বাংলাদেশের “সরকার” নাকি “সিদ্ধান্ত” নিয়েছে তার কর্মচারীদের অনেককে প্রায় কোটি টাকা থেকে শুরু করে অর্ধ কোটি টাকা দিবে গাড়ি কেনার জন্য। কোনো ব্যক্তির টাকা থাকলে সে এক কোটির গাড়ি কেন, ১০০ কোটি টাকার ব্যক্তিগত বিমানও কিনতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে “সরকারের” টাকা, এটি আসলে কার টাকা? কোত্থেকে আসে? কে, কিভাবে সংগ্রহ করে? কারা, কিভাবে, কার অনুমতি নিয়ে খরচ করে? গাড়ি বিতর্কে যাওয়ার আগে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি…
আপনি কি জানেন ১০ টাকায় এক প্যাকেট বিস্কুট, ২০ টাকায় এক বোতল পানি, কিংবা একটা বিড়ি বা সিগারেট কিনলে, অথবা গলির কোনো হোটেলে বসে এক প্লেট ডালভাত খেলেও আপনার পকেট থেকে রাষ্ট্রের কোষাগারের জন্য টাকা দিতে হয় (ভ্যাট হিসেবে)?

একজন গরীব রিকশাচালক ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত শরীরে রাস্তার পাশে, ফুটপাতে ৫ টাকায় একটা শুষ্ক পাউরুটি কিনে, এক কাপ চা খায়, এই রাষ্ট্র সে গরিব মেহনতি মানুষের ঘামে অর্জিত টাকায়ও ভাগ বসায়? তার কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে নেয়? পোশাক কারখানার যে শ্রমিক ভাই বা বোনটি কারখানার নিদারুণ কর্ম পরিবেশে নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়ে মাসে ৮-১০ হাজার টাকা রোজগার করে বাড়ি ফেরে, নিজের চাল-ডাল কেনে, সেখান থেকেও এই নিষ্ঠুর রাষ্ট্র ভ্যাটের নামে টাকা আদায় করে? মধ্যপ্রাচ্যের তপ্ত বালুতে পুড়ে কিংবা শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মাসে ২০০ রিয়াল আয় করা প্রবাসী ভাই-বোনদের পাঠানো টাকা এই রাষ্ট্রের অর্থনীতির মেরুদণ্ড?
এই রাষ্ট্রের কোষাগার, প্রতিটি টাকা এভাবে জনগণের ঘামের টাকা, তাদের শ্রমের টাকা। এই টাকা দিয়ে শাসক ও তার সাগরেদদের বেতন-ভাতা চলে। এই টাকা দিয়ে আপনার-আমার নিরাপত্তার জন্য আমরা পুলিশ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় পাহারাদার পুষি। যারা কিনা আমাদের টাকায় পোষা হলেও অবৈধ রাণীর নির্দেশ পালন করে, খেদমত করে বেড়ায়। রাণীর প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমাকে-আপনাকে মারে, হেনস্তা করে। প্রয়োজন হলে গুম-খুন করে!
তো এই যে আমার-আপনার কষ্টার্জিত প্রত্যেক মাসের বেতন, বিদেশ থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা প্রতিটি ডলার, প্রতিদিন বাঁচার তাগিদে খরচ করা প্রতিটি পয়সা থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিচ্ছি, সে টাকা এক অবৈধ শাসক কিভাবে আপনাকে-আমাকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া, আপনার-আমার মতামত নেওয়া ছাড়া অন্যের গাড়ি কেনার জন্য ব্যয় করবে?
যেদেশে প্রায় ৫০ ভাগের বেশী মানুষের গড় আয় এখনো দৈনিক ৩০০ টাকার কম, প্রায় ২০ ভাগ মানুষ চরম দরিদ্র (তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না), সেখানে আপনার-আমার কোষাগার থেকে হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের গাড়ি কেনার বিলাসিতার মতো অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যায়ের অনুমতি রাণীকে কে দিয়েছে?
এতে আপনার-আমার সম্মতি আছে? সে হিসেব কী আমরা চাইতে পারি প্রিয় দেশবাসী? অবৈধ শাসককে কী আপনার-আমার এই প্রশ্ন করার সাহস বা সদিচ্ছা আছে যে, “আমার ঘামের টাকায় অন্যকে গাড়ি কিনে দেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”

একটি রিপাবলিক বা জনগণের রাষ্ট্রে জনগণ সাধারণত ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি বাছাই করে (সংসদে পাঠায়)। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা (নির্বাহী বিভাগ – যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভা, সচিবসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা অন্তর্ভুক্ত) জনগণের কোষাগার থেকে করা বিগত বছরের আয়-ব্যয়ের হিসেবসহ কোষাগারের বর্তমান অবস্থা সংসদের নিকট পেশ করে। এভাবে রাষ্ট্রের কর্মচারীরা পরোক্ষভাবে জনগণের টাকার হিসেব জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট তুলে ধরে। এবং আগামী বছরের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনাও সংসদের (পরোক্ষভাবে জনগণের) অনুমতির জন্য পেশ করে। আমি-আপনি যে টাকা দিয়ে পরোক্ষভাবে আমাদের রাষ্ট্র চালাই তার জবাবদিহিতা এভাবে হওয়ার কথা।
এখন প্রশ্ন হলো জনগণ যদি তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারে, তাহলে তাদের টাকার কী হবে? তারা কাদেরকে টাকা দিচ্ছে? সে টাকা কারা, কোন ক্ষমতাবলে, কার অনুমতি নিয়ে খরচ করছে? কে সিদ্ধান্ত নিবে কার গাড়ী লাগবে না পেয়াজ আগে লাগবে? জনগণ ভোট দিতে না পারলে, তাদের সত্যিকারের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে না পারলে, তারা তাদের টাকার উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। তখন ডাকাত দলের মতো একদল লোক জনগণের কোষাগারের দখল নেয়। জনগণের টাকা যেভাবে খুশী খরচ করে। বিদেশে পাচার করে। ১ টাকার রাস্তা ১০ টাকায় বানায় – কারণ জনগণের কাছে জবাবদিহি করার কিছু থাকে না বলে (কারণ সংসদ ডাকাতদলের দখলে থাকে) রাষ্ট্রের কর্মচারীরা (প্রধানমন্ত্রীসহ) নিয়ন্ত্রণহীনভাবে, দেদারসে লুটপাট চালিয়ে যেতে পারে।
আপনার কষ্টার্জিত টাকার মালিকানা ডাকাত দলের হাতে পড়ে বেদখল হয়ে গেলে আপনি কি করবেন? ডাকাতদের হাতে অস্ত্র আছে, আপনাকে অস্ত্রের ভয় দেখাচ্ছে… তো? আপনি তাকিয়ে, তাকিয়ে দেখবেন না-কি “যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর” মোকাবেলা করবেন?
সঠিক প্রশ্ন জানা জরুরি, প্রশ্নটাও এখন সাহস করে কেউ করে না। সেই প্রশ্নটাই তুলে ধরলাম, উত্তরটা আপনার, আপনাদের…