বাংলাদেশে “ইসলামী জঙ্গীবাদ” এবং কিছু পুরনো প্রশ্নের হিসেব মেলানোর চেষ্টা

Image: ThoughtCo

২০০৪-০৫ সালে বাংলাদেশে তথাকথিত জঙ্গী আক্রমণগুলো (২১ আগস্ট, ৬৪ জেলায় বোমা হামলা) শুরুর বেশ কয়েক মাস আগে থেকে (২০০৩ সাল থেকে) তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ দেশ জঙ্গীবাদে ভরে গেছে বলে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও শোরগোল শুরু করেন। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উপস্থিতি ছিলো না এমন নয়, কিন্তু এটি কখনোই সেভাবে রাষ্ট্রের প্রতি বড় ধরনের কোন হুমকি ছিলো না। যার ফলে কোন ধরনের যৌক্তিক প্রেক্ষাপট ছাড়াই (তথাকথিত ইসলামী জঙ্গীবাদ বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এ ধরনের কোন ইঙ্গিত, বা লক্ষণ ছিলো না) হঠাৎ করে শেখ হাসিনার দেশ-বিদেশে জঙ্গী-জঙ্গী বলে ওই শোরগোলে দেশবাসীর মতো আমরাও বেশ ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম – কারণটা কী! বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরে বেড়ানো মানুষ হিসেবে দেশটাকে যতটুকু জানি, হিসেব মেলাতে পারছিলাম না যে শেখ হাসিনার এত জঙ্গি কোত্থেকে আসবে বা কোথায়! যদিও তখন শেখ হাসিনার রাজনীতির প্রতিই বেশি সমবেদনা ছিলো।

যাই হোক, স্পষ্ট মনে আছে দেশে জঙ্গী-জঙ্গী বলে অযথা শোরগোল তৈরি করায় এবং বিদেশে বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদী রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করার কারণে শেখ হাসিনা মানুষের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু কী এক আশ্চর্য কারণে (কিংবা “আত্মবিশ্বাসে”) তিনি তার জঙ্গীবাদের ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েই চললেন। তারপর তো আমরা হঠাৎ করেই ২০০৪ সালে জঙ্গীবাদের মাশরুম গ্রোথ দেখলাম! প্রশ্ন উঠেছিলো এরা কারা? কোত্থেকে এলো? কাদের মদদে? এদের প্রশিক্ষণ ও রসদের উৎস কী? কিংবা শেখ হাসিনাই বা এতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে এদের আসন্ন উত্থানে খবর জানতেন কী করে? এ জাতীয় নানা প্রশ্ন তখনো মনে ভিড় করেছিলো। কিন্তু তখন পর্যন্ত সেগুলোকে বিএনপি-জামাতের অক্সিলারি হিসেবেই ভেবেছিলাম।

গত দেড় দশকের রাজনীতির গভীর পর্যবেক্ষণ থেকে অনুমান করি যে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সবচেয়ে বড় চাষাবাদ হয় বর্ডারের ওপারে। বাংলাদেশে গত ১০ বছরে যেসব তথাকথিত জঙ্গী ধরা পড়েছে, তাদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ কোথা থেকে হয়েছে একটু খোঁজ নিলে উত্তরটা মিলে যাবে। সুতরাং বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের আক্রমণ কখন হবে, বা কিভাবে হবে এই টাইমিংটা তার বা তাদেরই জানার কথা যাদের সাথে বর্ডারের ওপারের ভালো যোগাযোগ আছে। এখন দুটো বিষয় হতে পারে, বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানো ছিলো আইএসআই-এর পরিকল্পনা যেটি কিনা র জানতো এবং শেখ হাসিনাকে তারা জানিয়ে দিয়েছে। অথবা, এটি র-এরই পরিকল্পনা যেটি ব্যবহার করে তারা তৎকালীণ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চেয়েছে (এবং তেমনটি হলে, পেরেছেও)। এখানে শেখ হাসিনা হয়তো তাদের হয়ে প্রোপাগাণ্ডার কাজটি চালিয়েছে।

সেকেন্ড টিয়ার রিজনিংয়ে যদি আমরা ধরে নেই যে বিএনপি ও জামাতের সাথে পাকিস্তানী আইএসআই-এর সুসম্পর্ক রয়েছে, তাহলে আইএসআই তাদের অনুকূলে থাকা একটি সরকারকে কেন বেকায়দায় ফেলতে চাইবে সেটি পরিষ্কার নয় বা এতে তাদের স্ট্রাটেজিক গেইন কী তা বুঝা মুশকিল। যার ফলে আমি প্রথম সম্ভাবনাটি ততটা শক্তিশালী মনে করি না। বাকী থাকে, দ্বিতীয় সম্ভাবনা – অর্থাৎ র তৎকালীন সরকারকে বিব্রত করার জন্য কাজটি করিয়েছে কিনা। লাভক্ষতির বিবেচনায় সেটিকেই সবচেয়ে জোরালো যুক্তি মনে হতে পারে কারণ তৎকালীণ বিএনপি-জামাত সরকারকে নিয়ে র অস্বস্থিতে ছিলো এবং তাদের বিব্রত করা র-এর এজেন্ডাতেই থাকার কথা। আপনারা যার-যার রিজনিং সক্ষমতা দিয়ে দুয়ে, দুয়ে চার মিলিয়ে নিবেন।

বৈশ্বিক ইসলামী জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি

আমার বিশ্লেষণে সারা বিশ্বে তথাকথিত “ইসলামী জঙ্গীবাদ”-এর তিনটি ধারা রয়েছে:

প্রথমটি, নিখাঁদ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্ধকে জঙ্গীবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া, যাতে করে দমনপীড়ন সহজ হয়। এই তালিকায় রয়েছে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, কিংবা আফগানিস্তানের মতো দেশ যেখানে হয় স্বাধীনতাকামী আন্দোলন চলছে নতুবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বন্ধ চরমে।

দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছে, আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর ডিপস্টেটের তৈরিকৃত পোষা সন্ত্রাসী বাহিনী। এরা এসব রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য বিশ্বের যেখানে গুণ্ডামি করা দরকার করে। সিআইএ, এমআইসিক্স, মোসাদ, আইএসআই, র, এফএসবি – এদের সবাইকে এ ধরনের ক্রসবর্ডার গুণ্ডাবাহিনী পোষার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। এবং এদের স্বার্থরক্ষায় যেখানে মাস্তানি করা দরকার, এই গুন্ডাবাহিনীগুলো ভাড়াটে হিসেবে কাজ করে। যেহেতু এগুলো নন-স্টেট এক্টর এবং যেহেতু ধরা পড়লে এদেরকে “আমাদের লোক না” বলতে হয়, সেহেতু এই গুন্ডাবাহীগুলোর স্বতন্ত্র ট্যাগ দরকার হয়ে পড়ে। এবং নাইন-ইলেভেনের পর, ”ইসলামী জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী” একটি কার্যকর ট্যাগ যেটি দিয়ে কাজ চালানো যায় আবার দরকার হলে দায়-অস্বীকার করা যায়। আমি মনে করি আইএস, আল-কায়েদা, বোকো হারাম, বাংলাদেশের হরকাতুল জিহাদ, আনসাল আল্লাহর গোষ্ঠী এ ধারার অন্তর্ভুক্ত। এখানেও আবার কো-অপশন ও কম্প্রোমাইজের কূটিলতাও রয়েছে, অর্থাৎ এক পক্ষের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে অপর পক্ষের লোকের অনুপ্রবেশ ও সাবোটাজ নৈমিত্তিক ঘটনা। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লালন-পালন, এদের টাকা-পয়সার যোগান দেওয়া, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করা – এগুলো বড়-বড় রাষ্ট্রগুলোর চরিত্রের অন্ধকার দিক কারণ এই ডিপস্টেটের সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো সারা বিশ্বব্যাপী যেসব খুন-খারাবি, অপকর্ম করে বেড়ায় তার ভগ্নাংশও কোন অর্গানিক জঙ্গিবাহিনী করে না। আবার এত অপকর্ম করে বেড়ালেও এদের কোন জবাবদিহিতাও নেই। সিআএই, মোসাদ, এফএসবি কী করে সেটি তাদের রাষ্ট্রের কোন জবাবদিহিতা কাঠামোর আওতায় স্ক্রুটিনি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৪ সালে সিআইএস’র কার্যক্রম নিয়ে সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির একটি আভ্যন্তরীণ তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু আয়রনি হচ্ছে সিআইএ সেই তদন্ত কমিটির সদস্যদেরই কম্পিউটার নেটওয়ার্ক হ্যাক করে এবং গোপনে তাদের যোগাযোগ মনিটর করে। সুতরাং এরা সকল গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা বা ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে। এদের এসব গুণ্ডাবাহিনীর ব্যবহার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে এদেরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখন কোন গুণ্ডাবাহিনী মোসাদ বা সিআইএ’র পারপাস সার্ভ করে আর কারা র কিংবা কে আইএস-এর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে সেটি বুঝা ও হিসেব মেলানো আপনাদের দায়িত্ব। এই “বৈধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো”র কার্যক্রম না বুঝলে আপনি বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের উৎসটিও বুঝা কঠিন হবে।

তৃতীয় ধারাটি আমি বলবো অর্গানিক জঙ্গীবাদ। অর্থাৎ কিছু মুসলমান নিজেদের উদ্যোগেই হয় ”খিলাফত” কায়েমের নেশায় কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে স্বজাতি্র নিপীড়নের “প্রতিশোধ” নিতে অথবা দেশে “নাস্তিক/ ইসলাম-বিরোধীদের শায়েস্তা করতে” সত্যি সত্যি জঙ্গীবাদ ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। এদের সংখ্যা এবং সক্ষমতা উভয়টিই সীমিত। এবং এরা বাইরের সহযোগিতা ও উস্কানি না পেলে গ্রামের টাউট-বাটপারের লেবেলের চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার কথা নয়। কারণ আধুনিক জঙ্গীবাদের যে জটিল সশস্ত্র দিক, সে অনুপাতে এরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিপুল নজরদারি এড়িয়ে নিপুন দক্ষতায় নিজেদের প্রশিক্ষিত করা, ইন্টেলিজেন্স গ্যাদারিং, রিসোর্স মোবিলাইজেশন, কিংবা অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করা, এবং পুরো বিষয়টির কমান্ড-কন্ট্রোল-কমিউনিকেশন বজায় রাখার কাজটি এদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব কাজ। যে কারণে এ গোষ্ঠীটিও বেশিরভাগ সময় দ্বিতীয় ধারার জঙ্গী তোষনকারী রাষ্ট্র ও ডিপস্টেটের সহজ রিক্রুট এবং জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশে প্রথম ধারার “জঙ্গীবাদের” প্রাসঙ্গিকতা নেই। এখানে তৃতীয় ধারার জঙ্গীবাদের প্রান্তিক উপস্থিতি রয়েছে। তবে উপরে যেমনটি বলেছি এরা নিজেরা খুব বেশি কিছু করার বা ঘটানোর সামর্থ্য রাখে না। কিন্তু জঙ্গীবাদের সবচেয়ে বড় যে অংশটি এখানে অপারেট করে সেটি বাইরের রাষ্ট্র/ডিপ-স্টেটের স্পন্সর করা। সেটি কি র নাকি আইএসআই আপনারা নিজ আক্কেলে বুঝে নেন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান