কতটুকু প্রকাশ করবো কিংবা কতটুকু উপেক্ষা করবো?

ছবির উৎস: socialconnectedness.org

পরিবার থেকে ছোট্ট দুটি শিক্ষা পেয়েছি। দুইটা শিক্ষাই গুরুত্বপূর্ণ। তার আলোকে বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে দুটি কথা বলবো:

১। কোনো মানুষকে কথা দিয়ে আঘাত না করতে চেষ্টা করা। অর্থাৎ কোন কথার কারণে যদি কেউ আহত হয়, সেটি পারতপক্ষে না বলার চেষ্টা করা। এটি সৌজন্যতার ন্যূনতম শিক্ষা। সেটি এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে হলেও। আমাদের মাঝে কেউ-কেউ ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে পুরো একটা জনগোষ্ঠীকে আহত করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এটি সেসব ব্যক্তির যতটা না বাকস্বাধীনতার চর্চা, তার চেয়ে বেশি আমি বলবো অপরের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীলতার পারিবারিক শিক্ষার ঘাটতি।

২। পিছন থেকে কেউ গালি দিলে ফিরে না তাকানো যাতে যে গালি দিয়েছে সে বুঝে যে খামোখা সময় নষ্ট করলাম আর আশপাশের মানুষ বুঝতে না পারে যে আসলে কাকে গালি দেওয়া হয়েছে।

দুটো শিক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেন গুরুত্বপূর্ণ? প্রথমত, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কোন স্থিরচিত্র নেই (ওই সময় কোন ক্যামেরা বা টেলিভিশন ছিলো না, কিংবা কেউ উনার জীবদ্দশায় উনার ছবি এঁকেছেন তারো কোন প্রমাণ নেই)। সুতরাং তিনি ঠিক কেমন সেটির যেহেতু কোন নির্দিষ্ট অবয়ব নেই সেহেতু একজন একটি কার্টুন এঁকে যদি বলে যে এটি তোমার নবীর, তাকে খুব সহজেই এ লড়াইয়ে পরাজিত করা যায় তার দাবীকে স্রেফ উপেক্ষা করে। একথা বলে যে তুমি যাকে এঁকেছো তিনি আমাদের নবী নন, আমাদের নবী এর চেয়ে ঢের সুন্দর! তার সাথে আমি যতই তর্কে যাবো, তাকে যতই আমি আক্রমণ করার চেষ্টা করবো সে ততই আরো কুৎসিতভাবে কিছু একটা এঁকে বলবে যে, নাও, ইনিই তোমাদের নবী! এ সুযোগটা তাকে দেওয়া উচিত কিনা সে বিবেচনাটি আমাদের হাতে।

দ্বিতীয়ত, আমরা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমাদের ব্যক্তিগত ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর বিভিন্ন ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদেরকে আমাদের ব্যক্তিগত স্পেস, পারিবারিক স্পেস ও সামাজিক স্পেসে চলাফেরা করতে হয়। এই প্রতিটি স্পেসে আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতার সাথে আমাদেরকে কিছু আপোষ করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত স্পেসে আমি কি খাবো, কি পরবো, কখন ঘুমাবো, কি সিনেমা দেখবো – প্রভৃতি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার স্বাধীনতা অনেকাংশেই নিরঙ্কুশ। কিন্তু এই ব্যক্তি আমিই যখন একটা পরিবারে বসবাস করি, তখনই আমাদেরকে ব্যক্তিগত অনেক পছন্দ-অপছন্দের সাথে আপোষ করতে হয়। বাসায় কখন ফিরবো তার সীমারেখা মেনে চলতে হয়। বাসায় সবাই মিলে কী খাবো সবার পছন্দের একটা ভারসাম্য মেনে রান্না হয়। বাসায় সবার সামনে কী ধরনের পোষাক পরবো, সে শালীনতার মানদণ্ড মেনে চলতে হয়। কি ধরনের আচরণ করবো (নিশ্চয়ই বাসার মুরুব্বিদের ন্যাংটা ছবি এঁকে তাদেরকে আমরা দেখাবো না) তার একটা সীমারেখা মেনে চলতে হয়।

তেমনিভাবে আমরা যখন একটা বৃহত্তর সমাজে বসবাস করি, সামাজিক জীব হিসেবে আমাদের এই কম্প্রোমাইজ, এই আপোষটা আরো বেশি করে করতে হয়। তখন এটিকে আমরা “পাবলিক নুইসেন্স” বলি – অর্থাৎ পাবলিক স্পেসে আমরা কতটুকু কী করতে পারবো বা পারবো না তার একটি সীমারেখা। এর কিছুটা আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ। কিছুটা সমাজের নর্মস, কাস্টমস, কনভেনশন দ্বারা সীমিত যেগুলো আবার সমাজ-সংস্কৃতি উদ্ভূত। যেমন, আমরা কোন রাস্তায় হর্ন দিবো, কোথায় ৩০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালাবো এগুলোতে আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা নয় বরং সমাজের প্রয়োজনে আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ। আবার পাবলিক প্লেসে কতটুকু শালীন পোশাক পরবো, ভালোবাসার কি ধরনের বা কতটুকু প্রকাশ ঘটাবো এগুলোর সীমারেখা সমাজের নর্মস ও কাস্টমস দ্বারা সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ বৃহত্তর সমাজে, যূথস্বার্থে আমরা আমাদের অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতায় সীমারেখা টানি – ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। কখনো বলি না যে আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে সুতরাং আমি যেখানে-সেখানে হর্ন বাজাবো, ১০০ কি.মি. বেগে গাড়ি চালাবো, পাবলিক প্লেসে যৌনতা করবো, কিংবা অফিসে অন্তর্বাস পরে যাবো। পৃথিবীর কোন সমাজেই আমরা তা পারি না।

এই যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আমরা যেসব ছাড় দেই সেগুলোর সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে সামষ্টিক কল্যাণ। অর্থাৎ সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কল্যাণে, স্বার্থে আমরা এই ছাড়টুকু দেই। সেই একই মানদণ্ডে ও যুক্তিতে বিশ্বের প্রায় দুইশ কোটি বিশ্বাসী মানুষ যেটিকে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের অংশ মনে করে যে মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকা তাদের ধর্মবিশ্বাসকে অপমান-অপদস্ত করার সমতূল্য, তো এই দুইশ কোটি লোকের বৃহত্তর সমাজের দিকে তাকিয়ে এই বিষয়ে ব্যঙ্গচিত্র না আঁকলে, তাদের প্রিয় মানুষটিকে খুঁচিয়ে গালাগালি না করলে কি খুব বেশি আপোষ করা হয়ে যাবে প্রিয় অবিশ্বাসী ভাই-ব্রাদারগণ? পরিবারের জন্য, সামাজিক জীব হিসেবে অনেক আপোষই করেন, ২০০ কোটি মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই ছোট্ট আপোষটুকু করলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?

আর প্রিয় বিশ্বাসী ভাই-ব্রাদারগণ, গালি দিলে পিছনে না তাকানোর চর্চাটাও জরুরি। উপেক্ষা করাটাও একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ। যদি ওইসব অসংবেদনশীল কাজ আপনারা উপেক্ষা করেন, তারা একসময় হাল ছেড়ে দিবে যে খামোখা লিখছি, বলছি – কিন্তু কেউ তো শুনছে না, রাগছে না, পাত্তা দিচ্ছে না তো! তারা এমনিতেই হাল ছেড়ে দিবে। তাদের বলার, লেখার বিষয় বদলাতে বাধ্য হবে।আসুন সবাই মিলে একটু সহিষ্ণু, একটু উদার, একটু দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন হই। সমাজটাকে সবার জন্য একটু বেশি বাসযোগ্য করে তুলি। ভালো থাকবেন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান