
বন্ধুমহলে আমরা প্রায়শই উগান্ডা নামক কাল্পনিক একটি সমাজে জেঁকে বসা স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। তো সেখানে বন্ধুদের যে প্রশ্নটি আমাকে প্রায়ই মোকাবেলা করতে হয় সেটি হলো – এ ধরনের স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলগুলোর কী করণীয়? বা চরম দমনপীড়নের মুখে তাদের আদৌ কোন করণীয় রয়েছে কিনা? তাদের কী ধরনের রাজনীতি করা উচিত? কিভাবে স্বৈরাচারকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব? এবং চূড়ান্ত বিচারে কীভাবে স্বৈরাচারকে উৎখাত করে একটি জন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব? এই সব প্রশ্নই মূলত কৌশল সংক্রান্ত। যেকারণে আজকে আমি উগান্ডার স্বৈরশাসন মোকাবেলার কিছু কৌশল তুলে ধরছি।
উগান্ডা রাষ্ট্রে জেঁকে বসা স্বৈরাচারকে মোকাবেলা আমার বিস্তারিত চিন্তা ও কাজ রয়েছে। সেখান থেকে আমি নিম্নোক্ত ৯টি কৌশলের সারসংক্ষেপ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরছি। এটি একটি লিভিং ডকুমেন্ট, উগান্ডার কাল্পনিক স্বৈরশাসনকে কিভাবে ধরাশায়ী করা যায় এ বিষয়ে পাঠকদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা থাকলে এর সাথে যুক্ত করতে পারেন।
প্রথমে আমরা একটি পূর্বানুমান পরিষ্কার করে নেই। সেটি হচ্ছে, একটি স্বৈরাচারী সরকার স্বাভাবিক নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে অপসারিত হবে না। নির্বাচন তাদের কাছে ছদ্ম-বৈধতা আদায়ের একটি “প্রক্রিয়া” মাত্র। স্বৈরাচার যেহেতু মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতা দখল করে থাকে, সেহেতু কোন নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটিকে হটাতে পারার কথাও নয়। যারা মনে করেন স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় উগান্ডার স্বৈরশাসককে হটানো যাবে, তাদের জন্য এই লেখা নয়।
উগান্ডার স্বৈরাচারী সরকারকে মোকাবেলার ৯টি রাজনৈতিক কৌশল:
কৌশল ১: “দালাল” মিডিয়ার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা ও প্রশ্নবিদ্ধ করা
এই শর্তটিকে প্রথমে রাখলাম কারণ জনগণের মধ্যে সম্মতি উৎপাদনের কার্যকর মেশিন হচ্ছে “দালাল” মিডিয়া এবং এটিকে পোষ মানিয়েই স্বৈরাচাররা ক্ষমতায় টিকে থাকে। উগান্ডার ক্ষেত্রেও এটিই সত্য। আপনি যখন জানেন যে, উগান্ডায় এক দল “দালাল” মিডিয়া হাউজ রয়েছে যাদের হয় মালিকানা সরকার দলীয় নেতাদের নয়তো সরকারি সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী শ্রেণির, অথবা দমন-পীড়নের ভয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চুপসে যাওয়া আপোসকামী মালিক ও সাংবাদিকদের। কিছু স্বতন্ত্র মিডিয়া প্রতিষ্ঠানও রয়েছে যারা নানামূখী চাপে কোনপ্রকার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। এই পরিস্থিতিতে আপনি বিদ্যমান “দালাল” মিডিয়ার বৈধতা জারি রেখে উগান্ডার স্বৈরাচারকে হঠানোর স্বপ্ন দেখা হঠকারিতা। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলনে যাওয়ার অর্থ হলো, আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দালাল মিডিয়া আপনার পিঠে ছুরি মারবে, সরকারি চাপে সংবাদ ব্ল্যাক আউট করে দিবে, কিংবা সমস্বরে সরকারি প্রোপাগাণ্ডা চালাবে। আপনি যেহেতু তাদের বৈধতা ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেননি, সুতরাং জনগণের একটা বড় অংশ তাদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে আপনার আন্দোলনকে বিভিন্ন চক্রান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং একটি স্বৈরাচারি, নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আন্দোলনে যাওয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে আপনাকে বিদ্যমান “দালাল” মিডিয়াগুলোর সমস্ত বৈধতা নষ্ট করে দিতে হবে। এটি কিভাবে করবেন? প্রথমত, আপনাকে “দালাল” মিডিয়ার একটি তালিকা প্রকাশ করে দিতে হবে এবং ক্রমাগত বলতে হবে যে এসব মিডিয়া সরকারের দালাল এবং দেশের সংকটপূর্ণ মুহূর্তে স্বৈরশাসকেরই দালালী করবে, সুতরাং এদের কথা সংবাদ বা বিশ্লেষণ আপনারা বিশ্বাস করবেন না। এ কথা অনবরত বলে যেতে হবে। উগান্ডার সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনকে একটি ক্লাসিক উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে যে, যেখানে সারাদেশের মানুষ দেখেছে যে রাতের অন্ধকারে ও দিনের আলোতে ভোট ডাকাতি হয়েছে, সেখানে “দালাল” মিডিয়া সরকারি ভাষ্যের বাইরে যায়নি, বরং সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছে যে সুন্দর, নিরবচ্ছিন্ন ভোট হয়েছে। অর্থাৎ আপনার আন্দোলন ঘনিয়ে আসলেও কিংবা এই সরকারের পতনের ঘণ্টা ধ্বনি বাজার মুহূর্তেও কোলাবেরটর বা ভীতু মিডিয়া এই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখবে। কিন্তু “দালাল” মিডিয়ার বৈধতা নষ্ট করে দিলে জনগণ তখন মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে থাকবে যে এসব আপোষকামী গণমাধ্যমের খবরে বিশ্বাস করা যাবে না। সুতরাং তারা সংবাদ ও খবরের বিকল্প মাধ্যমগুলোতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি বিকল্প হতে পারে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ (সাপ্রেস) করা হতে পারে ধরে নিয়ে হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সের আদলে নন-ইলেকট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হ্যাঁ “দালাল” মিডিয়ার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করলে স্বতন্ত্র কিছু মিডিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা তাদেরও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হতে পারে। এটিকে কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কারণ এটি না করার ট্রেড অফ খুব বেশি।
কৌশল ২: এলাকা-ভিত্তিক বিকেন্দ্রীভূত একাধিক কিংবা বহু সমন্বয়ক তৈরি
যেহেতু উগান্ডার স্বৈরাচারি সরকারের লক্ষ্য দীর্ঘমেয়াদে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা, সেহেতু তারা কোনোভাবেই শক্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধী গড়ে উঠুক সেটি চাইবে না বা হতে দিবে না। যারাই শক্ত প্রতিদ্বন্ধীতা গড়ে তুলতে চাইবে তাদেরকেই হয় আপোষ করতে (বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে) অথবা জেল-জুলুম মেনে নিতে বাধ্য করবে। এটিকে মাথায় রেখে, অনিয়ন রিং স্ট্রাটেজির আদলে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় একাধিক সমন্বয়ককে এমনভাবে স্বতন্ত্র উপায়ে কাজ করার দায়িত্ব দিতে হবে যাতে যেকোন একজন বা একাধিক সমন্বয়ককে গ্রেফতার করলেও অন্য সমন্বয়কদের কাজে বিঘ্ন ঘটা ছাড়াই কাজ চলবে। এক সমন্বয়কের সাথে অন্য সমন্বয়কের কোন সুস্পষ্ট লাইন অব কমিউনিকেশন বা সম্পর্ক না থাকার ফলে তারা একে অপর থেকে পুরোপুরি স্বতন্ত্র উপায়ে কাজ করবে এবং একজন গ্রেফতার হলেও তিনি যেহেতু অপর সমন্বয়কের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানেন না, সেহেতু তিনি বাকী নেটওয়ার্ককে এক্সপোজ করতে পারবেন না।
