নিষিদ্ধ জামায়াত, মংলা বন্দর ও তিস্তা প্রকল্প: ভারতকে সন্তুষ্ট করার শেখ হাসিনা সর্বশেষ আপ্রাণ কিন্তু অর্থহীন চেষ্টা

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে জামায়াত ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সংযোগ আপাতদৃষ্টিতে দূরবর্তী মনে হলেও, এটা নিশ্চিত যে শেখ হাসিনা একটা ক্যালকুলাসের অংশ হিসেবে এই মুহূর্তে এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন এবং তিনি এর মাধ্যমে কিছু একটা অর্জন করতে চান। প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কী? বিক্ষোভ দমন? সম্ভবত না, কারণ শেখ হাসিনা নিজেও জানেন যে বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। দেশের আপামর জনতা এখন এই বিক্ষোভে সামিল। সেখানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, বরং হয়তো উল্টোটা হবে।

তাহলে শেখ হাসিনার এহেন সিদ্ধান্তের হেতু কী হতে পারে?

আমি মনে করি এর মূল কারণ, শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে ভারতীয়দের যেকোনো উপায়ে খুশী করে তার গদি রক্ষা করতে চাইছেন। শেখ হাসিনার তার দেড় দশকের শাসনে ভারতীয়দের নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত চাহিদা যেমন, উলফা ও অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণ, বাংলাদেশে ভারত বিরোধী যেকোনো গোষ্ঠীকে দমনপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণ এবং দেশের সংবেদনশীল জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোতে ভারতকে অ্যাক্সেস প্রদান প্রভৃতি মিটিয়েছেন। তারপরও ভারত দীর্ঘদিন ধরে আরও কয়েকটি জিনিস শেখ হাসিনার কাছে দাবি করে আসছিলো। শেখ হাসিনা সেগুলো দিবো-দিচ্ছি করেও আটকে রেখেছিলো সম্ভবত এই মুহূর্তটির জন্য।

সে দাবীগুলো তাহলে কী এবং কেনই বা শেখ হাসিনাকে এই মুহূর্তে ভারতের এই চাহিদাগুলো পূরণে ব্রতী হয়েছেন?

জবাব হচ্ছে, বর্তমান সংকট মোকাবেলা ও ক্ষমতা ধরে রাখা। এটি দিন-দিন সবার কাছেই স্পষ্ট হচ্ছে যে, শেখ হাসিনা রেজিম এই মুহূর্তে অভূতপূর্ব একটি সংকটকালীন সময় অতিবাহিত করছে। তার রাজনৈতিক ভিত্তি এখন সবচেয়ে খুঁকিপূর্ণ ও নড়বড়ে এবং তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছে দেশ বা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে হলেও ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখা। এমনকি তার জন্য হাজারো মানুষের রক্ত ঝরিয়ে হলেও। কিংবা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থায়ী স্বার্থ বিকিয়ে হলেও।

চলুন দেখা যাক, শেখ হাসিনা ভারতকে সন্তুষ্ট করে কীভাবে এখনকার সংকট মোকাবেলা করতে চাইছে:

১। জামায়াত নিষিদ্ধ করা। বহু ভারতীয় বিশ্লেষকের সাথে আলাপ করে, তাদের দীর্ঘদিনকার পাবলিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে আমার কাছে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়েছে যে, ভারতীয়রা মনে করে যে বাংলাদেশকে তাদের নিরঙ্কুশ কব্জায় বা নিয়ন্ত্রণে আনার আভ্যন্তরীণ অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জামায়াত ইসলামী। সুতরাং জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার জন্য তারা শেখ হাসিনার উপর দীর্ঘদিন চাপ দিয়ে গেছে। জামায়াতের নেতাদের ফাঁসির বিষয়টি যার ফলে যতটা-না বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অপরাধের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা ছিলো তার চেয়ে বেশি ছিলো ভারতকে সন্তুষ্ট করা। এবং এই বিচার, যা বহু স্বাধীন বিশ্লেষকদের মতে এক পর্যায়ে প্রহসনে পরিণত হয়, ভারতীয়দের চাপেরই ফসল। শেখ হাসিনা তার ক্ষমতার এই চরম সংকটকালে দৃশ্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বিপদে ফেলে হলেও ভারতকে খুশী রাখার উদ্যোগী হয়েছেন।

২। কৌশলগত স্থাপনা ও প্রকল্পগুলোতে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া। চীন শেখ হাসিনার শাসনামলে উদার হস্তে ঋণ দিয়ে গেছে এই আশায় যে শেখ হাসিনা অন্তত কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে বং প্রতিদানস্বরূপ কিছু কৌশলগত প্রকল্পে তাদেরকে নিয়োজিত করবেন যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের সমার্থক হবে। বলাবাহুল্য এসব প্রকল্পের কোনটা বাংলাদেশের জন্য ভালো বা মন্দ এটা শেখ হাসিনার জন্য কখনো মূখ্য ছিলো বলে মনে হয় না। গত দেড় দশকে তার প্রধান বিবেচ্য ছিলো এই দুই বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তির সমর্থন আদায় করে ক্ষমতায় থাকা।

৩। এতদিন এটি কাজ করলেও, ২০২৪ সালে এসে স্পষ্টতই চীন শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিয়েছে যে, ইঁদুর-বিড়াল খেলা যথেষ্ট হয়েছে। এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রকল্প না পেলে তারা আর উদার হস্তে পয়সা দিতে রাজী নয়। তাদের কৌশলগত কিছু প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর, মংলা বন্দর, মিরসরাইর উপকূলে সাগর রিক্লেইম করে নতুন শহর নির্মাণ, তিস্তা প্রকল্প, এবং সিলেট বিমান বন্দর প্রকল্প। এগুলোর কোনটিই শেখ হাসিনা গত দেড় দশকে চীনকে দেননি তার রক্ষাকর্তা ভারত অখুশী হবেন বিধায়। যার ফলে ২০২৪ সালের চীনা রাষ্ট্রীয় সফরে শেখ হাসিনা ৫০০০ মিলিয়ন ডলার চাইলেও মাত্র ১৪০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অঙ্গীকার পেয়েছেন। এটি নিতান্তই অপমানস্বরূপ। এছাড়া চীন সফরে চীনা সরকারের উল্লেখযোগ্য কোন ব্যক্তি শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেন নি এবং তিনি এক অজুহাত দিয়ে তার সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসেন। যাই হোক, এখন ক্ষমতা ধরে রাখতে শেখ হাসিনা এখন ভারতকে মংলা বন্দরের মতো কৌশলগত স্থাপনা ব্যবহার করতে দিয়েছেন এবং তিস্তা প্রকল্পের মতো কৌশলগত প্রকল্পও ভারতের হাতে তুলে দিবেন বলে প্রকাশ্যে বলেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে ভারতকে তার সকল চাহিদা মিটিয়ে দেওয়ার পরও ভারত কী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে চাইবে অথবা আরও বড় প্রশ্ন হচ্ছে তারা কি সেটি পারবে?

প্রথমত, হ্যাঁ, ভারত পুরোপুরি চাইবে যেন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকে। তারা সর্বাত্মকভাবে চাইবে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে। এমনকি দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাকে আরও বেশি রক্তাক্ত করে, আরও হাজারও বাংলার মায়ের বুক খালি করে হলেও ভারত শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে চাইবে। বিবেচনার বিষয় হচ্ছে তারা কি আদৌ সফল হবে কিনা।

আমার বিবেচনায়, তারা সফল হবে না। কারণ, ভারত ভালো করেই জানে, বাংলাদেশে তাদের কিছু পেইড এজেন্ট (তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ এবং সংস্কৃতি অঙ্গন ও ইন্টেলিজেনশিয়ার একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী) ও শেখ হাসিনার দল ছাড়া বাংলাদেশে ভারত বিরোধীতা একটা সার্বজনীন ফেনোমেনন। আমি মনে করি এর পেছনে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে দুটি কারণ বেশি দায়ী:

প্রথমত, প্রতিবেশী ডায়নামিক্স। বড়, প্রভাবশালী প্রতিবেশীদের ছোট প্রতিবেশীরা অপছন্দ করে। এটি সমাজের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। এটা মানুষের ইনেট/সহজাত প্রবৃত্তি। যদি-না বড় প্রতিবেশি প্রয়োজনাতিরিক্ত উদারতা দেখাতে পারে। ভারত স্পষ্টতই সেটি পারেনি।

দ্বিতীয়ত, ভারতীয় কৌশলবিদদের চিন্তার দুর্বলতা ও সংকীর্ণতা। ভারতীয় কৌশলবিদদের চিন্তার দৈন্যতা বেশ প্রকট। তারা যতটা কাছে দেখতে পায় ততটা দূরে দেখতে পায় না। যার ফলে তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির প্রতি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের একটা ঝোঁক রয়েছে। এই নগদ লাভের সংকীর্ণতা ভারতকে তার সকল প্রতিবেশীর প্রতি বিরূপ করেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

এছাড়া আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের নাগকিরদের বৃহত্তর অংশের পরিচয়গত ঐক্য এই জাতিগোষ্ঠীকে ভারতের কব্জায় আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিনতর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। সেই বিস্তারিত অন্য আলাপ আরেক দিন করা যাবে। মোদ্দা কথা, ভারত আমাদের রাজনীতিতে স্যাবোটাজ করার সমূহ সক্ষমতা রয়েছে এটি সত্য, কিন্তু বাংলাদেশের গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়ে কাউকে শাসক হিসেবে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করার ক্ষমতা ভারতের সীমিত। সেটি করতে হলে তাকে সৈন্য পাঠাতে হবে। সৈন্য পাঠালে এখানে আরও রক্তপাত হবে। গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হবে। বাংলায় গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে ভারত তার অনুগত শাসক রাখায় ব্রতী হলে, ভারত হয়তো কেবল অনুগত শাসকই পেতে পারে, কিন্তু তার জন্য তাকে অনেক বেশি চড়া মূল্য দিতে হবে। যেমন, এর ফলে তারা পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতের নিয়ন্ত্রণ চিরতরে হারাতে পারে। ভারতীয় কৌশলবিদরা সম্ভবত এই ঝুঁকির কথা জানেন। যার ফলে ভারত কখনোই শেখ হাসিনা কেন, কোন শাসককেই বাংলাদেশে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় রাখতে চাইবে না, তাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই। যদিও আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান তারা সর্বাত্মক, কিন্তু ব্যর্থ চেষ্টাটা চালিয়ে যাবে।

শেখ হাসিনা বা অনুগত শাসক না থাকলে ভারত কী করবে?

আমি মনে করি সেনাবাহিনীতে ভারতের অনুগামী একটি দল তৈরি করতে ভারত গত দেড় দশকে সচেষ্ট থেকেছে এবং শেখ হাসিনার শাসনামলের ঝুঁকিকে পূঁজি করে ভারত সম্ভবত সফলভাবে সেটি করতেও পেরেছে। এখন ভারতের সেইফ এক্সিট হচ্ছে ওই গ্রুপকে দিয়ে সম্ভব হলে একটা ক্যু করানো। শেখ হাসিনাকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও মানুষ গণভবনের দখল নিতে উদ্যোগী হলে ভারত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে থাকা নিজেদের অনুগামী সেনা কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি ক্যু করানোর সর্বতো চেষ্টা করবে। সে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সম্ভবত ১৫ আগস্ট পরবর্তী অস্থিরতার অনুরূপ আরেকটি অস্থিরতার বলয়ের মধ্যে ঢুকবে। কারণ ভারতের অনুগত সেনা কর্মকর্তারা ক্যু করলে অন্যরা পাল্টা ক্যু করবে, এবং অনেক রক্তপাতের সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেক্ষেত্রে চূড়ান্ত পরিণতি কি হতে পারে?

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা রাষ্ট্রটিকে একটি ভঙ্গুর, পঙ্গু রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করেছে। যার ফলে দুঃখজনক হলেও, এখানে এই ইদুর-বিড়াল খেলা চলতে থাকবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যেহেতু ভারত রাষ্ট্রের স্থায়ী কিছু স্বার্থ রয়েছে, এবং ভারত রাষ্ট্র যেহেতু এই স্থায়ী স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশকে তার কব্জায় নিতে চাইবে ও অনুগত শাসক বসাতে চাইবে, এবং বাংলাদেশের জনগণ তাদের বৃহত্তর পরিচয়গত কারণে যেহেতু ভারতকে অপছন্দ করবে এবং তাদেরকে প্রতিহত করতে চাইবে, সেহেতু এই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের ইদুর-বিড়াল খেলা সম্ভবত কোনদিন শেষ হবে না যদি-না:

১। বাংলাদেশ সেকেন্ড স্ট্রাইক নিউক্লিয়ার ডিটারেন্স-সম্পন্ন একটি শক্তিশালী ও পরিপূর্ণ সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় [বিস্তারিত পরে লিখবো]

২। ভারত রাষ্ট্র, ন্যূনপক্ষে উত্তর-পূর্ব ভারত ভেঙে যায় এবং এই অঞ্চলে ভারতের আর কোন স্থায়ী স্বার্থ না থাকে।

৩। বাংলাদেশ অন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে নিরাপত্তা জোট বা কনফেডারেশন তৈরি করে।

৪। চতুর্থ অপশনটা পাবলিকলি বলা যাবে না।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান