
ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবরটা সারা পৃথিবীতে তার অসংখ্য ফুটবল ভক্তের মনকে যেন বিষাদময় করে দিয়ে গেলো। যেকোনো মৃত্যুই নিতে পারি না। যদিও মৃত্যুই অমোঘ নিয়তি। মানুষের জীবনটাকেই যে কারণে বলি এক “বিষাদ সিন্ধু”! ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলোর জন্য আমরা কত লড়াই করি! কত বড়াই করি! সম্পদ-সম্পর্কের কত টানাপোড়ন! তথাপি, যদিও জানি মৃত্যুই গন্তব্য, তবু লড়াই জারি রাখতে হয়, লড়াই করতে হয়! এটিই জীবনের চিরন্তন দ্বন্দ্ব, এই ক্ষণিক সময়ের মোহে পড়ে যে টান, ভালোবাসা, ঘৃণা, মিলন-বিচ্ছেদ – এগুলোই মানব জীবনের সবচেয়ে বড় বিষাদ।
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মরে। কাছের, দূরের। কিন্তু কিছু মানুষ তাদের লেখা, কর্ম, ক্রীড়া, বিনোদনের মাধ্যমে আমাদের সময়গুলোকে উপভোগ্য করে তোলেন। তাই এঁদের মৃত্যুতে আমরা প্রিয়জন হারানোর শোক খুঁজে পাই। কিছুদিন আগে গায়ক এন্ড্রু কিশোর মারা গেলেন! তাঁর মৃত্যুতেও চিরচেনা বিষাদ খুঁজে পেয়েছি। তিনি যখন চিকিৎসার খরচের জন্য মানুষের দ্বারস্থ হচ্ছিলেন, তখন ভেবেছি – এই এন্ড্রু কিশোরের শত গান শুনে লক্ষ মানুষের বিষন্ন সময়গুলো কেটেছে! তাঁর সুরের জাদু দিয়ে কত কোটি মানুষের মন ভালো করে দিয়েছেন তিনি! এর আর্থিক মূল্য কী!
মানুষ টাকা দিয়ে বিনোদন কিনে! কিন্তু একান্ত অবসরে যে গান শুনে মানুষ বিষন্ন হয়, হাঁসে-কাঁদে, মন ভালো হয়ে যায় – এই সময়টুকু, জীবনের এই পরিবর্তনটুকুর মূল্য কি একজন শিল্পী পায়? যত মানুষ কিশোরের গান শুনে মন ভালো করেছেন, তাদের প্রতিজনের পক্ষ থেকে ১০ টাকাও এন্ড্রু কিশোরকে বিশ্বের সেরা হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিতে পারতো! কিন্তু দিনশেষে তিনি একজন রিক্ত শিল্পী হয়েই বিদায় নিলেন! যদিও আমাদের রাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রী আমাদের হয়ে এন্ড্রু কিশোরের কিছু দায়শোধ করতে চেষ্টা করেছেন।
ম্যারাডোনার খেলা দেখেও পৃথিবীর শত কোটি মানুষ মুগ্ধ আবেশে ছিলেন! কত মানুষের উল্লাস-উচ্ছ্বাসের কারণ ছিলো ম্যারোডোনার দুটি পা! কত মানুষকে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন! নেপোলি থেকে বুয়েন্স আয়ার্স! শহর থেকে পুরো জাতিকে হাসিয়েছেন, বিদায়ে শোকার্ত করেছেন!
পাশ্চাত্যে লেখক, খেলোয়াড় ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের এই অসাধারণ অবদানকে মানিটাইজ করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা এর অর্থমূল্য পান। যে কারণে একজন ফুটবলার রোনাল্ডো বা লিওনেল মেসির বেতনের পরিমাণ অবিশ্বাস্য। কিন্তু তাদের খেলা দেখে পৃথিবীর যত মানুষ আনন্দ পায়, তাদের আনন্দের প্রতিটি মূহূর্তকে মানিটাইজ করলে, আপনি বলবেন তাদের আরো বেশি বেতন পাওয়া উচিত!
একটা সমাজে লেখক, খেলোয়াড় ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা কতটুকু কদর পাবে তা নির্ভর করবে সে সমাজের মানুষের রুচি, চাহিদা, অগ্রাধিকারের উপর। এর সবগুলোর সাথেই অর্থের যোগ রয়েছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সংস্থানই তাদের কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার! তারা ফুলের ঘ্রাণ ভালোবাসে, কিন্তু যার মাথার উপর ছাদ নেই তার বাড়ির সামনে ফুলবাগান করার চিন্তা বিলাসীতা। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের অগ্রাধিকার এখনো আদিম। আমরা পরবর্তী দিনের খাবার, বাসার ভাড়া, চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির দুশ্চিন্তা নিয়ে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি।
আমাদের সরকারেরও অগ্রাধিকার এই সেবাগুলো দেওয়া নিয়ে। আমাদের রাস্তায় কেন পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের মত চমৎকার কারুকার্য খচিত ল্যাম্পপোস্ট নেই, কেন তাদের মতো পরিচ্ছন্ন চকচকে রাস্তা নেই এটি নিয়ে অনেকের আক্ষেপ দেখি। কিন্তু আমাদের সরকার তো আমাদের সকলের যোগফল। আমাদের বেশিরভাগ মানুষ যদি বাসার ছাদহীন হয়, তাদের নিকট যদি বাসার সামনের ফুলের বাগান বিলাসীতা হয়, আমাদের সরকারেরও তো তাই হবে! যে কারণে তারা উন্নয়ন বলতে নতুন রাস্তা বুঝে (পরিচ্ছন্ন রাস্তা না), ৫০ শয্যার হাসপাতালকে ১০০ শয্যায় রূপান্তর বুঝে, সেখানকার ডাক্তার-নার্সদের আচরণ-সেবার মান নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। আমাদের সরকারগুলো এখনো স্কুল ভবন করাকে, বছরের প্রথম দিন আমাদের শিশুদের হাতে নতুন বই পৌঁছে দেওয়াকে শিক্ষার সফলতা বিবেচনা করে, তারা ক্লাসরুমে কতটুকু শিখলো, কি মানের সময় ব্যয় করলো সেটি এখনো আমাদের অগ্রাধিকারে পৌঁছায়নি।
তবে আমি আশাবাদী যে একদিন আমাদের সমাজও স্বাবলম্বী হবে। একদিন আমাদেরকে আর তিনবেলা খাবার, মাথার উপর ছাদ, চিকিৎসা, শিক্ষার সুযোগ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না। সেদিন আমরাও বাড়ির সামনে বাগান করবো, সেদিন আমাদের এন্ড্রু কিশোররা একটা গানের জন্য কয়েক কোটি টাকা পাবে, আমাদের ফুটবলার জামাল-নজরুলরা এক মৌসুম খেলে শত কোটি টাকা আয় করবে। আমাদের তৃতীয় শ্রেণির একজন লেখককেও আর নিজের অর্থে বই প্রকাশ করতে হবে না, বরং সে কয়েক লক্ষ টাকা রয়্যালটি পাবে। একদিন আমরাও বড় হবো, নাদের আলী! আমাদেরও মাথা ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করবে! আমরাও নিজেদের বাড়ির বাগানের ফুলের ঘ্রাণ নিবো…