
কিভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে খুবই সুপরিকল্পিতভাবে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারি রাজনীতি কায়েম ও পোক্ত করা হয়েছে এ নিয়ে একটি লম্বা কাজ করছিলাম (জানি না কখনো প্রকাশ পাবে কিনা)। তো সেখানে ছোট্ট একটি সেকশন হচ্ছে বাংলাদেশের ফুটবল এবং কিভাবে ঐতিহ্যবাহী আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথকে ভেঙে দেওয়া এবং বিরোধী মতপথের ক্রীড়া সংগঠক ও স্পন্সরদের কোণঠাসা করার মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনেও একতরফা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এবং এটি কেন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৯০-পরবর্তী গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কালে যে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠে তার প্রভাব বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার প্রায় সর্বক্ষেত্রে গড়ে উঠে। ব্যবসায়ী সংগঠন, আইনজীবি সমিতি, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের সমিতিসহ নানা পেশাজীবি পরিষদে, ক্রীড়াঙ্গনে, সিনেমা-নাটক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, সর্বত্র আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-পন্থী সংগঠন গড়ে উঠে। এর একটি সুস্থ দিক ছিলো সমাজে রাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা পাওয়া। যেকোনো সুপ্ত স্বৈরাচারের জন্য এ ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ কাম্য নয়। সে কারণে ২০০৯-সাল পরবর্তী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সচেতনভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে বেড়ে উঠা এই ডাইকোটোমিকে ভেঙে দিতে সচেষ্ট হন। যার মাধ্যমে, আমার মতে, এটি তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে তিনি দীর্ঘ মেয়াদী একটি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্ত হচ্ছেন।
যেমন, ব্যবসায়ী শ্রেণির মধ্যেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-পন্থী দুটো ধারা গড়ে উঠে এবং এর প্রতিফলন ছিলো এফবিসিসিআই ও অন্যান্য ব্যবসায়ী পরিষদ নির্বাচনগুলোতে। একবার এ পক্ষ জিততো তো পরের বার অন্যপক্ষ। একই প্রবণতা ছিলো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবি সমিতি – প্রায় সর্বত্র। তো সেখানে এসব নির্বাচনগুলোর বেশিরভাগকে এখন এমনভাবে ম্যানিপুলেট করা হলো যে সেখানে এখন কেবল একটি প্যানেলই নাকি দাড়ায়। বাকী প্রতিদ্বন্দ্বীরা নাকি “সরে যায়”। অথবা তাদের সরতে বাধ্য করা হয়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিএনপিপন্থী সাংস্কৃতিক কর্মীদের হেন হয়রানি নেই করা হয় নাই। তাদের রুটি-রুজি বন্ধে যথেচ্ছ ও নিম্নরূচির হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। শহরে-গঞ্জে তাদের স্টেজ শো বাতিল করতে স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়েছে, নাটকে-টিভিতে তাদেরকে না নিতে মালিক-প্রশাসকদের বলা হয়েছে। এখন আর কোন শিল্পী ভয়ে বলতেই চায় না যে সে বিএনপি করে। এভাবে সর্বত্র দ্বি-দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীতার যে গণতান্ত্রিক কাঠামো ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে গড়ে উঠেছিলো সেগুলোকে এক-এক করে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। একমাত্র আইনজীবি সমিতিগুলোতে কিছুটা প্রতিরোধ এখনো বিদ্যমান।
ক্রীড়াঙ্গনে এটি করা হয়েছে দুটি উপায়ে। প্রথমত, তারা আওয়ামী-পন্থী একাধিক ক্লাব তৈরি, সেগুলোতে বড় আকারে স্পন্সরশীপের জোগান দেওয়া, এবং অন্যান্য সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সেগুলোকে সামনের সারিতে নিয়ে আসে। যেমন, আগে কেবল আবাহনী ছিলো, সেখানে এখন শেখ রাসেল, শেখ জামাল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দ্বিতীয় উপায়টি হচ্ছে, বিরোধী-পন্থী ক্লাবগুলোকে আঘাত করার মাধ্যমে। বিরোধী মতপথের ক্লাবগুলোকে নানান কায়দায় দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে, যেমন, স্পন্সরদের ক্লাব দূরে সরিয়ে দেওয়া, এসব ক্লাবে আরোপিত নেতৃত্বের সংকট তৈরি প্রভৃতি। এর মাধ্যমে এই ক্লাবগুলোকে ক্রীড়াঙ্গনে শক্তিশালী দল গড়তে নানা প্রচ্ছন্ন বাধা তৈরি করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে এদেরকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনে একদা আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ ছিলো আওয়ামীলীগ ও আওয়ামীলীগ-বিরোধী রাজনীতির একটি সম্প্রসারিত প্রতিদ্বন্দ্বীতার ক্ষেত্র। কিন্তু একদা দোর্দণ্ড প্রতাপের এই মোহামেডান ক্লাবকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে। এই ক্লাবের নেতৃত্বকে আপোষে বাধ্য করার মাধ্যমে ক্লাবটিতে স্পন্সরশীপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে যাতে ক্লাবটি টাকার অভাবে দুর্বল দল গড়তে বাধ্য হয় এবং মূল ধারা থেকে সটকে পড়ে। এর মাধ্যমে যাতে ক্লাবটিকে ঘিরে আওয়ামীলীগ-বিএনপির যে ডাইকোটোমি (আবাহনী-মোহামেডান) সেটি ভেঙে দেওয়া যায়। তাদের এই প্রকল্প সফল হয়।
ক্রীড়াঙ্গনে স্বৈরাচারি থাবা প্রতিষ্ঠার এই প্রকল্পেরই আরেকটি সংস্করণ হচ্ছে বাফুফের ও বিসিবিতে স্বেচ্ছাচারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ফিফার শর্তের কারণে বাফুফেতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকায় সেখানে এমনভাবে নির্বাচন সাজানো হয় যেখানে কিছু লোকের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় এবং এসব প্রতিষ্ঠানেরও গণতান্ত্রিক চরিত্র নষ্ট হয়। এর সফল প্রয়োগের পরিণতিই হচ্ছে এক প্যানেলের নির্বাচন, অর্থাৎ সালাউদ্দিন প্যানেলের বাইরে নাকি জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার লোক পাওয়া যায় না! গভীরভাবে বিভক্ত বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটি একটি ঠুনকো ও অপরাধকে আড়াল করার যুক্তি। আসল কথা হচ্ছে যারা মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের জোর করিয়ে, ভয় দেখিয়ে, আপোষ করতে বাধ্য করা হয় এবং মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয় (যেমনটি, এফবিসিসিআই-তে করা হয়)। এই প্রক্রিয়াতেই এবারও বাফুফে নির্বাচনে বাদল রায়ের প্যানেলকে জোর করিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সালাউদ্দিন সাহেব যে প্রায় বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বারবার নির্বাচিত হন, এর কারণ তার তথাকথিত জনপ্রিয়তা নয়, এসব নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। রাষ্ট্র ও সমাজে ঝেঁকে বসা স্বৈরতান্ত্রিক অসুখের আরেক নামই ফুটবলার সালাউদ্দিন।
পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে স্বৈরাচারি রাজনীতি ঝেঁকে বসেছে সেটিকে পোক্ত করার পদক্ষেপ হিসেবেই রাষ্ট্র ও সমাজে গণতন্ত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বীতার স্থানগুলোকে অত্যন্ত সচেতনভাবে আঘাত করা হয়েছে এবং সেগুলোর গণতান্ত্রিক চরিত্র নষ্ট করা হয়েছে। এসব অপরাজনীতি কি টেকসই? সে প্রশ্নের উত্তর আরেক দিন দিবো।