কৌশল ৩: ছদ্ম দ্বন্দ্ব তৈরি করা
উগান্ডার অতি ধুরন্ধর স্বৈরশাসককে মোকাবেলার অংশ হিসেবে তাকে ধোকা দিতে হবে। অর্থাৎ রাজনীতির মাঠে নিজেদের মধ্যে ছায়া/ ছদ্ম দ্বন্দ্ব বা বিরোধীতা তৈরি করতে হবে যেখানে পরস্পরবিরোধী একাধিক গ্রুপ রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থাকবে। এই ছদ্ম দ্বন্দ্বটি বেশ কিউরেটেড এবং কন্ট্রোলড, অর্থাৎ কেবল সমন্বয়কদের সমন্বয়ক এটি জানবেন। এর মাধ্যমে উগান্ডার নিপীড়নবাদী ব্যবস্থাকে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত করা যাবে। কারণ নিজেদের এই ছদ্ম বিরোধীতা ও দ্বন্দ্বের সাথে স্বৈরাচারের বিভিন্ন পক্ষের রাজনৈতিক বোঝাপড়া গড়ে তুলতে হবে এবং সেখানে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিতে হবে। প্রতিটি ইউনিটের সকল সমন্বয়ক কেন্দ্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণ পাবে কিভাবে বিরূপ পরিস্থিতিতে সংগঠন করা যায়, কিভাবে শাসকদলের মেশিনারি ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কো-অপ্ট করে (স্থানীয় দ্বন্ধকে কাজে লাগিয়ে, বা “যেকোনো” উপায়ে) স্বীয় কার্যক্রম চালানো যায় – এসব বিষয়ে বিস্তারিত কৌশল প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উগান্ডার মতো একটি নিপীড়নমূলক স্বৈরাচারি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি জটিল গোয়েন্দা সংস্থার কাঠামোয় বা আদলে কাজ করতে হবে। সে ধরনের সকল কৌশল ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
কৌশল ৪: উগান্ডার রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া
ত্বড়িৎ জনসমাগম ও বিপুল মানুষের সমাবেশ ঘটাতে রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলো সবসময়ই এবং ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি অনেকটা মাও সেতুং-এর গ্রাম দিয়ে শহর দখল করার কৌশলের অনুরূপ। উগান্ডার স্বৈরশাসক এই পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর বিরোধী দলীয় রাজনীতিকে খুবই সুকৌশলে ও সফলভাবে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। এ কাজটি তারা করেছে বিরোধী দলের তৎপর ও যোগ্য নেতাদের হয় আপোষে বাধ্য করে (ব্যবসায়িক ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা দিয়ে) নতুবা দমন-পীড়নের মাধ্যমে। অর্থাৎ যারা আপোষ করেনি, তাদেরকে জেলে থাকতে হয়েছে, শত-শত মামলার ঘানি টানতে হয়েছে। কিন্তু গণ-আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে উগান্ডার রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিতে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জেলাগুলোর সংগঠন গড়ে তুলতে কিংবা শক্তিশালী করতে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে বিশেষ নজর দিতে হবে। অর্থাৎ শুধু এ বিষয়টির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষ সেল থাকবে। এই জেলাগুলোতে একাধিক শ্যাডো বা ছায়া কমিটি গঠনের মাধ্যমে নিপীড়কদেরকে বিভ্রান্ত করতে হবে। এবং সমন্বয়করা শ্যাডো বা ছায়া কমিটিগুলোর মাধ্যমে স্বৈরাচারি প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করার কৌশল আয়ত্ব করবেন বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। এছাড়া নিপীড়কদের একটা অংশকে কৌশলে ও গোপনে করায়ত্ত্ব করতে হবে (যেকোনো উপায়ে)। উগান্ডার রাজধানীর চারপাশের জেলাগুলোতে শক্তিশালী রাজনীতি গড়ে তোলা কৌশল হিসেবে অপরিহার্য।
কৌশল ৫: রাজধানীতে সরকারি দলের সংগঠনে অনুপ্রবেশ
স্বৈরাচাররা সাধারণত রাজধানীকে যুদ্ধের আদলে পাহারা দিয়ে রাখে। যার ফলে এই দুর্ভেদ্য পাহারা ভেদ করে বিরোধী রাজনীতি সংগঠিত করা করা অত্যন্ত কঠিন। উগান্ডার সরকারও রাজধানীকে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটিকে দুর্গের মতো দখল করে রেখেছে। তথাপি, স্বৈরাচারের এই দুর্দমনীয় শক্তিকেই তাদের দুর্বলতা হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। এটি করতে হবে রাজধানীতে স্বৈরাচারের মূল সংগঠন ও শাখা সংগঠনগুলোতে ব্যাপকহারে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ওই সংগঠনকে কব্জায় নিয়ে বা উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে। এটি সম্ভব হলেই নিজস্ব সংগঠন বিস্তারের কাজ চালানো সম্ভব।
কৌশল ৬: সিভিল-মিলিটারি প্রশাসন নিউট্রালাইজ করা
উগান্ডার স্বৈরাচারি শাসকের প্রধান সাফল্য রাষ্ট্রের সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনকে ব্যবহার করে রাজনীতির উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। শুরুর দিকে প্রশাসন সোৎসাহে এটি করলেও, ধীরে ধীরে প্রশাসনে জড়তা ও ফ্যাটিগ চলে আসে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেই ভাগবটোয়ারা নিয়ে দ্বন্ধ ও বিভাজন ছড়িয়ে পড়ে। এই ইন্টারনাল ইনকন্সিসটেন্সি বা আভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যকে পুরোদস্তুর কাজে লাগাতে হবে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ও শাখায় সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ দ্বন্ধগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এই বিভাজনের মধ্য দিয়েই প্রশাসন ফ্রন্টে অনুপ্রবেশ ও সেটিকে ক্রমান্বয়ে নানাবিধ কৌশলে নিউট্রালাইজ করা সম্ভব।
কৌশল ৭: কাউন্টার স্যাবোটাজ
স্বৈরাচারি শাসকদের একটি বড় অস্ত্র স্যাবোটাজ করা। তারা রাজনীতির মাঠে এই অস্ত্র অহরহ ব্যবহার করে সাফল্য পায় এবং বিরোধী রাজনীতিকে বিভ্রান্ত, পর্যুদস্ত ও ক্রমান্বয়ে দুর্বল করে। এটি করার নানা কৌশল রয়েছে। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় এটিকে সেন্সর করা হলো। উগান্ডার স্বৈরাচারকে তার টার্ফেই আঘাত করতে হবে, তার কৌশল দিয়েই।
কৌশল ৮: বিকল্প ক্যালেন্ডার তৈরি
উগান্ডায় বছরব্যাপী কী কী কর্ম ও অপকর্ম করা হবে তার বিস্তারিত সূচি উগান্ডার স্বৈরশাসকের টেবিলে থাকে। বছরে কোন দিবসে কী ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটাতে হবে, কোন চুক্তির সময় কোন দেশের খেলোয়াড় নিয়ে আসতে হবে, বিরোধী দলের কোন কর্মসূচির সময় কোন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে এগুলোর বিস্তারিত সূচিত উগান্ডার স্বৈরশাসক তৈরি ও সংরক্ষণ করেন। এছাড়া হঠাৎ কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে কোন ঘটনা দিয়ে সেটি ধামাচাপা দিতে হবে এগুলোর একাধিক পরিকল্পনা উগান্ডার শাসকের রয়েছে। এই যে মাল্টিডাইমেনশনাল কন্টিজেন্সি এন্ড কমিউনিকেশন স্ট্রাটেজি, এটি একটি সংগঠিত স্বৈরাচারি রাজনীতির স্বরূপ। এটিকে টেক্কা দিতে হলে বিরোধীদের একইরকম বিকল্প ক্যালেন্ডার তৈরি থাকতে হবে, অর্থাৎ বছরব্যাপী স্বৈরাচারের সম্ভাব্য ইভেন্টগুলোকে জানতে হবে এবং সেগুলোকে কোন কৌশলে, কিভাবে সাপ্রেস করা যায় তার বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। কখনো কখনো “offense is the best defense” নীতি প্রয়োগে প্রস্তুত থাকতে হবে।
কৌশল ৯: স্ট্রাইকিং হোয়াইল দ্যা আয়রন ইজ হট (সময়মতো আঘাত করা)
