একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিক হিসেবে আমার কর্তব্য কী?

একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকদের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য কী? তারা কী রাজনৈতিক আদর্শগত বিরোধী অবস্থানকে প্রধান গণ্য করে নিজেদের মধ্যকার বিবাদকে সর্বাগ্রে স্থান দিবে যেখানে অগণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী সুবিধা পায়? না-কি এ ধরনের বিরোধকে আপাত: গৌণ হিসেবে বিবেচনা করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে প্রথম ও প্রধান ধর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করবে?

আমার উত্তর হচ্ছে একটা অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের নিকট শাসক দল বা বিরোধী দল বলে কোন কথা নেই। সেখানে জনগণের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হলো স্বৈরাচারী শাসকদের যেকোনো উপায়ে ডিলেজিটিমাইজ করা, তাদের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই বলা, লিখা, জনগণকে সংগঠিত করা। গণতন্ত্রের সংগ্রাম করা। অর্থাৎ জনগণের রাষ্ট্রে জনগণের পছন্দের সরকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করা। কোনো তথাকথিত বিরোধী দল সে দায়িত্বটি পালনে ব্যর্থ হলে লড়াইটা একটু দীর্ঘ হবে, কিন্তু একটা সময় জনগণের মধ্য থেকেই সে প্রতিরোধটা গড়ে উঠবে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ নীতি-আদর্শ নিয়ে বিতর্ক করবে, সরকার ও বিরোধী উভয় দলের সমালোচনা করে উভয়কে চাপে রাখবে যাতে তারা জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়। উদারপন্থা না রক্ষণশীলতা, সেক্যুলারিজম নাকি রাজনৈতিক ইসলাম সে বিতর্ক করবে, কিংবা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ভূমিকা কম না বেশি সে নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত (মাঝের ২০০৭-০৮ ছাড়া) বেশিরভাগ সময়ে আমরা তাই করেছি। আদর্শিক দিক থেকে আমরা যারা রাষ্ট্র ও ধর্মের বিভাজন চেয়েছি, কিংবা উগ্রপন্থার বিরোধীতা করেছি – আমরা একটা রাজনৈতিক মতের বিপরীতে আরেকটি মতকে মৌন বা সক্রিয় সমর্থন দিয়ে গিয়েছি। কারো দলদাস না হয়েও। এই পক্ষ বা বিপক্ষের সমর্থন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আদর্শিক, চিন্তার ভিন্নতার। কারণ গণতন্ত্রকে সংহত করা, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা সময়সাপেক্ষ দীর্ঘ লড়াই। সেখানে মতভিন্নতা ও বিতর্ক গণতান্ত্রিক সমাজের অংশ, স্বাস্থ্যকর। এবং আমরা সবাই প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্র (Procedural Democracy, যা মূলত নির্বাচন-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা) থেকে সুসংহত গণতন্ত্রে (Consolidated Democracy) উন্নীত হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলাম।

কিন্তু ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করে প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্তটি ছুড়ে ফেললো, অর্থাৎ জনগণকে রাষ্ট্রের মধ্যে চূড়ান্ত ক্ষমতাহীন করে ফেলে একটি স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম করলো যেখানে একদল দুর্বৃত্ত জোর করে জনগণকে শাসন করছে, সেখানে ন্যূনতম বিবেক-বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন কিংবা ‘স্বাধীন‘ চিন্তা-চেতনার মানুষদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য হলো শাসকগোষ্ঠীকে যেভাবে পারা যায় ডিলেজিটিমাইজ করা, সুযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা, এবং জনগণের সংগঠিত প্রতিবাদের সুযোগ তৈরি করা বা তার সাথে থাকা। সে প্রতিবাদ ডান-বাম-মধ্য যেদিক থেকেই আসুক না কেন। বাকী বিষয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে (সেটি প্রক্রিয়াগত গণতন্ত্র হলেও) ফয়সালা করা যাবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান