
কোন একটা পোস্টে এক ভদ্রলোকের হাহাকার দেখলাম। তিনি নিজেকে বলছেন, বিদ্রোহ-বিপ্লবের কালে বুঝা যায় “ভদ্রলোকরা” কী অর্থহীন জীবনই না যাপন করে! না পারে দ্রোহের সাগরে গা ভাসাতে, না পারে শাসকের চোখে-চোখ রেখে কথা বলতে, না পারে নিজের বন্দীশালায় জীবনের মানে খুঁজে পেতে! কী কাপুরুষতা, পলায়নপরতার অন্ধকারই না তাদের জীবনকে গ্রাস করে রাখে!
জীবনের একটা সময় এই ভদ্রলোকিতার মোহে, ফাঁদে কাটিয়েছি। ছেলেবেলা থেকে পাছে লোকে কিছু বলে, বাঙালীর এই চিরায়ত পলায়নপর মনোবৃত্তির ঘোরে, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিলাম। সংশয়ে অপ্রিয় সত্য বলার সংকল্পটি সদা টলে যেতো। আহা সবার প্রিয় হওয়ার কী দুর্দমনীয় বাঙালী বাসনা! শত অন্যায় মুখ বুঝে মেনে নেওয়া, কঠিন সত্য কথাটি না বলা – এ যেন “প্রিয়”, ”ভদ্রলোক” হওয়ার জীয়নকাঠি!
যেন যেকোনো মূল্যে প্রিয় হতেই হবে। “ভদ্রলোক” হতে হবে। মানুষ-অমানুষ সবার। সত্য ছেড়েও হলেও। একটা সময় নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কেন সত্য বলা যাবে না?! অন্যায়কে অন্যায় বলা যাবে না?! উপলব্ধি হলো, তাতে আর প্রিয়, ভদ্রলোকিতা থাকে না। কিন্তু দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।
অতঃপর কোন এক বিপ্লবী বিকেলে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমিও সত্য বলবো! অপ্রিয় হলেও। সাহস করে অন্যায়কে মোকাবেলা করবো! অমানুষদের সরাসরিই মুখের ওপর বলবো তুমি অন্যায়কারী, অমানুষ! তাতে অনেকে বিরাগ হলেন। সেদিন থেকে আমারও আর সবার “প্রিয়” থাকা হলো না। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেদিন থেকেই যেন আমার বুক থেকে জমে থাকা জগদ্দল পাথরটি নেমে গেলো! আমার আর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে না! সেদিন থেকে আমি কাউকে আর ভয় পাই না। সত্যকে ছাড়া।
যে ভদ্রলোকিতার জীবন পলায়নের, সত্য থেকে পালিয়ে থাকার, ভীতু জীবন, সে জীবনের প্রতি আমাদের সমাজে কী এক মোহ! কত মায়া! ক্ষুদ্র এই জীবনে এত ভয়, এত সংশয়, এত-এত পরাজয় নিয়ে কি অমরত্ব লাভ হবে?! কই, হবে না তো! সেই তো ৫০, ৬০, ৭০, বড়জোর ৮০ বছরের জীবন! ধুলোয় মিশে যাওয়া মাংসপিণ্ড! ট্র্যাজেডি হচ্ছে, সত্যহীন জীবনের অর্ধেকটা কাটে ভয়ে, ভীতু-কাপুরুষ হয়ে। আর বাকী অর্ধেকটা কাটে সত্য বলতে না পারার হাহাকার নিয়ে!
জীবনে তাই কোন আক্ষেপ নিয়েই বাঁচতে চাই না। কাপুরুষতা নিয়ে তো নয়ই। সত্যকে আড়াল করে, মিথ্যার ভয়ে বাঁচতে চাই না। তেলাপোকার জীবন চাই না। বুক পেতে দেওয়ার সাহস নিয়ে বাঁচতে চাই। চির উন্নত শীর রেখে বাঁচতে চাই। জালিমের শত্রু হয়ে বাঁচতে চাই। মজলুমের ভাই হয়ে বাঁচতে চাই।
আমি সেই ভদ্রলোক হতে চাই না যে ভদ্রলোকিতা পালাতে শেখায়, সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। আমি দ্রোহ চাই, আমার ভাই আবু সাঈদের মতো প্রকাণ্ড সাহসের মূর্তি হতে চাই। দুই হাত প্রসারিত করে গুলির মুখে বুক পেতে দিতে চাই। হাসতে-হাসতে মরতে চাই… তবু আক্ষেপের মরণ চাই না!
আমার তরুণ বন্ধুদের আহ্বান করি সে জীবন বেছে নেবেন না, যে জীবনে দ্রোহ নেই, প্রেম নেই, বাদ কিংবা প্রতিবাদ নেই, বিপ্লব নেই, এক বুক সাহস নেই, এবং এক ফোটা আলোও নেই…
All reactions:
3You and 2 others