সময়মতো চূড়ান্ত আঘাত করতে হবে। এখন এই সময়টা ঠিক কখন সেটি বিস্তারিত পরিকল্পনা, বিকল্প পরিকল্পনা ও এক্সিট স্ট্র্যাটেজির অংশ। এসব পরিকল্পনা ছাড়া কোনভাবেই চূড়ান্ত পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না। উগান্ডার স্বৈরাচারকে চূড়ান্ত আঘাত করার জন্য একাধিক পরিকল্পনা এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিদেশী বন্ধু – সকল পক্ষকে কিভাবে কখন মোবিলাইজ করা হবে তার বিস্তারিত একাধিক পরিকল্পনা, বিকল্প পরিকল্পনা ও এক্সিট স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করতে হবে। স্বৈরাচার যেহেতু রাষ্ট্রের সমস্ত রিসোর্স নিয়ে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে সেহেতু, চূড়ান্ত পরিকল্পনার পূর্বে স্বৈরাচারের দুর্গে ফাটল ধরানো আবশ্যক। লড়াই পরিকল্পনায় প্রতিপক্ষের কারা মীরজাফরের মতো যুদ্ধের ময়দানে দাড়িয়ে থাকবে কারা সহযোগিতা করবে তার বিস্তারিত ছক আবশ্যক। ওয়ার প্ল্যান তৈরি শেষে স্বৈরাচারকে চূড়ান্ত আঘাতের পূর্বে অর্থাৎ মূল লড়াইয়ের পূর্বে ছোট-ছোট ব্যাটল পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে যাতে মূল লড়াইয়ের আগে ক্ষয়িষ্ণু শক্তির মোকাবেলা করতে হয়। একটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি, মাঠে স্বতন্ত্র ক্রীড়নক কারা কখন কোন ময়দানে থাকবে, কারা ডাইভারশানে থাকবে, কারা স্ট্রাইকিংয়ে – এসব পরিকল্পনার সফিস্টিকেশন চূড়ান্ত লড়াই সফল হওয়ার রসদ। পরিশেষে চূড়ান্ত লড়াইয়ে যেটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো এক্সিট স্ট্র্যাটেজি থাকা। অর্থাৎ যেকোনো পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে সম্মানজনক এক্সিট কী সেটি আগে থেকেই বিবেচনায় নেওয়া (অনেকটা যুদ্ধবিরতির মতো) এবং সে যুদ্ধবিরতির ব্রোকার কারা সেটিও পরিকল্পনার অংশ।
একটি ধূর্ত ও নৃশংস স্বৈরাচারের সাথে লড়াই করা যুদ্ধের সমতুল্য, সুতরাং যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু মনে করে তার সাথে লড়তে যাওয়া মানে প্রকৃতপক্ষে স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে আবির্ভুত হওয়া।
ডিসক্লেইমার: দুনিয়ার কোন কৌশলই কোন স্বৈরাচার হটাতে কার্যকর হবে না যদি সে দেশে: (১) সঠিক রাজনীতির উপস্থিতি না থাকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক নীতি, আদর্শ, ও কাঙ্ক্ষিত নীতি পরিবর্তনগুলো জনগণকে আকৃষ্ট করছে কিনা, তাদের নিকট সেগুলো স্পষ্ট, বোধগম্য উপায়ে তুলে ধরা গেছে কিনা, এবং এর ফলে জনগণের মাঝে নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে কিনা। (২) আসন্ন পরিবর্তন যে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থের অনুকূলে এই বিশ্বাস জনগণের মাঝে তৈরি করা গেছে কিনা; এবং (৩) নেতৃত্বের উপর জন-আস্থা রয়েছে কিনা। সঠিক নীতি-বিশ্বাস-নেতৃত্ব না থাকলে কোন কৌশলেই উগান্ডার স্বৈরাচারকে রাজনৈতিকভাবে পরাভূত করা যাবে না। তার মানে এই নয় যে স্বৈরশাসক আজীবন থাকবে। গণ-আন্দোলন সফল না হলেও বিকল্প অনেক কিছু হতে পারে। সেটি ভিন্ন আলোচনা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উগান্ডা একটি কাল্পনিক সমাজব্যবস্থা (আফ্রিকার দেশ “উগান্ডা” নয়)। সুতরাং এই আলোচনাটিকে অনুগ্রহ করে কোন দেশ বা রাষ্ট্রের সাথে মিলাবেন না। কোন রাষ্ট্রের কোন বিশেষ পরিস্থিতির সাথে এ আলোচনাটি মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।