আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের ধারণা বনাম সহিংসতা ও মব জাস্টিস

ম্যাক্স ওয়েবার আধুনিক রাষ্ট্রের শর্ত হিসেবে (অন্যান্য শর্তের মধ্যে) রাষ্ট্রে সহিংসতার একক ও বৈধ কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের হাতে থাকার কথা বলেছেন। এবং সেটি বৈধ সহিংসতার কথা। অর্থাৎ আইন-আদালত-বিচার-ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই যূথস্বার্থে কিছু মানুষের অধিকার হরণ করা হয়, তাদেরকে আটকে রাখার মাধ্যমে তাদের অপরাধ পুনঃসংঘটনের সক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আইনের শাসনের কী অবস্থা? রাষ্ট্র যে সহিংসতা জারি রেখেছে সেটি কতটুকু বৈধ কিংবা কতটুকু অবৈধ? রাষ্ট্রের জারিকৃত বৈধ/অবৈধ সহিংসতায় জনগণের প্রতিক্রিয়া কী? এই আলোচনায় এই সব প্রশ্নই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে একে-ওকে দোষারোপের যে রাজনীতি, সেগুলো গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করবে কিন্তু সমস্যা সমাধান করবে না।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বছরে গড়ে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ গণপিটুনিতেই খুন হন। এর পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক খুনোখুনি, ধর্ষণ, ও বিভিন্ন অপকর্মের মচ্ছব তো রয়েছেই। একটা জনগোষ্ঠী সহিংস হয়ে ওঠার প্রবণতা কম-বেশি হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থাকতে পারে। তবে এটি ঠেকানোর সবচেয়ে বড় যে হাতিয়ার সেটি আইনের শাসন। কোন রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন থাকে, ন্যায়বিচার-অধিকারের ধারণা প্রোথিত থাকে, সেখানে মানুষের মাঝে সহিংস হয়ে ওঠার প্রবণতাও হ্রাস পাওয়ার কথা।

আমাদের দেশে কেন মানুষ দিনদিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে সে প্রশ্নের জবাবও নিশ্চয়ই এই রাষ্ট্রের আইনের শাসনের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে বাংলাদেশ সরকার গত ১০ বছরে দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে বিনা বিচারে খুন করেছে এবং পাঁচশরও বেশি মানুষকে গুম করেছে। এটি পত্রপত্রিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া। প্রকৃত চিত্র হয়তো আরো ভয়াবহ, বহুগুণ। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা থেকে আমরা জেনেছি শীতলক্ষা-বুড়িগঙ্গায় কাদের লাশ পাওয়া যায়। বহু লাশের খোঁজই স্বজনরা পায় না। এই যে রাষ্ট্র, সরকার ও তার বাহিনীগুলো নিজেই খুনী, নিজেই আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না এবং দিনেরাতে বিনাবিচারে মানুষ খুন করে আবার প্রতিনিয়ত মিথ্যা কথা বলে যায় (ক্রসফায়ারের গল্প), সেখানে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস কোথায় সেটি সহজেই অনুমেয়।

একটি সরকার যেখানে নিজেই নিজের বিচার ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে না পেরে বিনাবিচারে মানুষ খুনকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, সেখানে মানুষ কেন সেই বিচার ব্যবস্থায় আস্থা খুঁজে পাবে? সুতরাং তারা আস্থা খুঁজে পায় না, এবং সুযোগ পেলেই আইন হাতে তুলে নেয়। খুন করে। হ্যাঁ, তারই মতো আরেকজন অধিকারহীন মানুষকেই তারা খুন করে। এই ধরনের প্রতিটি সহিংসতা ও খুন সমাজ-রাষ্ট্রের বিচারহীনতারই মূর্ত প্রতীক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে ভয়াবহ অবক্ষয় ও ধ্বস নেমেছে সেটি থামানো না গেলে এই পরিস্থিতির উন্নতি নয়, বরং আরো কঠিন অবনতির জন্য প্রস্তুত থাকুন।

প্রিয় দেশবাসী, এই অন্যায়, অবিচার, বিচারহীনতার যে মচ্ছব চলছে তার গোড়ায় হাত দিন। যে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদেরকে আপনারা টাকা দিয়ে পুষছেন, যারা সমাজে ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন নিশ্চিত করার কথা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার কথা, তা না করে নিজেরাই বেআইনী কাজ করে যাচ্ছে, তাদের ব্যর্থতার দিকে অঙ্গুলি হেলন করুন… যে রাষ্ট্র-সরকার নিজেই হত্যাকারী, হত্যাকে উৎসাহিত করে, বিচারহীনতা-অধিকারহীনতার উৎস, সে রাষ্ট্রে ভিন্ন কিছু আশা করেন কিভাবে?

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান