
আমাদের একদল “আধুনিক” মানুষ ধর্মকে মনে করেন গোঁড়ামি, কুসংস্কার, পিছিয়ে পড়া চিন্তা, মানুষের অধিকার হরণ – ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি মনে করি এ ধরনের চিন্তার পিছনে চিন্তার গভীরতার ঘাটতি, ইতিহাস-বিমূখতা, এবং মানুষের সংগঠিত লড়াইয়ের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করার প্রবণতা বিদ্যমান। এগুলোর কোনটিই বিজ্ঞানমনস্ক বলে দাবী করা মানুষের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনার কার্যকারণ রয়েছে। প্রতিটি ধর্মের উত্থানের সাথেও এক বিস্তার ইতিহাসের সংযোগ রয়েছে। মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে। দুই হাজার বছর পূর্বে যিশু যখন মানুষের মুক্তির দূত, তিনি কী কেবলই ঈশ্বরের বাণী নিয়ে এসেছেন? না তিনি তখনকার নিপীড়ত মানুষের অধিকারের লড়াই করেছেন। মানুষের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে মার খেয়েছেন, ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন।
মুহাম্মদ (সা.) দেড় হাজার বছর পূর্বে যে সমাজে জন্ম নিয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন, যেটিকে জাহেলিয়ার যুগ বলা হতো, যেখানে কণ্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, যে সময়ে পুরুষরা শত বিবাহ করতে পারতো, নারীদের ন্যূনতম মর্যাদা বলতে কিছু ছিলো না, সেই সমাজে বসে প্রথম সন্তান কণ্যা হলে তা মর্যাদাকর, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত, চারটির বেশি বিয়ে করা যাবে না (তাও if there is a fear of being unjust to non-married orphan girls and the husband is required to treat all wives equally) – এসব দুঃসাহসী অবস্থান নেওয়া তৎকালীণ সামাজিক বিবেচনায় কতটুকু বিপ্লবাত্মক এই ঐতিহাসিক বিবেচনাটুকু না থাকলে মুহাম্মদ (সা.)-কে ভিলেন কেন আরো খারাপ কিছু হিসেবে চিত্রায়িত করা সহজ। কিন্তু এতে নিজেদের অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়।
আজকের যারা আর্মচেয়ার বুদ্ধিজীবি, যারা নিজের ডেস্কের কম্পিউটারের কী বোর্ডে বসে মানুষের অধিকার আদায় করে ফেলতে চান, তারা যদি প্রতিটি ধর্মের ইভোলিউশন বা বিকাশ সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করতেন, তাহলে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিতভাবে পুনর্বিবেচনা করতেন। ধর্মবেত্তারা একই সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছেন। তারা মানুষের অধিকার, সামাজিক আইনের যে কাঠামো গড়ে দিয়ে গেছেন তার উপর দাড়িয়ে পৃথিবীতে ন্যায়-অন্যায়, মোরালিটি, সামাজিক সম্পর্ক, রাষ্ট্র ও সমাজের অনেক মৌলিক কাঠামো দাড়িয়ে আছে। যারা ধর্মকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে নিজেদেরকে খুব জ্ঞানী জাহির করেন তারা প্রকৃতপ্রস্তাবে মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসই ঠিকমতো পড়েন নি। ধর্মবেত্তারা যে কেবল মানুষের সমাজের আইনী ও অধিকারের কাঠামোই ঠিক করে দিয়েছেন তা নয়, তারা মাঠের লড়াইয়েও সম্মুখসারিতে ছিলেন। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মার খেয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ধর্মবেত্তাদের এই অবদান জানলে এই আর্মচেয়ার পণ্ডিতরা তাদের অত্যন্ত অসংবেদনশীল অবস্থানগুলো পুনর্বিবেচনা করতেন।
দেড় হাজার বছর পর বসে আপনি যেটিকে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বলছেন, দেড় হাজার বছর পূর্বে এই ধর্মবেত্তারাই ছিলো সবচেয়ে আধুনিক মানুষ, সময়ের চেয়ে শতগুণ এগিয়ে থাকা, মানুষের অধিকারের পক্ষে লড়াই করা দুর্বিনীত মানুষ। আপনি যদি এমনকি স্রষ্টায় বিশ্বাস নাও করেন, কিন্তু মানুষের অধিকার রক্ষায় তাদের সংগ্রাম, লড়াই, সাহস, সৌর্য-বীর্যকে নির্মোহ দৃষ্টিতে যদি আপনি না দেখেন তাহলে আপনি আধুনিক চিন্তার মানুষ হিসেবে নিজের সক্ষমতার প্রতি অবিচার করবেন। নিজেকে প্রশ্ন করে দেখবেন যে আমার কথায় আমার পরিবারের দুইজন সদস্যও প্রভাবিত হয় কিনা, গ্রামের/পাড়ার ১০০ লোকও প্রভাবিত হয় কিনা। কিন্তু দেড় হাজার পূর্বে একজন মানুষ, নিপীড়িত মানুষের মুক্তিদূত হয়ে এসে যা করে গেছেন কেন হাজার বছর পরও শত কোটি মানুষ তাঁর কর্ম ও অবদানকে স্মরণ করে, তার মতবাদকে আঁকড়ে ধরে সে প্রশ্নের উত্তর এত সহজে পেয়ে যাচ্ছেন বলে যে আত্মতৃপ্তি সেটি সঠিক কিনা? প্রশ্ন করুন। উত্তর খুঁজুন, আবার প্রশ্ন করুন। যত সহজে উত্তর পেয়ে গেছেন বলে মনে করছেন, তত সহজ নয়।
হ্যাঁ, একটি প্রশ্ন ও উদ্বেগ যৌক্তিক। আমি মনে করি মানুষের সমাজ প্রগতিশীল। নিত্য পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে। যে যুক্তিতে আমি বলছি যে ধর্মগুলোর উদ্ভব ও বিকাশ সে সময়ের সবচেয়ে আধুনিক চিন্তা, এই ন্যারেটিভটা ধরে রাখলে ধর্মগুলোকে বর্তমান সময়ের মতো করে বিকশিত হতে হবে। কিছু নীতি ঠিক রেখে যদি বিকাশের ধারাটা টিকিয়ে রাখা যায়, সময়ের সাথে তাল মেলানো যায়, তাহলেই ধর্ম প্রাসঙ্গিক থাকবে। কারণ মানুষের সমাজের নিয়ত পরিবর্তনশীলতার সাথে খাপ খাইয়েই ধর্ম বা যেকোনো মতবাদকে টিকে থাকতে হবে। সুতরাং ধর্মের গোঁড়ামি নিয়ে বর্তমানে যে সমালোচনা তার অনেক যৌক্তিক ভিত্তিও রয়েছে।
কেন সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বলতে হয় উদারমনস্কতার ঘাটতি। পরিবর্তন ও প্রগতির প্রধান সূত্র উদারভাবে আলোচনা-সমালোচনার দ্বার উন্মুক্ত রাখা। কিন্তু ধর্ম মানা অনেক মানুষ সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, এটি অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা।
এছাড়া, ধর্মকে আমি দর্শনের রাজা বলি। কারণ দর্শনে আমরা যেসব বড়-বড় প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, আমাদের অস্তিত্ব, রিয়েলিটি – এসবের একটা উত্তর ধর্ম দিতে চেয়েছে। এই যে বড় প্রশ্নগুলোকে ধর্ম এড্রেস করেছে, তা আপনি এর উত্তরের সাথে একমত হোন-বা-না-হোন, কিন্তু এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা, আলোচনা, গভীরতা – ধর্মবেত্তাদের এই গুণগুলোর স্বীকৃতিও কিছু “আধুনিক” মানুষের মাঝে দেখি না। বর্তমান সময়ে আরেকটি মুশকিল হচ্ছে ধর্মের এই যে দর্শন এবং ধর্মকে বর্তমানে যারা ব্যাখ্যা করে এই দুয়ের মাঝে বিশাল তফাৎ। মনুষ্য জীবনের জটিলতা নিয়ে ধর্মের যেসব ইন্ট্রিকেসি, গভীর আলোচনা সেটি বুঝার জন্য একটি দার্শনিক মন দরকার। কিন্তু আমাদের সমাজে বর্তমানে যারা ধর্মকে ব্যাখ্যা করে তাদের দার্শনিক সত্ত্বা কতটুকু আছে সে বিষয়ে আমারও গুরুতর প্রশ্ন আছে। এর কারণ কী?
আমি মনে করি এর দায় যতটা না ধর্মবেত্তাদের বা তাদের প্রণীত স্ক্রিপ্টের, তার চেয়ে বেশি যারা বর্তমান সমাজের এসব জটিল বিষয়ে চিন্তায়, সাহসে, মাঠে-ঘাটে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, তাদের এ বিষয়ক উন্নাসীকতা বা উদাসীনতা। অর্থাৎ আমি “আধুনিক”, আমি “প্রগতিশীল” তাই আমি ধর্ম নিয়ে চিন্তা, গবেষণা করি না। কিন্তু আমাদের এই উন্নাসীকতা বা উদাসীনতা সমাজের চলমান গতিপ্রবাহকে থামিয়ে রাখে না। সমাজে ঠিকই সেসব প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। ”আমি মৃত্যুর পর কোথায় যাই”? “আমি কে, কেন এসেছি?” “আমি কেন আশরাফুল মাখলুকাত বা প্রাণীকূলের সেরা?” আমি ধর্ম মানি বা না মানি এসব গুঢ় প্রশ্নের উত্তর মানুষ খুঁজে বেড়াবে। সুতরাং, যারা বুদ্ধিমান হিসেবে দাবী করি, তারা যদি এসব প্রশ্নগুলো এড়িয়ে না যাই, এই ডিসকোর্সের একটা অংশ হিসেবে উত্তর খুঁজি, বেশিরভাগ মানুষের চিন্তার স্ট্রিমে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখি, তবে আমি খুব সহজে কোন কিছু উড়িয়ে দিবো না, আমি উত্তর খুঁজবো, এবং এই স্পেসে নিজেদেরকে সামনে নিয়ে আসবো। সকল “আধুনিক” চিন্তার মানুষ সেটি করবে তেমন নয়, কিন্তু একটা অংশ করলেই এই ডিসকোর্স ও স্পেসটি পরিবর্তন হয়ে যাবে। এই স্থানটি রিক্লেইম করলে, চিন্তাশীল মানুষজন সমাজ ও রাষ্ট্রের এই জটিল বিষয়টি নিয়েও উন্নত আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে।
পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালগুলো (ক্যামব্রিজ, আল-আজহারের মতো) একসময় ধর্মীয় পাঠশালা ছিলো, অর্থাৎ ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের সংযোগ নিয়ে মানুষ চিন্তা করতো, ভাবতো। বিশ্বের এক নম্বর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে কেউ কেউ মজা করে মাদ্রাসা বলেন কারণ এখানে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে এত বেশি পড়াশোনা ও গবেষণা হয়! আমি মনে করি সমাধানটা সেখানেই। ধর্মকে গালি দিয়ে নয়, বরং যেসব প্রশ্নের কারণে ধর্মের উৎপত্তি ও টিকে থাকা, সেগুলো নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনার মাধ্যমে, গবেষণার মাধ্যমে এই স্পেসটিকে রিক্লেইম করা সম্ভব এবং তার ফলে ধর্ম প্রগেসিভ না রিগ্রেসিভ এই ডাইকোটোমিকেই অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া যাবে।