখনো ভালো কখনো খারাপ। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা আমাদের স্বকীয়তা নিয়ে, মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকবো। ভারত বড় দেশ হলেও প্রতিবেশির মর্যাদা নিয়ে সম্পর্ক গড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা হস্তক্ষেপ করলে, নিজেরা এমন কোন পদক্ষেপ নিলে যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় (যেমন- নদীতে বাঁধ, এনআরসি, সিএএ-এর মতো ক্ষতিকর পদক্ষেপ), বাংলাদেশকে কৌশলগত কারণে প্রতিব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের কোনো শাসক এর ভিন্ন কিছু চিন্তা করলে তা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বলে ধরে নেওয়া হবে।
পুনশ্চ: পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-কর্তৃক পাকিস্তানের দালালী করা আর বাংলাদেশপন্থীদের পিটানোর সাথে বর্তমানে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ-কর্তৃক নামে-বেনামে ভারতের আধিপত্যবাদ-বিরোধী মানুষজনকে পেটানোর মধ্যে পার্থক্যটা কী বলা যাবে?
বাংলাদেশকে তার শক্তি ও দুর্বলতার জায়গা আবিষ্কার করতে হবে। তারও আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বাংলাদেশপন্থী হতে হবে। অন্ধ পাকিস্তানপন্থী ও ভারতপন্থী রাজনীতি উভয়টাই নোংরা, পঁচা, পুতিগন্ধময়। এ ধরনের রাজনীতি বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতি হুমকি স্বরূপ। জনগণের বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। বাংলাদেশপন্থা বিজয়ী হোক।
[খবর লিংক: https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1629776/ভিপি-নুরুলের-সমাবেশে-হামলা%5D
ভারতের রাজাকার দের হাত থেকে মুক্তি চায় বাংলাদেশের জনগণ
LikeLike
ভারতের রাজাকার দের হাত থেকে মুক্তি চায় বাংলাদেশের জনগণ
LikeLike