
আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম আল জাজিরা গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং খুনের দায়ে তার সাজাপ্রাপ্ত তিন ভাই আনিস আহমেদ, হারিস আহমেদ, ও তোফায়েল আহমেদ জোসেফ-এর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং সে সম্পর্ক ব্যবহার করে কিভাবে এই অপরাধী চক্র ও শেখ হাসিনা উভয়েই লাভবান হয়েছেন সেই “আনহোলি এলায়েন্স” নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে মোটা দাগে দুটি বিষয়ের সম্পর্ক তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে: প্রথমত, জেনারেল আজিজ ও তার খুনী ভাইরা কিভাবে শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে, তার রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, এবং তাকে ব্যবহার করে অনৈতিক ও বেআইনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, অবৈধ টাকার মালিক হয়েছে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতে শেখ হাসিনার সাথে তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ককে ব্যবহার করেছে সেটি তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা এই অপরাধী চক্রের সাথে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে কিভাবে তাদের ভাই সেনা কর্মকর্তা জেনারেল আজিজকে সেনা বাহিনী ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়নের মাধ্যমে তাকে ব্যবহার করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের দুটি জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছেন সেটি তুলে ধরা হয়েছে। এই পুরো বিষয়টিকে আল জাজিরা মাফিয়াতন্ত্র হিসেবে ইঙ্গিত করেছে যেখানে অপরাধীদের একটি আনহোলি এলায়েন্স তৈরির মাধ্যমে রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করা হয়েছে এবং পারস্পরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
কিন্তু সরকার পক্ষের বা এই মাফিয়াতন্ত্রের স্তাবক ও সরকারি প্রচারলীগের পক্ষ থেকে একটি যুক্তি হাজির করা হচ্ছে যে, “আহমেদ ক্ল্যান” বা জেনারেল আজিজ-এর ভাইরা খারাপ, অপরাধী হলেও শেখ হাসিনার সাথে তাদের সম্পর্ক স্পষ্ট করা যায়নি এবং শেখ হাসিনার চরিত্র পূত-পবিত্র! এর মাধ্যমে তারা শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি হওয়া এক অবৈধ শাসন, যেটিকে আল জাজিরা মাফিয়াতন্ত্র হিসেবে ইঙ্গিত করছে, সেটি বজায় রাখতে চায়। এই নিবন্ধে আমরা শেখ হাসিনার সাথে মাফিয়াতন্ত্রের প্রকৃত সম্পর্ক কী, আদৌ কোন সংযোগ আছে কিনা, অথবা এটি এই রাষ্ট্রের সামগ্রিক চরিত্র কিনা এটি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। এছাড়া রাষ্ট্রে জেঁকে বসা স্বৈরতন্ত্র বা মাফিয়াতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অনুসন্ধানেরও চেষ্টা করেছি।
১। জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই হারিস আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ জোসেফ, ও আনিস আহমেদ ১৯৯৬ সালের ৭ মে তারিখে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে ৯ রাউন্ড গুলি করে। কিন্তু ৯টি গুলি লাগলেও মোস্তাফিজুর ভাগ্যক্রমে কিছু সময় বেঁচে থাকে এবং হাসপাতালে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নিজে জবানবন্দী দিয়ে যায় যে তাকে কারা-কারা গুলি করেছে। যেকোনো বিচারে এটি অকাট্য প্রমাণ হতে পারে যে ভিক্টিম মারা যাওয়ার আগে বলে যাওয়া যে তার খুনী কারা। আমরা ফেনীর নুসরাতের ঘটনায়ও তাই দেখেছি। মোস্তফিজুর খুনের ঘটনায় তোফায়েল আহমেদ জোসেফ গ্রেফতার হন ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের কিছু দিন আগে। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া থমকে যায়। এত স্পষ্ট, অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণের উপস্থিতির পরও ওই খুনের মামলা গতি হারালো। খুনী হারিস-জোসেফ-আনিসরা শেখ হাসিনার শাসনামলে দণ্ডিত হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ২৫ এপ্রিল নিম্ন আদালত জোসেফকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। জোসেফের ভাই, মোহাম্মদপুরের যুবলীগ নেতা হারিস আহমেদ, যিনি আওয়ামী লীগের হয়ে কমিশনার নির্বাচনও করেছিলেন, একই মামলায় পলাতক অবস্থায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পান। তার ভাই আনিস আহমেদও অন্য একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারদণ্ড পান এবং তিনি একই সাথে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা কামাল হত্যা মামলার আসামী। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা পুনরায় জোসেফ গংকে রক্ষার উদ্যোগ নেন। জেনারেল আজিজ বিজিবি প্রধান থাকা অবস্থায় কারাবন্দি যোসেফকে চিকিৎসার নামে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কারা কক্ষে ছিলেন মাসের পর মাস। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে ৪ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ জোসেফের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজা দেন। অবশেষে ২০১৮ সালের ৩০ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপারিশ মতো রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তোফায়েল আহমেদ জোসেফকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এই পুরো প্রক্রিয়াটি দেখলে যে কেউ প্রশ্ন করবেন, জোসেফ ও তার ভাইরা শেখ হাসিনার এত ফেভার পেল কেন? শেখ হাসিনার সাথে বিশেষ সম্পর্ক ছাড়া জোসেফ কি রাষ্ট্রীয়ভাবে সাধারণ ক্ষমা পেতো? জোসেফ, আনিস ও হারিসের ভাই না হলে ২০০৫ সালে ৩০ আর্টিলারি রেজিমেন্টে দায়িত্ব পালনকালীন ২১ হাজার রাউন্ড গুলি খোয়া যাওয়ার কারণে শাস্তি প্রাপ্ত জেনারেল আজিজ কি শৃঙ্খলাবাহিনী বিজিবির প্রধান এবং পরবর্তীতে সেনাপ্রধান হতেন?
২। এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এতই আন্তরিক সম্পর্ক থাকলে শেখ হাসিনা কি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরই জোসেফ, আনিস, হারিসদের অভিযোগ থেকে অব্যহতি দিতে পারতেন না? উত্তর হচ্ছে, আইনগতভাবে পারতেন না। ভিক্টিম নিজেই সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছেন। তাহলে কি আড়ালের ক্ষমতা ব্যবহার করেও তিনি কিছু করতে পারতেন না? আমার মনে হয় সেটি পারতেন যদি সাক্ষী ম্যানিপুলেট করার সুযোগ থাকতো। যেখানে ভিক্টিম প্রধান সাক্ষী এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট জবানবন্দী দিয়ে গিয়েছে সেখানে অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়ার রাজনৈতিক ঝুঁকি শেখ হাসিনা নেন নাই। এর আরো একটি বড় কারণ শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক হয়ে উঠেন নি, তখনো তাকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলোকে ভারসাম্য করে ক্ষমতার রজ্জুর উপর হাঁটতে হতো। তিনি তখন এতটা একচ্ছত্র, বেপরোয়া নিয়ন্ত্রণহীন ছিলেন না বা সেটি হওয়া সম্ভবও ছিলো না।
৩। তাহলে ২০০৮ সালের পর কী হলো যে তিনি এই একচ্ছত্র ক্ষমতা পেয়ে গেলেন? আমি বলবো, দুটো ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষমতার ভারসাম্যকে পাল্টে দিয়েছে: প্রথম ঘটনা, ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন যেখানে বিএনপি-জামাতপন্থী সামরিক কর্মকর্তারাই বিএনপি-জামাত সরকারকে উৎখাত করে এবং পরবর্তীতে তারা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ব্যাকল্যাশ থেকে মুক্ত থাকতে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ সামরিক বাহিনী, যেটি বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বা প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলো সেখানে একটি রাজনৈতিক দল বা পক্ষের প্রতি অতিরিক্ত সুবিধা ২০০৭ সালের পর তৈরি হয়ে যায়। সামরিক বাহিনীর এই যে প্রথাগত ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং তৎপরবর্তী যে বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন তাতে তিনি দুঃসাহসী হয়ে উঠেন। প্রথাগত ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনার ২০০৮ পরবর্তী সময়ে একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। দ্বিতীয় ঘটনা, বিডিআর বিদ্রোহ। এখানকার পুরো আলোচনাটিই স্পর্শকাতর, কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের আলোচনাটি আরো বেশি। তাই বিস্তারিত বললাম না। কিন্তু এই ঘটনাটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এত বেশি দুর্বল করে দেয় যে তারা ঘাবড়ে যায়।
৪। আমি মনে একটি গণতান্ত্রিক দেশে সেনাবাহিনী ক্ষমতা থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়। কিন্তু কোন দেশে যখন একটি রাজনৈতিক টোটালিটেরিয়ান ব্যবস্থাকে উৎখাত করে জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, তখন সেনাবাহিনীও ক্ষমতা ও ক্ষমতার লড়াইয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। তারা যদি জনগণতন্ত্র ও জনগণের ক্ষমতার পক্ষের শক্তি হয়ে উঠে সেক্ষেত্রে তারা অবৈধ স্বৈরাচারী শাসককে ডিফেন্ড করবে না এবং জনগণের কাতারে এসে দাঁড়াবে। দুনিয়ার কোন দেশেই গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান সফল হয় নাই সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশের সক্রিয় সমর্থন (সরাসরি) বা পরোক্ষ সমর্থন (অবৈধ শাসককে সার্ভ করতে অস্বীকার করা) ছাড়া।
৫। প্রশ্ন করতে পারেন যে, ২০১৮ সালের যে শেখ হাসিনা খুনী জোসেফকে মুক্তি দিয়েছেন এই একই একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকলে কি তিনি ১৯৯৬ সালেই জোসেফকে মুক্তি দিতেন? আমি বাজি ধরে বলতে পারি তিনি তাই করতেন। সুতরাং যারা আকারে-ইঙ্গিতে বলছেন এরা শেখ হাসিনার “ম্যান” না, তারা জেনে-বুঝে সত্য লুকাচ্ছে। আহমেদ ক্ল্যানই শেখ হাসিনার “ম্যান”, আহমেদ ক্ল্যানের মতো এরূপ বহু ক্ল্যান, মাফিয়াই শেখ হাসিনার ক্ষমতার উৎস – আগে পোষাক ছাড়া ছিলো, এখন অনেককে পোষাকে ঢুকিয়ে করা হয়েছে।
৬। আরো খারাপ চিত্র হচ্ছে এই সম্পর্কটা ট্রানজেকশনাল, অর্থাৎ আল জাজিরাতে যেটি দেখানো হয়েছে যে, কেবল “আহমেদ ক্ল্যান” শেখ হাসিনাকে ব্যবহার করে যে চুরি-দুর্নীতি-খুনের দায় থেকে অব্যহতি পাচ্ছেন তা না, বরং শেখ হাসিনাও “আহমেদ ক্ল্যান”-কে ব্যবহার করে তার ক্ষমতা সুসংহত করেছেন। ১৯৯৬ সালের আগে শেখ হাসিনা আহমেদ ক্ল্যানদের (আওরঙ্গ, লিয়াকত, হাজারি, ওসমানদের মতো) স্ট্রিট গ্যাং বন্দুকবাজির উপর নির্ভর করে রাজনীতি করেছেন [কেউ বলতে পারে তখন তাকে তাই করতে হতো, এমনটা বললে তার সত্যতা রয়েছে], এবং ২০০৮ পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা সেই ট্রানজেকশনের নতুন ইকুয়েশন নিয়ে হাজির হয়েছেন। এতদিন তিনি পোশাক ছাড়া ভাইদের বন্দুক ব্যবহার করেছেন ক্ষমতার লড়াইয়ে, ২০১৪ সালে তিনি আহমেদ ক্ল্যানের জেনারেল আজিজকে বিজিবি’র মহাপরিচালক করেন। বিজিবির মহাপরিচালক হিসাবে থাকার সময় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত হয় একটি নজিরবিহীন জাতীয় নির্বাচন যেখানে ১৫০টিরও অধিক আসনে কোন ভোট ছাড়াই একটি সরকার গঠিত হয়। তখন সরকার বিরোধী আন্দোলন দমনে জনগণের উপর দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে তিনি তার শেখ হাসিনার আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ২০১৩-২০১৪ সালের রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতা মোকাবেলা এবং ভোট-বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে বিজিবিকে সফলভাবে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করার পুরস্কার হিসেবে শেখ হাসিনা ২০১৮ সালে জেনারেল আজিজকে সেনাপ্রধান করেন যাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেটিও নানা বিচারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ৩০ ডিসেম্বরের পূর্ব রাতেই পুলিশ, প্রশাসন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করে প্রায় বেশিরভাগ ভোট কাস্ট করে নেওয়া হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম, প্রত্যক্ষদর্শী, গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এই নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন অবস্থায় নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত করা হয় এবং তাদেরকে বেসামরিক প্রশাসকের আদেশ ছাড়া কাজ করতে পারবে না এই প্রোটোকলে নিয়োগ করা হয়। সেনাবাহিনীকে সাক্ষী গোপাল হিসেবে নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত করে পুরো নির্বাচনী জালিয়তির কাজটি সূচারুরূপে সম্পন্ন করা হয় এবং সেনাবাহিনীকে অক্ষম করে রাখার এই নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল আজিজ। সুতরাং এই আহমেদ ক্ল্যান ও শেখ হাসিনার সম্পর্কের একটি দিকে ফোকাস করে দালাল মিডিয়া ও সরকারের স্তাবকরা সমস্ত দোষ জেনারেল আজিজ ও তার ভাইদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে, অথচ এই ট্রানজেকশনাল সম্পর্কের সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ।
৭। বর্তমান রেজিম মাফিয়াতন্ত্র কিনা বা শেখ হাসিনা মাফিয়া কিনা এইটা নিয়ে কিছু বাকোয়াজ কথা হচ্ছে। শেখ হাসিনা যে মাফিয়া পালতেন, পালেন, এবং পুষেন এইটা শুনে যারা আশ্চর্য হয় তারা হয় নাইভ অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা রাখেন না, না হয় অসৎ অর্থাৎ শেখ হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রের সুবিধাভোগী। শেখ হাসিনার মাফিয়া পোষা এবং মাফিয়া সর্দার হওয়ার ইতিহাস বহু পুরনো। যারা জানেন না তারা হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গ, লিয়াকত হোসেন, জয়নাল হাজারি, তাহের, নাসির, ওসমানসহ সারা বাংলাদেশে বহু টপ টেরর পোষার ইতিহাস তারা জানেন না। এই কিছুদিন আগেও শেখ হাসিনা জয়নাল হাজারিকে তার উপদেষ্টা বানিয়েছেন, এবং কেবল উপদেষ্টাই বানান নি, জনগণের তহবিল থেকে তাকে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা “চিকিৎসা খরচ” দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একটা বিষয় কনস্ট্যান্ট: শেখ হাসিনা ও তার এই পালিত মাফিয়াদের ট্রানজেকশনাল সম্পর্কটা টেকসই, অর্থাৎ কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না [সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া]। যেভাবে আহমেদ ক্ল্যান ও শেখ হাসিনা একে অপরকে ব্যবহার করেছে, ঠিক একইভাবে বাকীদেরও শেখ হাসিনা ব্যবহার করেছে, এবং সময় বুঝে প্রতিদানও দিয়েছে। এর ডিফেন্সে কেউ বলতে পারেন তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় এগুলোর হয়তো দরকার ছিলো। এ ধরনের যুক্তি হয়তো পুরোপুরি নাকচ করা যাবে না, কিন্তু তাতে সত্য নাই হয়ে যায় না। সত্য হচ্ছে এ ধরনের বহু গুণ্ডা, মাস্তান, দুর্নীতিবাজ লোক তিনি পালতেন, পুষতেন। প্রশ্ন উঠতে পারে এখনও পালেন? অবশ্যই! তবে ধরন বদলেছে। আগে পোষাক ছাড়া গুণ্ডা পালতেন, এখন পোষাক ধারী গুন্ডা। হারিস আল জাজিরার ডকুমেন্টারিতে যা বলেছেন তার একদণ্ডও মিথ্যে না যে এখন আর গুণ্ডা লাগে না, এখন র্যাব, পুলিশ, বিজিবি এই পোষাকধারী লোকজনই সে উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এদেরকে কেবল শেখ হাসিনাই ক্ষমতা ধরে রাখা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মারতে, ধরতে, গুম করে দিতে, ভয় দেখাতে ব্যবহার করেন না, বরং শেখ হাসিনার পালা ছোট মাফিয়া হারিসরাও এদেরকে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করেন বলে আমরা আল জাজিরার ডকুমেন্টারির মাধ্যমে জেনেছি [তার প্রতিপক্ষ সেলিম প্রধানকে র্যাব ব্যবহার করে ধরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা]। সুতরাং শেখ হাসিনা ও হারিসদের মধ্যে এখন এক ভয়াবহ আনহোলি এলায়েন্স তৈরি হয়েছে যে তারা রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে গুণ্ডা হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করেছে।
৮। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মধ্যে কেবল একটা বাহিনীকেই এখনো পুরোপুরি আয়ত্ত্বে আনা যায়নি, অর্থাৎ পুলিশ-বিজিবির মতো ছাত্রলীগের দলীয় ক্যাডার দিয়ে ভরে ফেলা যায়নি – সেটি সেনাবাহিনী। আপনার গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন যার কারণে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে তার সরকারের বড়-বড় সংকট মোকাবেলাতেও (যেমন, বিডিআর বিদ্রোহ, শাপলা চত্ত্বরের ঘটনা, ২০১৪ সালের ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবেলা) ব্যবহার করেননি। কারণ তিনি তার শাসন ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর অংশীদারত্ব তৈরি হোক এটি চাননি। যেসব লোকজন ২০০৭ সালের ঘটনা ঘটিয়েছে, অর্থাৎ যাদের অংশীদারত্ব ছিলো, তাদেরকে হয় বাহিনী থেকে বিদেয় দেওয়া হয়েছে (প্রেষণে, মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীদের মতো, কিংবা অবসরে পাঠিয়ে) অথবা কেউ আরো করুণ ভাগ্য বরণ করেছে। কিন্তু সেনাবাহিনীকে যেটি করা হয়েছে তা হলো তাদেরকে বিভিন্নভাবে অর্থকরি কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করে তাদের একটা অংশকে অর্থের লোভে বশীভূত করা হয়েছে। হাজার কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি, সেগুলোতে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করা, কিংবা সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তাকে প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের মাধ্যমে এই পেশাদার বাহিনীর মাঝে লোভ তৈরি করা হয়েছে যে “নিয়ন্ত্রণে” থাকলে “লাভবান” হওয়া যায়। সুতরাং একদিকে এটিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে সুকৌশলে দূরে রাখা হয়েছে, অন্যদিকে টাকা-কড়ির লোভ সাজিয়ে আরেকটা বড় অংশকে কো-অপ্ট করা হয়েছে। এই দুইয়ের সম্মিলনে থ্রেটটিকে নিউট্রাল করার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জেনারেল আজিজকে সামনে রেখে সামরিক বাহিনীকে পেরিফেরালি ব্যবহার করা হয়েছে – মূখ্যভাবে কোনো মতেই নয়। অর্থাৎ মাঠে সামরিক বাহিনীকে হাত-পা বেধে নামানো হয়েছে। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন যে তাদেরকে “হাত-পা বেধে সাতার কাটতে পাঠানো হয়েছে” – যার কারণে তারা দেখেছে যে রাতে ভোট হয়েছে কিন্তু তথাকথিত ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া তারা একপাও নড়তে পারেনি। সেনাবাহিনীর প্রথাগত মিশন কমান্ড, অর্থাৎ ফিল্ড অফিসাররা পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা [যেটিকে আমরা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বলছি], কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যার ফলে তাদের সাক্ষী গোপাল হয়ে নির্বাচনী ডাকাতি দেখা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিলো না।
৯। এত কিছুর পরও আমি লোকজনকে প্রায়শই বলি যে এই দুর্বৃত্তপরায়ন মাফিয়াতন্ত্র মাঝে-মাঝে যে একটু সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তে দেখা যায় তার কারণ সেনাবাহিনীকে এটি পুরোপুরি করায়ত্ত করতে পারেনি। এটি একটি অনির্বাচিত কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ শাসকের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। তাকে প্রতিনিয়ত দুঃস্বপ্নের মধ্যে থাকতে হয় যে কখন তার অবৈধ কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ হয়। এ ধরনের অস্বস্থি আমরা দেখেছি কক্সবাজারের এক মেজরের হত্যাকাণ্ড ও ঢাকায় এক নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়। কিন্তু তারা কি এই পরিস্থিতিও তাদের অনুকূলে আনতে কাজ করছে না? সম্ভবত, শুরু করেছে। এটি করতে হবে প্রথমত, নিয়োগ ব্যবস্থাকে ম্যানিপুলেট করে। দ্বিতীয় সংগঠিত প্রতিবাদের জায়গাগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে (রাওয়া ক্লাব ভেঙে দেওয়ার মতো)। আমি প্রায়শই বলি, যেকোনো দুর্বৃত্ত মাফিয়াতন্ত্র একটি নির্দিষ্ট সময় পেলে সুদীর্ঘ সময় শাসন করার কাঠামো ও বন্দোবস্ত তৈরি হয় এবং এই প্রক্রিয়াতেই বিশ্বের বহু দেশে কয়েক-দশক ব্যাপী স্বৈরশাসনের নজির আমরা দেখি। আমার বিশ্লেষণে বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আরো কয়েক বছর সময় পেলে তাদের এই স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ও বন্দোবস্ত পোক্ত হবে এবং তারা দীর্ঘমেয়াদী শাসনের দিকে এগিয়ে যাবে।