বুর্জোয়া রাজনীতির দুর্বৃত্তায়িত সাংগঠনিক কাঠামো, একনায়িকাতন্ত্র, ও একটি আত্মহননের দলিল

বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক রসদ হচ্ছে হালুয়া-রুটির ভাগ-বটোয়ারা, যেমন- টেন্ডারবাজি, কমিশন-বাণিজ্য (কমিশনের ভাগ-বটোয়ারা উপর তলা পর্যন্ত যায়), নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, টেস্ট রিলিফ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বিভিন্ন সরকারি ভাতা (জনগণের টাকা) তছরুফ, ঋণের নামে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের (পড়ুন জনগণের) টাকা দলীয় প্রভাব খাটিয়ে লুটপাট প্রভৃতি। এসব দলে যে ভালোমানুষ নেই তা না, তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য এবং এই অপরাজনীতির কাঠামোয় তারা কোনঠাসা। প্রসঙ্গটি কেন তুললাম? তুললাম এই জন্য যে, এ ধরনের বুর্জোয়া দুর্বৃত্ত সাংগঠনিক কাঠামো দিয়ে একনায়িকাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা আত্মঘাতি এবং টেকসই নয়।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন অগণাতান্ত্রিক বর্তমান স্বৈরাচারী সরকার কাঠামোর বয়স প্রায় ০৬ বছর (২০১৪ সাল থেকে); এর মধ্যেই এটি লুটপাটের ভারে নুইয়ে পড়েছে এবং কোমায় চলে গেছে। কোন ডাক্তার এসে বিকল্প অক্সিজেন মাস্কটি খুলবে সবাই তার অপেক্ষায়।

বাংলাদেশের আরেকটি বড় বুর্জোয়া দল বিএনপি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদেরও কি একই হাল হতো? নিঃসন্দেহে। বস্তুত, ১৯৯০ পরবর্তী গণতান্ত্রিক ট্রানজিশনে বিএনপিও একই চেষ্টা করেছিলো দুইবার: প্রথমবার ১৯৯৬ সালে (১৫ ফেব্রুয়ারি) এবং দ্বিতীয়বার ২০০৭ সালে (২২ জানুয়ারি)। প্রথমবার তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে সরকারি আমলারা আর দ্বিতীয়বার তাদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে উত্তর পাড়ার জেনারেলরা। এটি বিএনপির রাজনীতির জন্য সাপেবর হয়েছে। কারণ যেকোনো একটি প্রচেষ্টা সফল হলে তাদের দশাও বর্তমান আওয়ামী লীগের মতো বা তার চেয়ে খারাপ হতো।

বুর্জোয়া দলগুলো রেজিমেন্টেড নয়, রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় (কর্মী, নেতা তৈরির প্রক্রিয়ায়) নীতি-আদর্শের চেয়ে হালুয়া- রুটির ভাগবটোয়ারাই প্রধান ক্রীড়নক (রাজনীতি বিজ্ঞানের ভদ্র ভাষায় এটিকে পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করা হয়)। তো এ ধরনের ভাগবটোয়ারার কাঠামো কখনোই দীর্ঘমেয়াদী, স্বেচ্ছাচারী শাসনের জন্য উপযুক্ত নয়। কেউ সে চেষ্টা করলে এটা ওয়ান-ওয়ে টিকেট – অর্থাৎ পতন হলেই শেষ। যার কারণে বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান কিংবা এরশাদ ভিন্ন পন্থায় ক্ষমতায় আসলেও নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধতা অর্জন করতে চেয়েছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তথাকথিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭৫-৯০ সালের সামরিক আমলের নির্বাচনগুলোর চেয়ে বহুগুণ খারাপ হয়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে একটি চূড়ান্ত অগণাতান্ত্রিক সরকার কাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণ বিএনপি’র ডাকে রাস্তায় নামছে না কেন? উত্তর হচ্ছে জনগণ জানে বিএনপিও অতীতে একতরফা নির্বাচন করেছে বা করতে চেয়েছে এবং পুনরায় সুযোগ পেলে যে একই কাজ করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাশাপাশি একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে বিএনপি’র যাবতীয় কার্যকলাপ জনআস্থা বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। যেমন, নিজ দলে গণতন্ত্র চর্চার ঘাটতি, জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয়তা প্রভৃতি। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রায় ৭০ ভাগ মানুষের অনুপস্থিতি এই গভীর সংকটের স্বরূপ মাত্র।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা কিংবা অন্যান্য দেশের দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরশাসনের দিকে ইঙ্গিত করে বাংলাদেশে কেন তার পুনরাবৃত্তি হবে না তা জানতে চেয়েছেন। প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক এবং আগ্রহোদ্দীপকও। আমি দুটি কারণে বাংলাদেশে এ ধরনের সম্ভাবনার পুনরাবৃত্তি নাকচ করতে চাই।

প্রথম কারণটি হচ্ছে এ দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। ব্রিটিশ-বিরোধী বড়-বড় আন্দোলনের সূতিকাঘার ছিলো বাংলা। তারপর পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ – এই পুরো সময়টি বিশ্লেষণ করলে এখানকার মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার মাত্রা উপলব্ধি করা যায়। যার ফলে এখানে স্বেচ্ছাচারী শাসনের ভবিষ্যৎ খুব একটা উজ্জ্বল নয়। কেউ দাবী পারেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সবসময় যে ঘটবেই এমনটা তো নাও হতে পারে। সত্য। তবে এ ধরনের ব্যতিক্রম ঘটার জন্য যেসব শক্তির উপস্থিতি জরুরি (দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি এবং সুশাসন) সেগুলো আমাদের এখানে অনুপস্থিত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির ভিত্তি রচিত হয়েছিলো ১৯৯০-পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসনামলে। ১৯৯০-পরবর্তী দীর্ঘ ২০ বছরের গণতান্ত্রিক পরিক্রমায় এখানে অর্থনৈতিক উদারীকরণ, বৈশ্বিক সংযোগ, টানা ৫ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক খাতের সাফল্য সূচিত হয়েছে। বরং অগণতান্ত্রিক শাসনামলের সাম্প্রতিক বছরগুলোর জবাবদিহিতাহীন অপশাসন ও অভাবনীয় দুর্নীতি গণতান্ত্রিক শাসনামলের দীর্ঘ ২০ বছরের অর্জন নসাৎ করে দিতে চলেছে।

দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে শাসন প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ। ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলো বাদ দিলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব র‌্যাঙ্কিংয়ের বাকী দেশগুলোর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এত ক্ষুদ্র আয়তনের দেশে (বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১২৫০ জন মানুষের বিপরীতে ভারতে মাত্র ৪৫৯ জন) এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ব্যবস্থাপনা, তাও বিশেষ কোনো প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার ছাড়াই, একটি অনন্য চ্যালেঞ্জ। শাসনব্যবস্থা নিয়ে জন-অসন্তুষ্টি ও শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা যেকারণে অনিবার্য। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এই অনিবার্যতার দায় কিছুটা জনগণের পছন্দের (নির্বাচন) ভুল বলে পাঁচ বছর পর তাদের তা সংশোধনের সুযোগ দিয়ে থাকে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এ অসন্তুষ্টি ধুমায়িত হতে থাকে এবং রিলিজ ভাল্বের (এক্ষেত্রে নির্বাচন) অনুপস্থিতিতে এক সময় এর বিস্ফোরণ ঘটে। আমাদের এখানে যার ফলে এটি ঘটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

বাংলাদেশে বর্তমানে জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন একটি অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায়, বিএনপি তাদের অতীত কর্মকাণ্ড ও কাঠামোগত কারণে একটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে নেতৃত্ব প্রদানে অক্ষম। যার ফলে এই অগণতান্ত্রিক সরকার কাঠামো কি আরেকটি অগণতান্ত্রিক শক্তির কাছে পরাজিত হবে নাকি গণঅভ্যুত্থানে বিদায় নেবে সেটিই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। প্রথমটি ঘটলে আওয়ামী লীগ পরাজিত শক্তি হিসেবে বিধ্বস্ত হবে, কিন্তু ৭০ ভাগ বা তারো বেশি জনগণ মোটেই মাথা ঘামাবে না। দ্বিতীয়টি বেশিরভাগ মানুষের কাঙ্ক্ষিত কিন্তু তাদের এজেন্সি কারা বা তাদের স্বরূপ কী তা পরিষ্কার না হলে মানুষ রাস্তায় নামবে না। তবে যেটিই ঘটুক গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির কপালে শনি যে আসন্ন সে ব্যাপারে কম বিশ্লেষকই দ্বিমত পোষণ করেন। এর দায় দলটির ক্ষমতালোভী নেতৃত্বের আর কারো নয়। কারণ বুর্জোয়া রাজনীতি ও বিপ্লবী রাজনীতির মৌলিক তফাৎ হৃদয়ঙ্গম না করে স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা যে আত্মহত্যার নামান্তর তা বুঝতে দলটির নেতৃত্ব নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং দলটিকে খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে। দলটি শীঘ্রই সেই স্বাদ পেলে কেউ আশ্চর্য হবে না।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান