
বর্তমান আওয়ামী লীগ রেজিমের কিছু বন্ধু ও সুহৃদ হায়-হুতাশ করছেন যে দেশে অনেক কিছু ঠিকমতো কাজ করছে না কেন, কেউ কথা শুনছে না কেন, কিংবা সবকিছু প্রায় ভেঙে পড়ছে কেন। আমি ভাবছি আপনাদের অনুমান (assumption) এতটা দুর্বল ছিলো কেন! আপনারা ভেবেছিলেন একটা পাড় বুর্জোয়া দল ভোট ছাড়া জোর করে ক্ষমতায় থাকলেও তাদের নেতাকর্মীরা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে, সংবেদনশীল থাকবে! আপনাদের কি জানা ছিলো না যে একটা বুর্জোয়া পাটির নেতাকর্মীদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ব্যক্তিগত/বস্তুবাদী লাভ-লোকসানের হিসেব অথবা এটি টিকে থাকার মূলমন্ত্রই মূলত নেতাকর্মীদের মাঝে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বণ্টন? সেটি উন্নত বা অনুন্নত সবদেশেই।
উন্নত দেশে কিছুটা নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং আইনী কাঠামোয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কিছু সুযোগ-সুবিধা পান – একটি বড় উপায় হচ্ছে ল্যাটারাল এন্ট্রির অনুরূপ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সরকারি দায়িত্বে নিয়োগের মাধ্যমে। আমাদের দেশে আমলারা এটি করতে দিতে চায় না এবং রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব দুর্বলতায় সেটি নেগোশিয়েট করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে এসব সুযোগ-সুবিধা লাগাম-ছাড়া, বেআইনীভাবে বণ্টিত হয় – যেমন, রেন্ট সিকিং, সরকারি ঠিকাদারী চুক্তি দলীয় লোকদের দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দলীয় স্তাবকদের প্রদান, এবং সরকারি চাকুরিতে দলীয় ক্যাডার নিয়োগ, এবং সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক ব্যবস্থা থেকে নেতাদের অনৈতিক সুবিধা প্রদান।
একজন মানুষকে আদর্শিকভাবে রিইঞ্জিনিয়ারিং করা যায় (ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদ – এর উদাহরণ) যার মাধ্যমে সে কিছু মোরাল কোড বাধ্যগতভাবে মেনে চলা কিংবা এমনকি তার অধিকারও সমর্পণ করতে প্রস্তুত থাকে। মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গাটাই, অর্থাৎ চারিত্রিক নমনীয়তা, তার সবচেয়ে বড় শক্তিও। কারণ গ্রুপ বিহেবিয়ারে চারিত্রিকভাবে নমনীয়, দুর্বল মানুষের মাঝে ছাড় দেওয়ার প্রবণতা বেশি, কিন্তু আদর্শিকভাবে রিইঞ্জিনিয়ার্ড মানুষের মধ্যে ছাড়ের প্রবণতা কম, ফলে যদিও তারা যূথস্বার্থের কথা বলে কিন্তু নিজস্ব মত প্রতিষ্ঠায় কিংবা সংজ্ঞার বাইরে গেলে সবচেয়ে হিংস্র প্রবৃত্তিও তারাই প্রদর্শন করে। যেহেতু চারিত্রিক নমনীয়তাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, সে সময়-সুযোগ বুঝে ভালো থাকতে চায়, আবার মানবিক সীমাবদ্ধতার বলি হয়ে দুর্বল মুহুর্তে খারাপ আচরণ করে, আবার অনুতপ্ত হয়। মানুষ তার এই আদিম প্রবৃত্তির কাছে বন্দি এবং কোনো সিস্টেমিক দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া মানুষের এই আদিম প্রবৃত্তি।
গণতন্ত্র কোনো অনমনীয়, আদর্শিক শাসন ব্যবস্থা নয়। বরং মানব সমাজে ক্ষমতা কাঠামোকে ঘিরে আদর্শিক রিইঞ্জিনিয়ারিং এর যেসব প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো সেগুলোর দুর্বলতার ফাঁকে টিকে যাওয়া একটি শাসন ব্যবস্থা। এর বড় গুণ এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মতোই নমনীয়। এর মালিকানাও তাত্ত্বিকভাবে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর হাতে না থেকে একটি দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর হাতে থাকে। জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রতি ৪ বা ৫ বছর তাদের ম্যানেজার বেছে নেয়। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী জনগণও ভুল করে, অনুতপ্ত হয়, এবং পরের বার আরেক পক্ষকে বেছে নেয়। জনগণের নিজেদের হাতে ভুল শোধরানোর সুযোগ থাকায় শাসন ব্যবস্থায় যুক্তরা তাদের মানবীয় চারিত্রিক গুণাবলীর সহজাত নিয়মে নিজেদের আচরণের কিছুটা লাগাম টেনে ধরে। একটি স্বয়ং-সংশোধিত ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের এই নমনীয়তাই প্রক্রিয়াটিকে টিকিয়ে রাখে। কিন্তু যে মুহূর্তে প্রক্রিয়াটি থেকে জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার হারিয়ে যায় অর্থাৎ গোড়ার প্রক্রিয়াটি নষ্ট হয়ে যায় তখন শাসক শ্রেণির আদিম প্রবৃত্তি লাগাম ছাড়া হয়ে পড়ে, একটি দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্লেপ্টোক্রেটিক, এনার্কিক শাসন ব্যবস্থায় রূপ নেয়।
আওয়ামী লীগের সুহৃদ বন্ধুদের এ বিষয়টি জানা উচিত ছিলো যে ভোটের কমপাল্শন নষ্ট হয়ে গেলে তাদের দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীকে গণভবনের আদেশ-নির্দেশেও জনগণের কাছে নেওয়া যাবে না। আপনারা হয়তো ভিন্ন অনুমান (assumption) করছিলেন, কিন্তু সেটি স্পষ্টতই সঠিক ছিলো না। এই ভুল শোধরানোর চেষ্টা করা হয়েছে নেতাকর্মীদের চাল চুরির মচ্ছব থামাতে জেলায়-জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের উপর সংকট মোকাবেলার দায়িত্ব দিয়ে – যেটিও আদতে ব্যর্থতার রেসিপি। এই ভুলটা ফ্যাটাল, যেটার জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে চড়ামূল্য দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ স্পষ্টতই স্বৈরশাসন কিভাবে কাজ করে সেটি না বুঝে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। এই ভুলটা আজকের নয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছেন আবার সেটিকে উনার ভাষায় গণতন্ত্রও বলেছেন। শেখ হাসিনার সেরূপ কোনো আদর্শিক অবস্থান নেই, কিন্তু তিনি গণতন্ত্রকে উল্টে দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭৪ সালের সমাজতন্ত্র কী আদতে গণতন্ত্র অথবা শেখ হাসিনা পেটি বুর্জোয়া রাজনীতি করে গণতন্ত্র উচ্ছেদ করে আদতে টিকে থাকতে পারবেন? নিচের আলোচনাটিতে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হয়েছে।
প্রথমত, বুঝা দরকার যে গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা মাত্র। এটি কোনো রাজনৈতিক আদর্শ নয় এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক আদর্শ, এবং অর্থনৈতিক দর্শন – এই তিনের পার্থক্য না বুঝলে ভুল করার সুযোগ বেশি। এবং অনেকেই এই ভুলটি করে থাকেন।
(ক) গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, একদলীয় শাসন – এগুলো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদাহরণ। অর্থাৎ সরকার কিভাবে গঠিত হবে সে প্রক্রিয়া, এবং প্রতিষ্ঠানগুলো কি প্রক্রিয়ায় চলবে আচরণ করবে তার বিধান, নিয়ম, প্রথা। গণতন্ত্রে জনগণ ভোট দিয়ে সরকার প্রতিষ্ঠা করে। একনায়কতন্ত্রে শাসনব্যবস্থায় জোর করে আসীন দলটি (সামরিক বাহিনী বা রাজনৈতিক দল) নিজেদের প্রধানকে সরকার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করে। একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় যেহেতু কেবল একটি দল রাজনীতি করার সুযোগ পায় এবং দলে যেকেউ যোগ দিয়ে “আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক” প্রক্রিয়ায় দলীয় নেতা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের প্রশাসক নিযুক্ত করে।
(খ) প্রথাগত এলিট-ডমিনেটেড রাষ্ট্র, প্রলেতারিয়েত শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র, ধর্মীয়/ জাতিয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ – এগুলো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের উদাহরণ। রাজনৈতিক আদর্শের বিতর্কে রয়েছে মূলত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন আদর্শভুক্ত গোষ্ঠী রাষ্ট্রটি পরিচালনা করবে তাদের পরিচয় (কিভাবে তাদের বাছাই করা হবে সেটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিতর্ক)। যদিও সব রাজনৈতিক আদর্শই দিনশেষে স্ব-স্ব ক্ষেত্রের প্রভাবশালী এলিট শ্রেণি তৈরি করে, প্রথাগত এলিটরা মূলত পুঁজিপতি এবং সমাজের শাসক শ্রেণির সাথে সম্পৃক্ত কালচারাল এলিট। প্রথাগত এলিট-ডমিনেটেড আদর্শের উপযোগী রাজনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে একটি গণতন্ত্র ব্যবস্থা। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত ফিল্টারিং-এর ক্ষেত্রগুলোতে এলিটদের টুইস্ট ও ম্যানিপুলেট করার অনেক সুযোগ থাকে এবং দিনশেষে এলিটদের বড় প্রভাব থাকে। অন্যান্য আদর্শিক মতবাদের তুলনায় এই ব্যবস্থার প্রথাগত এলিটদের মধ্যে মোবিলিটি অর্থাৎ উত্থান ও পতন বেশি। যদিও গণতন্ত্র প্রথাগত এলিট-ডমিনেটেড তারপরও, এলিটদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিজেরা অপারেট করার সক্ষমতা বাকী ব্যবস্থাগুলোর তুলনায় গণতন্ত্রেই বেশি। অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র বিনির্মাণের যে আদর্শ সেটিতে শাসন পরিচালনার যোগ্যতার মানদণ্ড একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বিশ্বাস করার সাথে যুক্ত এবং এ ধরনের আদর্শিক শর্ত প্রকারান্তরে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রূপ নেয়।
(গ) পুঁজিবাদ/ মুক্তবাজার, কমিউনিজম/সাম্যবাদী অর্থনীতি – এগুলো অর্থনৈতিক দর্শন।
একটি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক, প্রথাগত এলিট-ডমিনেটেড, পুঁজিবাদি রাষ্ট্র হতে পারে, আবার একদলীয় শ্রমিক শ্রেণির সাম্যবাদী অর্থনীতির রাষ্ট্র হতে পারে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নৈর্বক্তিক কাঠামোগত চরিত্রের কারণে সেখানে রাজনৈতিক আদর্শ বা অর্থনৈতিক দর্শন নমনীয় হতে বাধ্য। কিন্তু একটি সাম্যবাদী অর্থনীতির শ্রমিক শ্রেণির দেশে কিংবা ধর্মীয় রাজনৈতিক আদর্শের পুঁজিবাদী দেশে সীমিত আকারে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চর্চা হতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রে উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনা কম কারণ তাতে প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র নষ্ট হওয়ার সমূহ ঝুঁকি তৈরি হয়।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও আদর্শ এবং অর্থনৈতিক দর্শন এই তিনটি একটা সিনক্রোনাইজেশনে কাজ করে। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রে আপনি উপরের পছন্দগুলো বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আপনি কী পারবেন আর কী পারবেন না তা বিষয়গুলোর পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া এবং সেগুলো বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার প্রজ্ঞা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন, রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে আপনি কমিউনিজম ও ধর্মীয়/ জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চাইলে আপনার রাজনৈতিক ব্যবস্থা চূড়ান্ত বিচারে একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে – অর্থাৎ আপনি জনগণের একটা বড় অংশের মাঝে একটি আদর্শ “প্রচার” করবেন এবং এর ট্রেড-অফের জন্য তাদেরকে “প্রস্তুত” করবেন। আপনার আদর্শিক স্কীম বাস্তবায়নে আপনি তাদেরকে বলছেন যে তারা যেন তাদের একটি অধিকার (নেতা/সরকার বেছে নেওয়ার অধিকার) ছেড়ে দেয়। জনগণের একটা অংশ হয় তাতে সায় দেয় নতুবা দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, এবং আর সমর্থকদের উল্লেখযোগ্য অংশকে আপনি অনুগত, রেজিমেন্টেড ক্যাডার হিসেবে তৈরি করেন যারা আপনার রাজনৈতিক ব্যবস্থার পাহারাদার (গার্ড)। এর জন্য আদর্শভিত্তিক দলগুলোর রাজনৈতিক কাঠামো ভিন্নতর হয় এবং ক্যাডার ভিত্তিক হয়। (বাংলাদেশে সিপিবি ও জামায়াত উদাহরণ) এটি উল্টোভাবে করা অসম্ভব না হলেও কঠিন: যেমন প্রথমে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতারোহণ করে তারপর পছন্দনীয় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা বা টিকিয়ে রাখা। রেজিমেন্টেড কর্মীবাহিনীর অভাবে আপনার প্রচারিত তথাকথিত আদর্শিক পছন্দ জনগণের মধ্যে অনুরণিত হয় না এবং নেতাকর্মীরা ব্যক্তিগত ত্যাগস্বীকারের জন্য তৈরি থাকে না বিধায় সেটি ভেঙে পড়তে বাধ্য। একইভাবে যখন আপনি অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে কমিউনিজম/ সাম্যবাদী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন সেটি আপনার অর্থনৈতিক আদর্শ – অর্থাৎ সেটি সমলয় হবে একটি প্রলেতারিয়েত নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তার রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি হবে একদলীয় এবং চূড়ান্ত বিচারে ফ্যাসিবাদি।
আপনি যদি গণতন্ত্রী না হন, তাহলে উপর্যুক্ত কঠিন সমীকরণে রাজনৈতিক আদর্শ ও অর্থনৈতিক দর্শনের সাথে সমলয় করে আপনি আপনার গণতন্ত্র-ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি (স্বৈরতন্ত্র বা একদলীয় শাসন) বেছে নিবেন। একনায়কতন্ত্র বা একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা বা পরিচালনার জন্য আপনাকে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো মাথায় রেখে আপনার নিজস্ব রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মপন্থ নির্ধারণ করতে হবে এবং সেমতে জনগণের একটা অংশকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। পাশাপাশি অনুগত, রেজিমেন্টেড ক্যাডার বাহিনী তৈরি করতে হবে। এভাবে আপনার দীর্ঘমেয়াদী “শাসন” কায়েম করার স্বপ্ন কিছুটা সফল হতে পারে। যদিও এই শাসনব্যবস্থাগুলো দিন শেষে অপশাসনে রূপান্তরিত হয় এবং অন্তর্গত অসঙ্গতি ও দুর্বলতার জন্য এগুলো একপ্রকার ওয়ানওয়ে টিকেট। তথাপি এ পদ্ধতিতে এ শাসনগুলোর মেয়াদ দীর্ঘ হতে পারে। এর বাইরের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ডেরিভেটিভ হচ্ছে রাজতন্ত্র। কিন্তু এখন প্রি-লকিয়ান (pre-Lockean) মধ্যযুগ নয় এবং বর্তমানে জনগণকে এটা বুঝানোরও কোনো উপায় নেই যে আপনার কর্তৃত্ব স্বর্গ থেকে এসেছে। ফলে আপনি রাণী কিংবা জনগণ প্রজা সেভাবে আপনার রাজনৈতিক বৈধতা তৈরিরও উপায় নেই।
অন্যদিকে গণতন্ত্র একটি অনন্য ও মজার শাসন ব্যবস্থা। এখানে আপনাকে দ্বিতীয় (রাজনৈতিক আদর্শ) ও তৃতীয় (অর্থনৈতিক দর্শন) বিষয়টি নিয়ে খুব না ভাবলেও আপনি রাজনীতি করে যেতে পারেন। এখানে উচ্চ-মার্গের কিংবা নিম্ন-মার্গের সব ধরনের মতবাদ নিয়ে রাজনীতি করা যায়, জনগণের কাছে যাওয়া যায়, এবং জনগণের বিভিন্ন অংশকে বুঝানো কিংবা বিভ্রান্ত করা যায়। সরকারের মেয়াদ নির্দিষ্ট হওয়ার ফলে এটি জনতুষ্টিবাদ প্রভাবিত এবং এখানে নীতি অনিশ্চয়তা (policy uncertainty) থাকে। এর হাজারটা ত্রুটি, কিন্তু এর সবচেয়ে বড় শক্তি এর নমনীয়তা। একটা নমনীয় বিষয় বাঁকানো যায়, আবার সোজা করা যায়। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা থাকেন তারা জনগণ-নিযুক্ত হয়ে স্বল্প সময়ের জন্য আসীন হন যার ফলে রাষ্ট্রকে যেকোনো একমূখী কিংবা দীর্ঘমেয়াদীভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শের মতো জটিলতায় জড়িয়ে ফেলার প্রণোদনা কম।
গণতন্ত্রের সাথে রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে প্রথাগত এলিট-ডমিনেটেড রাষ্ট্র কিংবা অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে পুঁজিবাদ উত্তমরূপে সমলয় হয়। কারণ গণতন্ত্রের মতোই প্রথাগত এলিট-ডমিনেটেড রাষ্ট্র কিংবা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক দর্শন মানুষের সহজাত ও আদিম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দুর্বলতার নিরীখে গড়ে উঠা এবং নমনীয় – অর্থাৎ সমন্বয়যোগ্য। উল্টোভাবে বললে, রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনি যদি পুঁজিবাদি হন এবং এলিট-ডমিনেশনে অপারেট করতে চান সেক্ষেত্রে গণতন্ত্রই আপনার জন্য উত্তম বিকল্প। নাগরিক হিসেবে, আপনারা যদি বাজার ব্যবস্থায় নিজেদের স্বাধীনতা চান (classical capitalism, NOT Crony capitalism) এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈর্বক্তিকতা চান এবং সমাজের ধীর ও ধারাবাহিক প্রগতি আকাঙ্ক্ষী (not radical), সেক্ষেত্রে আপনারও উত্তম পছন্দ গণতন্ত্র। অন্যদিকে আপনি যদি নিজেকে আদর্শিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাবজেক্ট করতে চান, সমাজকে একটা সাম্যবাদ বা ধর্মীয় কোনো আদর্শিক চশমা দিয়ে দেখতে চান এবং আপনার আদর্শে বিশ্বাসীদের “মত” বাকী জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিতে চান এবং সেজন্য জনগণের এমনকি আপনার নিজের কিছু মৌলিক মানবাধিকার বিসর্জন দিতে চান, সেক্ষেত্রে আপনি একদলীয় শাসন, কিংবা একটি স্বৈরতান্ত্রিক বা ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষপাতী।
গণতন্ত্রে নমনীয়তার আরেকটি উদাহরণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সমন্বয়ের সুযোগ। অর্থাৎ আপনার দলের পরিবর্তনশীল নেতৃত্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শিক অবস্থান বদলাতে পারেন। আমেরিকার রাজনীতিতে ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে এবং ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর এ বিবর্তন হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফিরে আসা যাক। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রেজিমের স্বতঃস্বিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা র্যাডিক্যাল অর্থনৈতিক দর্শন নেই যা দিয়ে জনগণের একটা বড় অংশকে আদর্শিকভাবে ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত করা যায়। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে রেজিমের কিছু লোক জাতীয়তাবাদ জাতীয় কিছু একটা জাগানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মীর বুর্জোয়া চরিত্রে এত বেশি নৈতিক স্খলন যে নিজেদের চারিত্রিক অসতার ফলে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে জাতীয়তাবাদী আদর্শিক এলাইনমেন্ট তৈরি করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে তারা কমিউনিস্ট কিংবা ধর্মীয় রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী দলও নয়, সুতরাং সেভাবেও আদর্শিক এলাইনমেন্ট সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে তারা সাম্যবাদী ধারার নয়, বরং বিকৃত পুঁজিবাদী অর্থনীতির (Crony capitalism) সমর্থক সুতরাং সেখানেও তাদের আদর্শিক রেজিমেন্ট তৈরি সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের ভৌত উন্নয়ন নিয়ে তারা একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু এর আদর্শিক আবেদন কম। এছাড়া ঐতিহাসিকভাবে এটি ব্যর্থ আপীল। আইয়ুব খান, এরশাদ – দুজনেরই এ ধরনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাদের রাজনীতি টিকেনি।
শেখ হাসিনার প্রথম বিপদ হচ্ছে তিনি গণতান্ত্রিক পন্থা ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়েছেন, এবং তার দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে তার এমন কোন রাজনৈতিক আদর্শ বা অর্থনৈতিক দর্শন নেই যেটিকে ব্যবহার করে জনগণের বড় অংশকে উদ্বুদ্ধ করা যায় কিংবা নিজ দলের নেতাকর্মীদের নৈতিক স্খলন রোধ করা যায়। কারণ তাদের সামনে এমন কোন নৈতিক দায়বদ্ধতার ফ্রয়েডীয় দেয়াল তৈরি করা যায়নি যার জন্য তারা তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা বিসর্জন দিবেন না। এসব কিছু মিলিয়ে তার দলের লোকজন করোনাভাইরাস মহামারিতে ত্রাণের চাল চুরি করবেন, চিকিৎসা মাস্কের টাকা মেরে দিবেন, কিংবা হাসপাতালের রোগীর সিরিয়াল বিক্রি করবেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমনটিই হওয়ার কথা। গণতন্ত্রে ৫ বছর পর তাদের জেতার দায়বদ্ধতা ছিলো বলে তাদের দুর্বত্ত চরিত্রে কিছুটা লাগাম থাকতো, কিন্তু এখন সেই লাগামের দরকার নেই। সুতরাং তাসের ঘরটি ভেঙে না পড়া পর্যন্ত লুটপাট উপভোগ করতে থাকেন।