ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি‘র নৃশংস খুনের দায়ে কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি হয়েছে এটি নি:সন্দেহে স্বস্তির খবর। রাফির পরিবার রাফিকে ফিরে পাবে না কিন্তু অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি পেলে রাফির আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পাবে। এ বিচার কাজে জড়িত সংশ্লিষ্ট বিচারককে এবং দ্রুত তদন্ত কাজ পরিচালনা ও চার্জশিট প্রদানের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। দেশে প্রতিটি খুন-রাহাজানি এভাবে তড়িৎ গতিতে তদন্ত, চার্জশীট, বিচার হবে নাগরিক হিসেবে আমাদের এটিই প্রত্যাশা।
কিন্তু এই মামলার বিচারের রায় ঘোষণার পর কিছু প্রতিক্রিয়া প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। ‘বিচার‘ হয়েছে – এই খুশীতে আটখানা হয়ে কারো কারো অতিশয় উচ্ছ্বাস ও অভিনন্দন বার্তাই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশে আইনের শাসনের বর্তমান স্বরূপ কী! যেখানে শাসকের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কার বিচার হবে না হবে সেটি নির্ধারিত হয় সেখানে এ ধরনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ হয় অজ্ঞতার নামান্তর নয়তো নিতান্তই আপত্তিকর।
প্রথমত দেশে আইনের শাসন থাকলে অথবা ‘আইন নিজের গতিতে‘ চললে রাফি হত্যার দায়ে অভিযুক্তদের স্বাভাবিক নিয়মে শাস্তি হতো। কোনো ‘ঐশী‘ হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু বাংলাদেশী মাত্রই জানেন এখানে খুন, ধর্ষন, নির্যাতনের শিকার হওয়া নাগরিকরা থানায় গেলে পুলিশ মামলা নিতে চায় না, মামলা হলে পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা খেয়ে দুর্বল চার্জশীট দেয়ার বিস্তর অভিযোগ, আর আদালত পাড়ায় কী হয় তা বলে মানহানির মামলা খেতে চাই না। যেকারণে এদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু বকর-কে ছাত্রলীগ খুন করলেও বিচারকরা কোনো খুনী খুঁজে পাননি এবং শাসকরা বিচার হয়েছে বলে বগল বাজানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। সম্ভবত আবু বকর খুনের কোনো ক্যামেরা ফুটেজ নেই কিংবা তার খুন নিয়ে সংবাদ মাধ্যম চাঞ্চল্য তৈরি করতে পারেনি বলে।
বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ৫০০-রও বেশি লোককে শাসক দল তার বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে গুম করেছে, ২০০০-এর বেশি লোককে বিনা-বিচারে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। এবং সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হচ্ছে এই অপরাধগুলোর বিচার তো দূরে থাক, এসব বিষয়ে যাতে অপরাধের শিকার পরিবারগুলো মামলাও করতে না পারে সেজন্য সরকারি বিভিন্ন বাহিনী হুমকি-ধামকি দিয়ে তাদের দমিয়ে রাখে। তো এরকম ‘ন্যায়ের‘ শাসনের একটি দেশে নুসরাত জাহান রাফি‘র হত্যার আপাত বিচার হয়েছে এতো আশ্চর্যেরই ঘটনা! সে কারণেই কি কারো কারো তালিটা জোরে বাজছে? আর বিচারের জন্য কাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে একটু খেয়াল করেন! এতদিন যে বহু মানুষ বিভিন্নভাবে অভিযোগ করেছে যে ‘নেত্রী‘র ইশারা ছাড়া আদালতও নড়ে না, রাফি‘র বিচারে অভিনন্দন দেখে বুঝেছেন তো কার ইশারা ছাড়া কী নড়ে না? আফসোস উনি যদি বকর, তনু, সাগর-রুনিসহ এই আমলে শাসক দলের ক্যাডারদের হাতে সংঘটিত অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেও একটু ইশারা দিতেন!
সবশেষে একটি প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই: যেদেশে একটি হত্যার বিচার হওয়াটা ‘নেত্রী‘-র সফলতা, সেদেশে শত-সহস্র রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক খুনের বিচার না হওয়াটাও ‘নেত্রী‘র ব্যর্থতা কি-না এ বিষয়টা একটু ‘প্রিয়-নেত্রী‘-কে জিজ্ঞাসা করিবেন প্রিয় দলকানা কর্মীগণ?
পুনশ্চ: মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে মৃত্যুদণ্ড একটি নিষ্ঠুর, অমানবিক শাস্তি। যারা উন্নত মানুষ তারা জানেন একজন অপরাধীরও মানবাধিকার রয়েছে এবং তা যথাযথভাবে সুরক্ষিত করতে হয়। আশা করি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হবে।