কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের এক নেতা আমার সাথে “কথা বলতে চেয়েছেন”। বুঝতে পেরেছি তিনি কেন কথা বলতে চেয়েছেন। আমি ফোন করি। আমার সাথে ফোনালাপে তিনি উষ্মা প্রকাশ করলেন যে “আওয়ামী পরিবারের সন্তান” হয়েও আমি আওয়ামী লীগের “এতটা আগ্রাসী সমালোচক কেন” কিংবা “বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কলম ধরেছি কেন”। তিনি আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতি করে, জনগণের অধিকার হরণ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে এটি স্বীকার করেই আমাকে বুঝাতে চাইলেন কেন “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে” কিংবা “রাজাকার, দেশদ্রোহী, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের” হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় “শেখ হাসিনাকে জোর-জবরদস্তি করে হলেও ক্ষমতায় থাকতে হবে”। ভদ্রলোকের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জেরে তর্কে গেলাম না। রাজনৈতিক মতভিন্নতাকে শ্রদ্ধা করার অনুরোধ জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম।
তবে আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষিদের মধ্যেও এ ধরনের একটি দ্বিধা আছে এবং আমি প্রতিনিয়ত এ প্রশ্ন মোকাবিলা করি। আমার অবস্থানের সততা সম্পর্কে তাদের জানার অধিকার আছে বিধায় আমি একটি কৈফিয়ত দিচ্ছি যে যারা এখনো দ্বিধায় আছে যে, আমি কোনদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করলেও কেন “মন্দের ভালো তত্ত্বে” দলটিকে আগে মৌন সমর্থন দিয়েছিলাম – কিন্ত এখন কেন ”সংক্ষুব্ধ”।
প্রিয় আওয়ামী লীগের ভাই-ব্রাদারগণ,
অনেকে ভালো করেই জানেন, আমার বাবা, এবং চাচা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তারা বঙ্গবন্ধুকে এতটা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন যে রাজনীতি তাদের কাছে পরিবারের চেয়ে বড় ছিলো। আমাদের এলাকায় আওয়ামী রাজনীতির গোড়াপত্তনের সাথে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের নাম, শ্রম-ঘাম, ত্যাগ জড়িয়ে আছে। এখনো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিখলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান আমার বাবা। আমি এই পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠলেও কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করিনি এটিও সত্য। তবে বাবা-চাচাদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সততা আমাকে আকৃষ্ট করতো। যার ফলে একটা মৌন সমর্থন দলটির প্রতি সবসময়ই ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেয়ে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি করার ইচ্ছা জাগে। পারিবারিক পক্ষপাতের কারণে ছাত্রলীগের নামটিই প্রথমে আসলো। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে থাকতে গিয়ে যে ছাত্রলীগ দেখলাম (হলে ফাও খাওয়া, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, এবং জোরজবরদস্তিমূলক, আদর্শহীন, ঠিকানাহীন রাজনীতি) তাতে সাথে-সাথে এ রাজনীতির প্রতি রুচি উঠে গেলো। মনে মনে ভেবেছি “এ রাজনীতি তো আমার বাবা-চাচাদের নিঃস্বার্থ, ত্যাগের রাজনীতি নয়!” অতঃপর, যতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, প্রথমে একটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন তারপর আরেকটি স্বতন্ত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকেছি। পড়াশোনা শেষে দালালী করে চাকুরি পেতে হবে, কিংবা রাজনীতি ব্যবহার করে উপার্জন করতে হবে এই “মহৎ” উদ্দেশ্য থাকলে হয়তো ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোর একটিকেই বেছে নিতাম। কিন্তু প্রচলিত দেউলিয়া, হালুয়া-রুটির রাজনৈতিক দলগুলোর কোনটিই আমাকে টানেনি। ফলশ্রুতিতে বিএনপি সরকারের সময়ও লেখালেখির “অপরাধে” হয়রানির শিকার হয়েছি, “মেরে ফেলার” হুমকি-হুলিয়া মাথায় নিয়ে ঘর ছেড়ে থেকেছি। প্রথম আলোয় সম্পাদকীয় পাতায় আমাদের সহপাঠী-সহযোদ্ধাদের ৫০টিরও অধিক মতামত কলাম আমাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রমাণ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ক্ষমতার রাজনীতি না করলেও আমি কি আওয়ামী লীগকে কখনো ঘৃণা করেছি? উত্তর – না! বরং আমার প্রথম ভোটটি আমি এ দলটিকেই দিয়েছিলাম। আমি দুটো কারণে এ অবস্থান নিয়েছিলাম কিংবা সত্যি করে বললে “ঘোরে” ছিলাম: প্রথমত, আমার বাবা-চাচাদের রাজনীতিতে, সমাজের কাজে আজন্ম সৎ, ভালো মানুষ হিসেবে দেখেছি, মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল, অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষ হিসেবে দেখেছি। নিজেকে প্রশ্ন করেছি যে তাঁরা যখন আওয়ামী লীগ করেন, নিশ্চয়ই আমার তারুণ্যে ভুল থাকতে পারে কিন্তু তাঁদের প্রজ্ঞায় কি কোনো ভুল আছে? এই দ্বিধার কারণে আওয়ামী লীগকে প্রথম বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছি। দ্বিতীয় যে কারণে দলটিকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছি সেটি আরেকটু পরিণত হয়ে, বুঝতে শিখে যে একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উদারপন্থী ও রক্ষণশীল রাজনীতির ঐতিহাসিক দ্বন্ধে [এবং হয়তো আবারো সেই পারিবারিক পক্ষপাতের কারণে] উদারপন্থী সংস্কৃতির ধারক হিসেবে মন্দের ভালো তত্ত্বে আওয়ামী লীগকে ভোটটি দিয়েছি (কবি শামসুর রহমানের ভাষায় বললে – “বিবেকের দংশন সত্ত্বেও”)।
তথাপি, দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বাস করে গিয়েছি যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে দলটি একটি অসাম্প্রদায়িক, সেক্যুলার, মধ্যপন্থী এবং “মন্দের ভালো” পছন্দ এবং সে সূত্রে আমার বেনিফিট অব ডাউট পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু গত দুই দশকের রাজনৈতিক পাঠ, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা সবমিলিয়ে বলতে হয় যে, একটা “ঘোরে” ছিলাম। এখন ঘোর কেটে গেছে দেখে যে, না, দলটি ১৯৭৪-এর বিকৃত রাজনৈতিক দর্শনের খপ্পর থেকে বেরোতে পারেনি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট ডাকাতির পর [যে ডাকাতির আমি সরাসরি সাক্ষী – যার ফলে এই অপমানটা আমি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছি] আমার সমস্ত মোহ কেটে গেছে যে, যে দলটিকে বহু মানুষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষে একটি অসাম্প্রদায়িক, উদার গণতন্ত্রপন্থী পছন্দ হিসেবে মৌন সমর্থন দিয়ে আসছিলো, সে দলটি কিনা স্বেচ্ছাচারি শাসক হয়ে রাতের অন্ধকারে মানুষের ভোটাধিকার হরণ করতে পারে! সুতরাং ২০১৪ ও ২০১৮ সাল ছিলো আমাদের মোহভঙ্গের সময়। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমার বাবা-চাচারা কি তাহলে ভুল করেছিলেন, করছেন? আমি বলবো, না। উনাদের আত্মত্যাগ, আকাঙ্ক্ষা, মানুষের প্রতি, দলের প্রতি আবেগ, ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি, খাদ ছিলো না। কিন্তু দলটির বর্তমান নেতৃত্ব ক্ষমতার রাজনীতি করতে গিয়ে উনাদের নীতি, বিশ্বাস, আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
এই বিশ্বাসঘাতকতা কারণেই আপনারা সঠিকভাবেই জানেন যে আমি এবং আমার মতো বহু মানুষ দলটিকে এখন বিএনপি কিংবা জামাতের সমর্থকদের চেয়েও বেশি মাত্রায় ঘৃণা করে। কারণ বিশ্বাসের অমর্যাদা এবং বিশ্বাসঘাতকতা বেশ অপমানজনক। একটা সময় যখন কেউ আমাদেরকে ১৯৭৪ সালের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতো দলটিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করা যায় না, তখন আমরা বলতাম ওটা হয়তো “নেসেসিটি ছিলো” কিংবা বঙ্গবন্ধুর “অনেস্ট মিসটেক”, অথবা মানুষ যখন দলটির সাথে ভারতের মাখামাখি নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থহানির আশংকা প্রকাশ করতো, তখন ওই কথাগুলোকে মনে হতো “সস্তা রাজনৈতিক রেটোরিক” কিংবা “প্রোপাগাণ্ডা” এবং ভোট পাওয়ার ”রাজনৈতিক কৌশল”। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ৮ কোটি মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেই আওয়ামী লীগকে প্রমাণ করতে হলো যে দলটি বর্তমানে সত্যিসত্যি একটি অগণতান্ত্রিক শক্তি, মানুষের অধিকার হরণকারি এবং গত ১০ বছরে আপনাদের শাসনামলে আপনারা ভারতীয় স্বার্থের কাছে অন্ধভাবে নতিস্বীকার করেই প্রমাণ দিতে হলো যে আওয়ামী লীগ সত্যিসত্যি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দালালি করে কিংবা নিদেনপক্ষে ক্ষমতার জন্য দেশের স্বার্থকেও জলাঞ্জলি দিতে পারে!! তরুণ হিসেবে আমার পূর্বতন উপলব্ধি কেন ভুল ছিলো সেটি প্রমাণে আওয়ামী লীগের চেয়ে এত আন্তরিকতা নিয়ে আর কেউ কাজ করে যায়নি।
সুতরাং যারা মনে করছেন আমি “অতিমাত্রায়” “যুক্তিহীনভাবে” বিক্ষুব্ধ, তারা জেনে রাখুন যে আমি ব্যক্তিগত লাভক্ষতির বিবেচনায় কখনো আমার রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করিনি। যারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তারা সবাই (নিরঙ্কুশভাবে) আমার ব্যক্তিগত সততা ও নৈতিকতার সাক্ষী দিবেন। সুতরাং আমি কখনোই “কিছু হারিয়ে” কিংবা “কিছু পাওয়ার লোভে” বিক্ষুব্ধ হইনি, বরং আমি বিক্ষুব্ধ হয়েছি আমাদের বাবা-চাচাদের সৎ আদর্শ, বিশ্বাসের সাথে আওয়ামী লীগের এরূপ নগ্ন বিশ্বাসঘাতকায়। গণমানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে পুরো সেক্যুলার, মধ্যপন্থী, উদার-গণতন্ত্রী এস্টাবলিস্টমেন্টের সাথে আওয়ামী লীগের এই বিশ্বাসঘাতকতায়। একটা টোটালিটেরিয়ান রেজিমের প্রতি আমি সংক্ষুদ্ধ এবং সেটি যদি আপনার, আপনাদের কারো নজরে পড়ে থাকে তাহলে আমি স্বস্তি পাই যে আমি সঠিক অবস্থানে আছি। এর উল্টোটা হলেই বরং আমার জ্ঞান-বুদ্ধি-সততা এসব নিয়ে নিজের মধ্যেই প্রশ্ন জাগতো।