ইউনাইটেড আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ কি ইতিহাস নিরপেক্ষ?

Image: Al Jazeera

১। ইউনাইডেট আরব আমিরাত (সংক্ষেপে ইউএই) ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। তাদের দহরম-মহরম চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি এই দুই মিলে ইউএই ও ইসরায়েল পর্দার অন্তরালে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে ও পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সুতরাং এই অন্তরালের সম্পর্ককে সামনে নিয়ে আসার কাজটিই এখন হয়েছে। দুই দেশের জন্যই এর লাভ-ক্ষতি রয়েছে।

২। ইউএই, মধ্যপ্রাচ্যের টিকে থাকা কয়েকটি রাজতন্ত্রের একটি। এখানে জনমতের বালাই নেই। সুতরাং ইউএই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলো কি দিলো না এটি যতটা না ইউএই’র রাজপ্রাসাদের ব্যাপার ততটা জনগণের ব্যাপার নয়। গণতন্ত্র থাকলে ইউএই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিতো? প্রশ্নসাপেক্ষ। আমি মনে করি নিতে পারতো না। এবং এই নিতে না পারার জন্যই মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে রাজতন্ত্র টিকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই স্বৈরতন্ত্র বিদ্যমান। কিছু স্বৈরতান্ত্রিক দেশে সংঘাত লেগে আছে এবং কিছু দেশে নেই। এটি নিয়ে পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়াও সিলেক্টিভ। যারা তাদের তথাকথিত মিত্র সেখানকার স্বৈরতন্ত্র নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া কম, যারা তাদের মিত্র নয় সেগুলো নিয়ে তারা সোচ্চার। ইউএই মিত্র দেশ, সুতরাং এই স্বৈরতন্ত্র মেনে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়।

৩। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অভিনব কায়দায় পরিচালিত পররাষ্ট্র নীতিতে সাফল্য আশা করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেলো বৈশ্বিক রাজনীতির জটিলতা তার চিন্তার ‍উচ্চতার চেয়ে বড়। যার ফলে তিনি যতটা না সাফল্য অর্জন করেছেন তার চেয়ে বেশি সমস্যা নিয়ে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনের জন্য লড়তে হচ্ছে। ইউএই ও ইসরায়েল দুটি দেশই আমেরিকার মিত্র দেশ এবং হোয়াইট হাউজ তাদের এই অপ্রকাশ্য সম্পর্ককে প্রকাশ্যে এনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদেশ নীতিতে অন্তত একটি হলেও সাফল্যের মুকুট যুক্ত করার প্রচেষ্টাই বেশি নির্ভরযোগ্য অনুসিদ্ধান্ত। ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্ষেত্রে সাফল্য দাবী করবেন এবং নভেম্বরের নির্বাচনী প্রচারণায় এটিকে ব্যবহার করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মেয়াদে ইসরায়েলকে দুহাত ভরে দিয়েছেন এবং ইসরায়েল ইউএই’কে সাথে নিয়ে তার কিছুটা দায় ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে।

৪। প্রশ্ন উঠতে পারে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দীর্ঘমেয়াদী ফল কী? প্রথম ফল হচ্ছে, ইসরায়েল এখন সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, কুয়েত – এদের উপর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে। সৌদি আরব এতদিন যেভাবে পর্দার অন্তরালে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতো সেটি এখন প্রকাশ্যে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম বিশ্বের তথাকথিত নেতৃত্ব কাঠামোয় সৌদি আরব সম্প্রতি যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা আরো তীব্র হবে এবং দেশটির নেতৃস্থানীয় অবস্থান গৌণ হয়ে পড়বে। তুর্কী, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ইরান ঘিরে নতুন যে বলয় তৈরির চেষ্টা সেটি ত্বরান্বিত হবে। তৃতীয়ত, প্যালেস্টাইন আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির উপরও এর প্রভাব পড়বে। গত এক দশকে কাতার ছাড়া অন্য আরব রাজতান্ত্রিক দেশগুলো প্যালেস্টাইন ইস্যুকে ক্রমাগত উপেক্ষা করে গিয়েছে এবং বিষয়টিকে তাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রান্তিক ইস্যু হিসেবে গণ্য করছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি এই রাজতন্ত্রগুলোর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

৫। সারা বিশ্বের মুসলমানদের একটি বড় অংশ প্যালেস্টাইনের ইস্যুটিকে দেশ-রাজনীতির ঊর্ধ্বে ধর্মীয় ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করে। এবং এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর অটোমানদের ক্ষমতা হারানো এবং ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ ম্যান্ডেটের মাধ্যমে জেরুজালেমসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেওয়াকে বহু মুসলমান ১০০০ বছর পূর্বের ক্রুসেডের জয়ের বদলা হিসেবে দেখে। অনেক পশ্চিমা রাজনীতিক ও বিশ্লেষকও ইশারা-ইঙ্গিতে, লেখায়, স্পষ্ট-অস্পষ্টভাবে বুঝাতে চেয়েছে যে এটি ক্রুসেডেরই ধারাবাহিকতা, বদলা, প্রতিশোধ। সুতরাং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্যালেস্টাইনীদের বাড়ি ছাড়া করা কেবল জমি বা ভূখণ্ডের বিষয় নয়, এর সাথে ইতিহাস, ধর্ম ও হাজার বছরের সংঘাতের বীজ লুকিয়ে আছে।

৬। বর্তমান আরব রাজপরিবারগুলো বৃটিশ ও ফ্রেঞ্চদের ইমপ্ল্যান্ট। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত পুরো মধ্যপ্রাচ্য অটোমানদের (বর্তমান তুরস্ক) কর্তৃত্বের অধীন ছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা জার্মানির মিত্রশক্তি ছিলো। অটোমানদের পরাজিত করতে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চরা কিছু আরব মুসলমানকে তাদের পক্ষে বাগিয়ে নেয় এবং অটোমানদের পরাজিত করার পর পরবর্তীতে তাদের মধ্য থেকে অনুগত কিছু লোককে রাজা-উজির বানায়। সৌদি আরবের আল-সৌদ পরিবার, কিংবা ইউএই, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এই সবগুলো দেশে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চদের পালিত কিছু দালালকে রাজা-উজির নিয়োজিত করে। এ কাজটি তারা উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও করে। কিন্তু এসব দেশে স্থানীয় দালাল গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও তারা জেরুজালেম, প্যালেস্টাইনে ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিভিন্ন কৌশলে (বেলফোর ঘোষণা, ইউএন ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইন প্রভৃতি) প্যালেস্টাইনকে তারা ইহুদিদের হাতে ছেড়ে দেয়। ব্রিটিশ, আমেরিকান, ও ইউরোপীয়ান বিভিন্ন আর্মিতে থাকা ইহুদি জেনারেল ও সৈনিকরা জায়োনিজমের প্রথম প্রতিরোধ ফ্রন্ট গড়ে তুলে এবং এদের প্রশিক্ষণ, রসদ এগুলো আরব নোমাদদের চেয়ে শতগুণ উন্নত হওয়ায় সংখ্যায় কম হওয়ার পরও তারা আরবদেরকে চারটি যুদ্ধে (১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ও ১৯৭২) নাস্তানাবুদ করে প্যালেস্টাইনের দখলদারিত্ব ধরে রাখে। এর মধ্যে সিরিয়া, ইরাক, মিশর, লিবিয়া এসব দেশে সামরিক বাহিনী ক্যু করে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চদের অনুগত রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে দেয়। এদেশগুলোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা আক্রোশের প্রধান কারণও এটি।

৭। প্যালেস্টাইন ও জেরুজালেম বিষয়টি এতো সহজে নিষ্পত্তি হবে না। ইসরায়েল পশ্চিমাদের ইমপ্ল্যান্ট হলেও তারা গত ৫০ বছর ধরে তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। এবং তাদের এখন পর্যন্ত যে দৃষ্টিভঙ্গি যে তারা সামরিক শক্তি দিয়ে প্যালেস্টাইন দখল করে রাখবে সেটি টেকসই নয়। এযাবৎ ইসরায়েল নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামরিক প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে তার প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করেছে। কিন্তু গত ৫০ বছর চারটি বড় ধরনের যুদ্ধে জিতেও তারা প্যালেস্টাইন আন্দোলনকে পরাজিত করতে পারেনি। তাছাড়া দেশটির স্ট্রাটেজিক ডেপ্থ অত্যন্ত কম। যার ফলে তাদেরকে প্রতিনিয়ত প্রতিবেশীদের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে থাকতে হবে। এই ওয়ার অব এট্রিশন, ক্রমাগত এগিয়ে থাকার লড়াইয়ের মাঝেই ইতিহাসে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে ক্লান্তি এসেছে, তারা ঝিমিয়ে পড়েছে, অবশেষে হেরে গিয়েছে। কেউ ১০০ বছরে, কেউ ১০০০ বছরে। ইসরায়েলকে যদি অনেক দিন টিকে থাকতে হয় তাদেরকে অনেক দূর দেখতে হবে। তারা যদি ম্যারাথন দৌড়ে টিকে থাকতে চায়, তাদের ফিলিস্তিনিদের লাগবে। ফিলিস্তিনের মানুষকে অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া তারা ১০০ মিটার বা ৪০০ মিটার দৌড়ে জিতবে, কিন্তু ফিলিস্তিনীদের ম্যারাথন সংগ্রামের নিকট তারা ঠিকই হেরে যাবে, কারণ এই অঞ্চলের মানুষই ফিলিস্তিনীদের শক্তি। রাজা আসে যায়, কিন্তু মানুষের সংগ্রাম টিকে থাকে। এই অঞ্চলের মানুষ ও সংঘাতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ইউএই কিংবা সৌদি রাজার সাথে ইসরায়েলের চুক্তি তাদের ইতিহাসের দেনা শোধ থেকে রক্ষা করবে না।

৮। আসন্ন বছরগুলোতে ইসরায়েলের সাথে আরো কিছু আরব রাজ পরিবার (আমি আরব দেশ বলতে রাজি নই) স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করলেও আমি মনে করি দিনশেষে ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিয়ামক বিবেচনায় এ অঞ্চলে জেরুজালেমকে ঘিরে আবারো এক নতুন রাজনীতি দানা বাঁধবে। এ ঐতিহাসিক সংঘাত এত সহজে ও দ্রুত মিইয়ে যাবে না। মানব ইতিহাসের কিছু কিছু সংঘাতের সীমা-পরিসীমা আমাদের ক্ষুদ্র জীবনের চেয়েও অনেক বড় বিধায় আমাদের কেউ কেউ অত দূরে দেখতে পাই না। তবে আমরা অন্ধ হলেও সমস্যাগুলো মিইয়ে যায় না। আমি মনে করি জেরুজালেম নিয়ে সংঘাতটি একটা সময় ইসরাইল ও আরব রাজাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যে কারণে ইউএই ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘটনাটি বর্তমানে আঞ্চলিক রাজনীতিতে অনেক বড় দেখালেও বৃহত্তর ঐতিহাসিক ভূ-রাজনৈতিক ক্যানভাসে ও বাস্তবতায় এর প্রভাব অতি নগণ্য।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান