
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একজন ভালো মানুষ, জনপ্রিয় শিক্ষক, এবং উত্তম চিন্তক। বাংলাদেশের দীর্ঘ সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি তার এসব ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য নিঃসন্দেহে স্থান করে নিবেন। সমাজের প্রান্তিক মানুষের অধিকারের পক্ষেও তিনি নানাভাবে সক্রিয় থেকেছেন। বর্তমান সামাজিক চিন্তা-কাঠামোয় তিনি নিঃসন্দেহে একজন সফল শিক্ষক ও অধ্যাপক। কিন্তু তিনি কি সত্যিকারের একজন পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল? তিনি কি বুদ্ধিজীবি হিসেবে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন? হ্যাঁ/না হলে কেন? উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আমি নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করেছি এবং সে আলোকে আমার নগণ্য বিশ্লেষণ তুলে ধরছি।
অধিকারের পক্ষের লড়াই: পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল কারা এবং তাদের কর্তব্য কী?
এটা নিঃসন্দেহ যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাংলাদেশে বৈষম্যহীন সমাজ, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের পক্ষে সরব ছিলেন। একটা রাষ্ট্র, সমাজ-কাঠামো মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে কতটুকু গুরুত্ব দেয় তার ভিত্তি হচ্ছে সে জনগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন করে কি-না, সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা মতামত দিতে পারে কিনা সেটি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেও এটি সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (International Covenant on Civil and Political Rights)-এর ১ নম্বর অনুচ্ছেদটিই হচ্ছে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংশ্লিষ্ট। কারণ এ অধিকার না থাকলে মানুষের বাকী অধিকারগুলো অর্জন অসম্ভব না হলেও বেশ কঠিন। তাত্ত্বিকভাবে মানুষ নিজেদের সম্মতিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবার কথা। সুতরাং যেখানে মানুষ নিজেদের সম্মতিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেখানে যদি জোরপূর্বক একদল দস্যু মানুষকে নিজেদেরকে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়, তাহলে সেখানে রাষ্ট্রই থাকার কথা নয়। এ কারণে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের শর্তটির ব্যাপকতা অনেক গভীর।
এছাড়া রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি (International Covenant on Civil and Political Rights)-এর ২৫ অনুচ্ছেদে আরো স্পষ্ট করে নাগরিকদের তাদের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার অধিকার, ত্রুটিমুক্ত নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও অনুচ্ছেদ ৭-এ একারণে স্পষ্ট করে বলে দিতে হয়েছে যে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি মানুষের অধিকারের এই মৌলিক ও প্রথম শর্তটি লংঘিত হয়, তাহলে বাকী অধিকারগুলো কি সংরক্ষিত হয়? স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থার নৈতিক বৈধতা ও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই খুব ব্যতিক্রম না হলে এমনটি না হবারই কথা। বাংলাদেশেও সেকারণে আমাদের বুদ্ধিজীবিগণ বাকশাল, এরশাদ, জিয়াউর রহমানের সরকারগুলোর যৌক্তিক সমালোচনা করে গিয়েছেন যে এই সরকারগুলো মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পরিপন্থী।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে মানুষের অধিকার নিয়ে উচ্চকণ্ঠ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ২০১৪ ও ২০১৮ সালে মানুষের ভোটের বা এক কথায় তাদের “আত্মনিয়ন্ত্রণের” অথবা “সরকারি সিদ্ধান্তগ্রহণে মানুষের অংশগ্রহণের” অধিকার কেড়ে নেওয়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কেন নিরব ছিলেন? কেন সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলেননি? কেন তিনি জাতীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর বৈধতাকে ব্যবহার করে এ আত্ম-বিধ্বংসী পথ থেকে আওয়ামী লীগ রেজিমকে নিবৃত করতে কোনো বিবৃতি দেননি? নিদেন পক্ষে বাইরে থেকে কথা বলে হলেও চাপ সৃষ্টি করেননি? প্রায় ৯ কোটি ভোটারের মৌলিক অধিকার হরণ করা আওয়ামী লীগ রেজিম কি কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ ”অবিশ্বাসী মানুষের” অধিকার রক্ষা করতে পারবে? অথবা ১০ শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা প্রায় ২ শতাংশ জাতিগত সংখ্যালঘুর অধিকারের সুরক্ষা দিতে পারবে?
আমি মনে করি ২০১৪ সাল পরবর্তী স্বৈরশাসন নিয়ে অদ্ভুত নিরবতা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মোটাদাগে বেশিরভাগ সেক্যুলার, লিবারেল ইন্টেলিজেনশিয়ার নৈতিক বৈধতার সংকট তৈরি করেছে। তারা আজীবন যে সেক্যুলার-লিবারেল ভাবধারার পক্ষে সঠিকভাবেই সোচ্চার ছিলেন, আওয়ামী লীগ কেবল ক্ষমতার রাজনীতি করতে গিয়ে এই ভাবধারার বুদ্ধিজীবিদের কঠিন প্রশ্নের মুখে ও পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে বামপন্থার হাতে গোনা কয়েকজন বুদ্ধিজীবি ছাড়া (অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ), বাকী সেক্যুলার-লিবারেল বুদ্ধিজীবিরা শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য কথাটা বলার সাহস দেখাননি। শেখ হাসিনা যে অগ্নিপরীক্ষায় তাঁদের ফেলেছেন সেটিতে তারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেবল ফেলই করেননি বরং দেখিয়েছেন যে তারা আওয়ামী লীগেরই পোষ্য, ”দলীয় কবি ও বুদ্ধিজীবি” ভিন্ন কিছু নন। আমাদের পুরো সেক্যুলার-লিবারেল এস্টাবলিস্টমেন্টের বড় অংশকে এভাবে নগ্ন করে দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনা পুরস্কার না তিরস্কার পাবেন সেটি ইতিহাস-কর্তৃক নির্ধারিত হবে।
পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল ও পুরস্কারের বেদনা
একজন পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল মানুষ হিসেবে নিজের উৎকর্ষতা ও আলোকিত অবস্থানের কারণেই সবসময় মানুষের অধিকারের পক্ষে থাকবেন বলে আশা করা হয়। এবং মানুষের অধিকার রক্ষার মূল কাস্টডিয়ান হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সরকার, প্রতিষ্ঠানগুলো। আমরা মানবাধিকারের ভাষায় বলি রাষ্ট্র তিনভাবে এ দায়িত্বটি পালন করে: Respect – কিছু অধিকারকে সম্মান করে (যেমন- রাষ্ট্র বা সরকার-কর্তৃক নাগরিকদের ক্ষতি না করার নীতি), Protect – কিছু অধিকারকে সুরক্ষা দিয়ে (যেমন- চিন্তা ও বিবেকের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম পালন প্রভৃতির সুরক্ষা), এবং Fulfill – কিছু অধিকার পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের মাধ্যমে (যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান প্রভৃতি অধিকার)। এবং এ দায়িত্বগুলোর লংঘনে বা বরখেলাপেও রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানগুলোই সর্বাগ্রে থাকে। অন্তর্গতভাবেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর চরিত্র নিপীড়কের – সেটি যে ধরনের সরকার ব্যবস্থাই থাকুক না কেন। একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় একগুচ্ছ নিয়ম ও প্রথার আওতায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করার ব্যবস্থা করা হয় এবং তার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত নিপীড়ক চরিত্রে কিছুটা ভারসাম্য আনা হয়। একটি অগণতান্ত্রিক সরকার কাঠামোয় জনগণের সেই বিপুল নজরদারির ভূমিকাটি অনুপস্থিত থাকে যার ফলে প্রতিষ্ঠাগুলো আরো বেশি উৎপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্র সমাজের এই জবাবদিহিতার লড়াইয়ে পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়ালরা জনগণের পক্ষের শক্তি হবেন, নিপীড়ক রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নয় এমনটিই সর্বজনবিদিত ধারণা। যারা এস্টাবলিস্টমেন্টের পক্ষে, প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে তারা কনফরমিস্ট বা দালাল বুদ্ধিজীবিতে পরিগণিত হন।
নিপীড়নবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সুবিধা বণ্টনের মাধ্যমে স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবিদের বশে আনতে চায়। যার ফলে যৌক্তিক প্রশ্ন উঠতে পারে যে, একজন পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়ালের কি সরকারি পুরস্কার গ্রহণ করা উচিত? আমার বিবেচনায়, না। অবশ্যই না। এটি কেবলই সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবির নৈতিক অবস্থানকে আপোষকামী করে তোলে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সততা চর্চায় একটি অনাহুত মানসিক প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তৈরি করে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গত ৭ বছরে এই স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থার অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি দলীয় বুদ্ধিজীবির বাইরে একজন পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল হয়ে উঠতে পারেননি এবং তার কিছুটা দায় তার ঋণবোধ। তিনি সরকারের সম্বর্ধনা ও পুরস্কারের সম্মুখ সারিতে ছিলেন। এছাড়া তাঁর পদ্মভূষণ খেতাব গ্রহণ (ভারত সরকার-কর্তৃক) ছিলো একটি উৎকট ও অংসবেদনশীল ব্যাপার এবং বুদ্ধিজীবি হিসেবে তার অবস্থানকে যেটি আরো বেশি খাটো করেছে।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, বুদ্ধিজীবিরা কি কোন পুরস্কারই গ্রহণ করবেন না? অবশ্যই করবেন। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করবেন, যেকোনো ফাউন্ডেশন যাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সাথে পুরস্কার গ্রহণকারী ব্যক্তির স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই কিংবা ঘোষিত পুরস্কারের কোনো সম্পর্ক নেই এরূপ সকল পুরস্কার গ্রহণ করবেন। আমি মনে করি একজন স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবি তখনই পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল হয়ে উঠেন, উঠবেন, যখন তিনি সরকারি, বা সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর পুরস্কারের লোভ সংবরণ করতে পারেন, তাদের মুখের উপর সত্য বলার সাহস রাখেন, দেখান। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শেখ হাসিনা বা স্বৈরাচারি আওয়ামী লীগ রেজিমের মুখের উপর সত্য কথাটা বলেন নি, সত্য বলার সাহস দেখাননি। বরং তাদের “ঘরানার” একজন (নির্মলেন্দু গুণের মতো “দলীয় কবি”) হয়ে উনার চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতার সীমারেখা নিজেই টেনে দিয়েছেন। সেজন্য, একজন নাগরিক হিসেবে উনার প্রয়ানে আমি শোক করিনি। এবং আমি বা আমার মতো শত বা হাজারো নাগরিকরা শোক না করলে হয়তো অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কিছু আসবে যাবে না – কারণ উনি হয়তো আওয়ামী লীগের রাজ বুদ্ধিজীবিই হতে চেয়েছেন। এটি কেবল অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সংকট নয়, এটি বর্তমানে বাংলাদেশের পুরো সেক্যুলার-লিবারেল এস্টাবলিস্টমেন্টের সংকট। এবং এ সংকট ও শূন্যতা থেকেই হয়তো বাংলাদেশের নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূচনা হবে।