কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের “কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে“ কাব্যাংশের গভীর মর্মার্থ উপলব্ধি না করলে সংখ্যালঘু হিসেবে বেঁচে থাকার কী যাতনা সেটিও উপলব্ধি করা কঠিন! যারা কর্ম-পড়াশোনা-আশ্রয়-অভিবাসনের নিমিত্তে বিদেশ-বিভূঁইয়ে পড়ে আছেন, তারা ঠিকই জানেন সংখ্যালঘুত্বের কী যন্ত্রণা! আপনাদের অনেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনীতি ও ক্ষমতার সংগ্রাম ও তার কোল্যাটারাল ড্যামেজ-কে সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব, অনিশ্চয়তা, বেদনার দোলাচলের সাথে মিলিয়ে ফেলেন। এটা চরম ভ্রান্তি।
বিশ্বাস করেন একজন মানুষকে যখন পারিপার্শ্বিকতার কারণে ভাবতে হয় যে তিনি ‘সংখ্যাগুরু‘ নন, বা তিনি যে সমাজে বাস করেন সেখানে প্রতিনিয়ত তাঁকে এ প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয়, তাঁর মতো হতভাগা মানুষ আর নেই। একজন রাষ্ট্রহীন মানুষের মর্মবেদনা তাকে নিঃস্ব করে দেয়। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের একজন হলে আপনি বিশেষ প্রাধিকার-প্রাপ্ত। এটি সত্য যে এই বিশেষ-প্রাধিকারের অংশীদার হয়েও আপনি বিভিন্ন শ্রেণি-রাজনৈতিক-কাঠামোগত বৈষম্যের শিকার হতে পারেন। আপনারও একটি সংগ্রাম থাকবে। এবং কখনো কখনো সেটি নিষ্ঠুরও। কিন্তু মনে রাখবেন সমাজে ‘সংখ্যালঘু‘ হিসেবে যাদের বেঁচে থাকতে হয় তাদের সংগ্রামটা এর চেয়েও বড়, অস্তিত্বের।
একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাজে যাতে এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র (tyranny of majority) কায়েম না হয়, সেজন্য বিভিন্ন সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদান করা হয় এবং সেগুলো নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত থাকে। সে প্রতিষ্ঠানগুলোকে হতে হয় ‘নির্মোহ‘, ‘নৈর্বক্তিক‘ যেখানে ব্যক্তির নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় ছাপিয়ে নাগরিকত্বের পরিচয়ই প্রধান ধর্তব্য, মাপকাঠি হয়। এ ধরনের সাংবিধানিক বিধানাবলী ও প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত সমাজে ও রাষ্ট্রে যাতে কাঠামোগত কোনো বৈষম্য দানা বাঁধতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করে। একটি সুসংহত, উন্নত গণতন্ত্রের অগ্রসর ধাপ এটি। পশ্চিম ইউরোপে আমরা এ ধরনের গণতান্ত্রিক, মানবিক রাষ্ট্রের বিকাশ প্রত্যক্ষ করেছি।
আফসোসের বিষয় হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের আলাপটা এখনো আতুঁড়ঘরে। গণতন্ত্রের প্রথম ও মৌল শর্তটি, অর্থাৎ নির্বাচন, সেটিকে আমাদের বর্তমান শাসকরা ছুড়ে ফেলে জনগণের উপর একটি স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে দিয়েছে। যার ফলে মোটাদাগে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের বর্তমান লড়াইটা ১৯৯০-পূর্ববর্তী সময়ে ফিরে গেছে যেখানে মানুষকে তাদের ভোটাধিকার পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য লড়তে হচ্ছে। আমরা আবারো নিশ্চয়ই এই ভোটাধিকার ফিরে পাবো এবং গণতন্ত্রের ট্রেনটি তার নিজস্ব ট্র্যাকে উঠবে। কিন্তু আমরা যে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই সেখানে নাগরিকত্বের এই আলাপটাকেই সামনে নিয়ে আসতে হবে। সেখানে নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে বিস্তর আলাপ হবে। সংবিধান, আইন, প্রতিষ্ঠান – এগুলো আবর্তিত হবে নাগরিকত্বের, নাগরিকদের প্রয়োজনীয়তার নিরিখে, উল্টোটা নয় (বর্তমানে যে প্রবণতা বিদ্যমান)।
আমাদের স্বপ্নের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষ তার নাগরিকত্বের পরিচয়ে পরিচিত হবে – তার নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বিশ্বাস দিয়ে নয়। আমরা আমাদের সংবিধান, আইন ও বিধানগুলোকে নাগরিকত্বের প্রয়োজনে নতুন করে সাজাবো। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে গড়ে তুলবো যেখানে ব্যক্তির অদল-বদলে প্রতিষ্ঠান তার চরিত্র হারাবে না এবং নাগরিকদের সেবা প্রদানে প্রতিষ্ঠানসমূহ মানুষের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে আগ্রাহ্য করবে। আমাদের রাষ্ট্রে কেউ সেবার আবেদন করলে এসব পরিচয় প্রদানের নিয়ম, বাধ্যবাধকতাই তুলে দেওয়া হবে।
আমাদের গণতন্ত্রের লড়াই একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনেরও লড়াই।