
ছবি: দেবাশীস
এই নিবন্ধের স্ন্যাপশট:
- জুলাই ২০২৪-এ কয়েকটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেছে যা আগামী বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি বদলে দেবে
- শেখ হাসিনার অবৈধ শাসনামলে সে প্রথম বারের মতো ঢাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে
- শেখ হাসিনার ক্ষমতা ধরে রাখার পিলার বা স্তম্ভ চারটি এবং গত দেড় দশকের শাসনে এই প্রথমবার প্রথম তিনটি নিদারুণ ব্যর্থ হয়েছে এবং তাকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও চতুর্থ স্তম্ভের, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
- শেখ হাসিনার অপরাধকে আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনা সরকার জনগণের বুকে বন্দুক চালিয়ে হাজার-হাজার মানুষকে গুলি, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। শত-শত খুনের পরও পরিস্থিতি তার অনুকূলে আনতে ব্যর্থ হয়ে শেখ হাসিনা এখন সেনাবাহিনীর বন্দুকের আড়ালে, কারফিউ জারি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছেন। শেখ হাসিনা কি সফল হবেন? কিংবা সাধারণ মানুষের রক্ত কি ব্যর্থ হবে? শেখ হাসিনা ও তার বশংবদরা যখন কারফিউর সুযোগ নিয়ে গর্ত থেকে আবার উঁকি দিতে শুরু করছে, গলার জোরে কথা বলার মাধ্যমে তার সাহস ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে, তখন মানুষের মনে এসব প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। এই লেখায় আমি রক্তাক্ত জুলাই ও তার সম্ভাব্য রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিণতি নিয়ে কিছু মন্তব্য তুলে ধরছি। ভবিষ্যতে যাই হোক, ২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই বাংলাদেশে ইতোমধ্যে যেসব পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে:
১। আওয়ামী লীগ সারা দেশ ও বিশ্বের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোটি মানুষের কাছে কার্যত প্রায় আউটকাস্ট বা অচ্ছুৎ হয়ে গেছে। এটি এখন ব্যাপক কারে গালি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও অবাক হবার কিছু নেই। সামাজিক মাধ্যমে যেসব মানুষ এতদিন রাজনীতি নিয়ে যেকোনো আলাপ এড়িয়ে চলতো, তারা “খুনী হাসিনা,” “স্বৈরাচার হাসিনা”, “হাসিনার বিচার চাই” বলে শ্লোগান তুলেছে। এটা স্পষ্ট যে, আগামী দিনে সমাজে, পরিবারে আওয়ামী লীগ করি পরিচয় দেওয়াটা লজ্জার হবে, আওয়ামী লীগ/ ছাত্রলীগ/ যুবলীগ করা ব্যক্তিটা ঘৃণার পাত্র হবে, অচ্ছুৎ হবে।
২। শেখ হাসিনা ও তার দোষরদের আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার কাজটি শুরু হবে। শেখ হাসিনা আর কতদিন দেশ চালাবে বা চালতে পারবে অথবা পারবে না, সেটি আর মূখ্য নয়, শত-শত নিরস্ত্র মানুষের বুকে গুলি চালানো ও তাদের খুনের নির্দেশ দাতা হিসেবে শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক আদালতে অপরাধীর কাঠগড়ায় নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
৩। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে তাকে নাম ধরে ডাকা বা “হাসিনা” বলার পরিস্থিতি ছিলো না। কেবল গুটিকয়েক ব্যক্তি এটি বলা শুরু করে। মূলত, বাংলাদেশে দুটো পক্ষ ছিলো: প্রথম পক্ষ শেখ হাসিনার পদলেহী, তাা তাকে “মাননীয়” বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলতো, আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষ তার পুলিশ-ছাত্রলীগ-আদালতের ভয়ে চুপ ছিলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এমনকি বিরোধী দলের তথাকথিত নেতারাও পরিণতির ভয়ে তাকে “মাননীয়” বলতো। এই ভয় বাধ-ভাঙা-জোয়ারের মতো ভেঙেছে। গত দুই সপ্তাহে রাস্তার ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে এপলিটিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সবাই শেখ হাসিনাকে নাম ধরে ডেকেছে, “খুনী হাসিনা,” “স্বৈরাচার হাসিনা” বলে গালি দিচ্ছে, বিচার চাইছে। বাংলাদেশে সম্ভবত “হাসিনা কাল্ট”-এর চিরকবর রচিত হয়েছে।
৪। শেখ হাসিনা এবারই মানুষের বুকে গুলি চালিয়েছে এমন নয়। গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা মানুষকে নির্বিচারে খুন করে আসছিলো। কিন্তু তাদের খুনকে সে “বিএনপি-জামাত” বা সরকার-বিরোধী-ষড়যন্ত্রকারী ট্যাগ দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেছে। এবার সে সরাসরি এপলিটিক্যাল ছাত্র-জনতার বুকে গুলি চালিয়েছে। দৃশ্যত মৌচাকে ঢিল দিয়েছে। সম্ভবত তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কনসিকোয়েন্সিয়াল সিদ্ধান্ত। এর ফল ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় জিরো।
৫। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের চারটা পিলার বা স্তম্ভ চিহ্নিত করা যায়। ছাত্রলীগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, মিডিয়া, এবং নখদন্তহীন সশস্ত্রবাহিনী। তার ক্ষমতার ফার্স্ট-লাইন-অব-ডিফেন্স বা প্রথম সুরক্ষা লাইন হচ্ছে ছাত্রলীগ (যা ইতোমধ্যে হেলমেট-লীগ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে)। ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে সে গত ১৫ বছর মানুষকে নির্বিচারে কোন পরিণতির ভয় ছাড়াই পিটিয়েছে, কুপিয়েছে, গুলি করেছে, মানুষের মর্যাদা কেড়ে তাদেরকে অপমান করেছে, এবং খুন ও জখম করেছে। ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, ২০১৮ সালের প্রথম কোটা বিরোধী আন্দোলন, এবং ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রলীগ সরাসটি খুনে নেতৃত্ব দিয়ে এসব আন্দোলন ‘অবদমিত’ করেছে, সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরিয়েছে। গত ১৫ বছর এভাবে বেশিরভাগ আন্দোলনে শেখ হাসিনার ফার্স্ট-লাইন-অব-ডিফেন্স তথা ঢাল হিসেবে ছাত্রলীগই তাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ষা করেছে।
৬। দুয়েকটি ক্ষেত্রে যখন ছাত্রলীগ আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়েছে বা পুরোপুরি পারেনি, তখন শেখ হাসিনা তার সেকেন্ড-লাইন-অব-ডিফেন্স তথা পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-লীগ নামিয়েছে, কিংবা ছাত্রলীগ ও তারা সমন্বয় করে সংকট সামলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩-১৪ সালে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-লীগ শত-শত মানুষকে প্রকাশ্যে পাখির মতো গুলি করে মেরেছে এবং দৃশ্যত কবরের শান্তি অর্জন করেছে।
৭। শেখ হাসিনার তিন নম্বর ডিফেন্স হচ্ছে মিডিয়া, মতান্তরে ‘মিডিয়া লীগ’। যেকোনো সংকটে শেখ হাসিনা তার এই তিন নম্বর ডিফেন্স মিডিয়া-লীগ সর্বদা হাজির করতো তার নৃশংসতা, অন্যায্য কার্যক্রমের বৈধতা তৈরি বা জাস্টিফাই করার জন্য। যদিও এর অগ্রভাগে একাত্তর টিভি ও সময় টিভিকে দেখা যায়, কিন্তু সত্য হচ্ছে শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতারা প্রায় ৯৫ ভাগ মিডিয়া সরাসরি মালিকানার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ এরা সরাসরি তার মিডিয়া-লীগের সৈনিক। মিডিয়ার বাকী ৫ ভাগকে সে আইনী কিংবা বেআইনী হুমকি দিয়ে, ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে।
এতদিন পর্যন্ত শেখ হাসিনার ক্ষমতার এই তিন পিলার তাকে সুরক্ষা দিয়ে গেছে।
৮। শেখ হাসিনার ক্ষমতার চার নম্বর পিলার হচ্ছে ‘নখদন্তহীন সশস্ত্র বাহিনী’। কেন নখদন্তহীন? কারণ শেখ হাসিনা প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে বেআইনীভাবে জোরপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আছে, মূলত সহিংসতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু একটি দেশে বৈধভাবে সহিংসতা চালানোর সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর। যেকোনো দেশে সহিংসতাকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে দেশ চালালে সশস্ত্র বাহিনী সেটি হয় বাধা দেওয়ার কথা নতুবা সে ক্ষমতার সরাসরি অংশীদার হওয়ার কথা। আশ্চর্যজনকভাবে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এই দুটির কোনটিই করেনি। কারণ? হয় তাদের সক্ষমতা নেই, নতুবা তারা তাদের ভূমিকা নিয়ে দ্বিধা-সংশয়ে রয়েছে। অনেকে ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ-কে একটি কারণ মনে করেন। যেকোনো বিচারেই হোক, আমি এটিকে স্রেফ ‘নখদন্তহীন’ বাহিনী হিসেবে সাব্যস্ত করি। কারণ তারা তাদের শক্তিমত্তা এবং সাংবিধানিক ভূমিকা কোনটি সম্পর্কেই দৃশ্যত অবগত নন। শক্তিমত্তা সম্পর্কে অবগত থাকলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের সহিংসতা দেশ নিয়ন্ত্রণ করতো না, তারা হস্তক্ষেপ করতো। সাংবিধানিক কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত থাকলে তারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর চেপে বসা এক যুগের অবৈধ শাসনকে তারা একদিনও চলতে দিতো না এবং বাংলাদেশের জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতো।
৯। বাস্তবতা হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে এখন এই বাহিনীর সদস্যদের মাঠে নামিয়েই তার গদি রক্ষা করতে হচ্ছে। এটি উপর্যুক্ত দুটি কারণেই নানা উল্লেখযোগ্য পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, সেনাবাহিনী কি তার শক্তি ব্যবহার করে একটি অবৈধ শাসনকে টিকিয়ে রাখায় সহায়তা করবে, নিজেরা ক্ষমতার অংশ দাবি করা ছাড়াই? দ্বিতীয়ত, একটি অবৈধ শাসকের নির্দেশ মোতাবেক বাংলাদেশের মানুষের ওপর সহিংসতা পরিচালনা করবে কিনা। উভয় পরিস্থিতিতেই নানা ঝুঁকি রয়েছে। প্রথমত, মানব-রাজনৈতিক সমাজে সবচেয়ে সংঘটিত বাহিনী হিসেবে এই ম্যান-অন-দ্যা-হর্সেস-ব্যাক-দের ক্ষমতার অংশ দাবি করার দীর্ঘ ইতিহাস, দ্বিতীয়ত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অবৈধ শাসন উচ্ছেদ করায় তাদের ভূমিকা নিয়ে জনগণের প্রবল আগ্রহ ও জনপ্রিয় দাবি। তৃতীয়ত, শেখ হাসিনার অবৈধ গদি রক্ষা করলে সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি দুর্বলতর হওয়া যা তারা স্পষ্টতই অপছন্দ করে কারণ এটি তাদের ‘দেশপ্রেমিক’ ট্যাগের বিরুদ্ধাচার।
১০। এতসব ঝুঁকি বিবেচনায় শেখ হাসিনা এতদিন পর্যন্ত তার গদি রক্ষায় সামরিক বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার বিষয়টি সর্বতোভাবে এড়িয়ে গেছে, এবং তার ক্ষমতার অন্য অংশীজনদের (বিভিন্ন লীগ ও পুলিশ-র্যাব-বিজিবি) সর্বোচ্চ হত্যাযজ্ঞের অনুমতি দিয়ে হলেও সামরিক বাহিনী মোতায়েন এড়াতে পেরেছে (যেমন, ২০১৩ সালের শাপলা চত্ত্বরের ঘটনা), ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত।
১১। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইতে এমন কি হলো শেখ হাসিনাকে তার ক্ষমতার সর্বশেষ স্তম্ভ, অর্থাৎ ‘নখদন্তহীন’ সেনাবাহিনীকে নামাতে হলো? কারণ দুটি: প্রথমত, গত ১৫ বছরে এই প্রথম তার ক্ষমতার তিনটি স্তম্ভই নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ১৬ জুলাই ২০২৪ তারিখে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অকল্পনীয়ভাবে সাধারণ ছাত্ররা ছাত্রলীগকে সর্বত্র প্রতিরোধ করেছে, তাদেরকে পিটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিয়েছে। এত দ্রুত শেখ হাসিনার ফার্স্ট-লাইন-অব-ডিফেন্স ধ্বসে পড়বে সে ঘুণাক্ষরেও কল্পনাও করেনি। ত্বড়িৎ সে তার সেকেন্ড-লাইন-অব-ডিফেন্স হিসেবে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি লীগ নামিয়েছে। কিন্তু প্রায় ৫০০ শতাধিক মায়ের বুক খালি করেও শেখ হাসিনা বাংলার বিদ্রোহে ফুঁসে ওঠা মানুষকে দমাতে পারেনি। তারা আওয়ামী লীগকে রাস্তা থেকে নাই করে দিয়েছে। শেখ হাসিনার মিডিয়া তথা জাস্টিফিকেশন লীগের একটা কথাও মানুষ আর বিশ্বাস করেনি।
১২। দ্বিতীয়ত, গত ১৫ বছরে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা একাধিকবার বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারালেও অন্যান্য সফল স্বৈরাচারী নিপীড়ক শাসকদের মতো সে যেকোনো মূল্যে রাজধানী ঢাকার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। একাজে তাকে তার সমস্ত ‘লীগ’ বাহিনী, অনুগত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাগণ (যারা প্রায়শই তার নিজের জেলা গোপালগঞ্জ থেকে আসা), এবং গোয়েন্দা সংস্থা সহায়তা করেছে। সমসাময়িক বিশ্ব ইতিহাসে এমন নজির ভুরিভুরি আছে যে স্বৈরশাসকরা রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকেন। সিরিয়ার বাশার আল আসাদ গণঅভ্যুত্থানে প্রায় সমগ্র সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারালেও রাজধানী দামেস্কের দখল ধরে রেখে সে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শেখ হাসিনা এতদিন তার ক্যাডারদের দিয়ে ঢাকার দখল রাখতে পারলেও, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এসে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে সে গত দেড় দশকে প্রথমবারের মতো ঢাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
১৩। প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে সামরিক বাহিনীর কাছে তার ক্ষমতা রক্ষার অনুরোধের পরিণতি কী? যদিও সেনা নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে তার বুক কেঁপে উঠেছে কারণ সে জানে এটি তার ক্ষমতা ধরে রাখার সর্বশেষ অবলম্বন এবং এটি ব্যর্থ হওয়া মানে তাকে পত্রপাঠ বিদায় নেওয়া, তথাপি, তার ক্ষমতার চতুর্থ স্তম্ভ, এই ‘নখদন্তহীন’ সেনাবাহিনী কতটা ‘নখদন্তপূর্ণ’ হয়ে উঠবে বা কতটা কী করবে আমরা সেটি এখনও জানি না, তেমনি শেখ হাসিনাও জানেন না। যেটি আমরা সবাই জানি যে সেনাবাহিনী যদি সত্যিকার অর্থে ‘নখদন্তপূর্ণ’ হয়ে উঠে, নিজেদের শক্তিমত্তা ও সাংবিধানিক দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক অবগত হয়, সেটি যেকোনো স্বৈরাচারের জন্য খারাপ সংবাদ।
১৪। তারপরও বলতে হয়, আমরা সবাই এখন একটি আননোন-আননোন টেরিটরিতে আছি। মনে রাখতে হবে, জুলাই ২০২৪ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সরাসরি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। এই হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে নিহত-আহত হয়েছে হাজার-হাজার পরিবার, তাদের লক্ষ-কোটি স্বজন। কার্ফ্যু তুলে নিলে শেখ হাসিনা জনজোয়ারে ভেসে যেতে পারে, আবার নাও পারে। কিন্তু মিলিটারি দিয়ে অনির্দিষ্টকাল কার্ফ্যু চললে কী হবে, সেটি দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশের মানুষ সেনাবাহিনীর বন্দুকের নলের বিরুদ্ধে লড়াই করার দীর্ঘ ইতিহাসও আছে। সুতরাং শেখ হাসিনার স্বস্তি নাই।
১৫। যদি সে আগের মতো হাজার-হাজার মানুষকে হত্যা, গুম, আটক করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসবে বলে খোয়াব দেখে, সে দিবাস্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশে “হাসিনা-কাল্ট” তৈরির যে সাধনা তারা গত দেড় যুগ ধরে করেছে সেটি তাসের ঘরের মতো ধ্বসে গেছে। বিএনপি-জামাত কিংবা কোন রাজনৈতিক দল নয়, সাধারণ মানুষ তাকে গণশত্রু হিসেবে চিনতে শিখেছে নিজেদের রক্ত দিয়ে। এই রক্তের ঋণ বাংলাদেশ শোধ করবে।
১৬। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, জুলাই ২০২৪-এ বাংলাদেশে কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে এবং শেখ হাসিনা ও তার দল এই পরিস্থিতি থেকে এখনও উত্তরণের উপায় খুঁজছে। যদিও গত কারফিউ জারির পর তারা গর্ত থেকে বের হয়ে গলাবাজি করছে, এটি দৃশ্যতই তাদের ”বরোড টাইম”। শেখ হাসিনার ঘৃণিত পতন হবে কিনা সেটি আর কোন প্রশ্ন নয়, বরং কবে হবে সে অপেক্ষায় থাকবে কোটি-কোটি মানুষ। তার পতনে বাংলাদেশে মিষ্টির দোকান খালি হয়ে যাবে…