রুমিন ফারহানা বর্তমান সংসদে বিএনপি দলীয় একজন সংসদ সদস্য। তিনি এই সংসদকে সংসদের ভেতরেই অবৈধ বলার সাহস প্রদর্শন করে বহু মানুষের করতালি কুড়িয়েছেন, পাশাপাশি সরকারদলীয় ভ্যানগার্ডদের নিন্দাও কুড়িয়েছেন। তো তিনি সেই ‘অবৈধ‘ সংসদের মাধ্যমে গঠিত একটি সরকারের জনৈক মন্ত্রীর নিকট ১০ কাঠা প্লট ভিক্ষা করেছেন! যার জন্য তিনি ‘চিরকৃতজ্ঞ‘ থাকিবেন বলেও জানিয়েছেন। এই হচ্ছে আমাদের ‘জাতীয়তাবাদী বীর সেনানী‘দের নৈতিকতার জোর! যারা কি-না একটা ১০ কাঠা প্লট-এর লোভ সামলাতে পারে না, তারাই করবে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াই?!
সত্য হচ্ছে বাংলাদেশে ১৯৯০ এর পর যে দুটি দল বাংলাদেশকে পালাক্রমে ‘ধর্ষণ‘ করেছে তাদের কোনোটির মধ্যেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের লেশমাত্র নেই। দুটো দলই নির্বাচনী গণতন্ত্রকে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিড়ি হিসেবে দেখেছে। দুটো দলই ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে (বিএনপি ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালে, আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে) – পার্থক্য হচ্ছে বিএনপি ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারেনি, আওয়ামী লীগ পেরেছে। বিএনপি‘র না পারার কারণ আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কিংবা তথাকথিত সাংগঠনিক শক্তি নয়, যা তথাকথিত পণ্ডিতরা দাবী করে থাকেন। বিএনপি‘র বিরুদ্ধে আন্দোলনে এখনকার চেয়ে ১০০ গুণ সহনীয় পরিবেশেও (তখন গুম ছিলো না, মিছিলে পুলিশ এতটা বেপরোয়াভাবে গুলি-বোমা মারেনি) আওয়ামী লীগ জনগণকে ব্যাপক মাত্রায় সংগঠিত করে রাস্তায় নামাতে পারেনি, যার ফলে বিএনপিকে ‘জনদাবী‘ মানতে বাধ্য করা যায়নি। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে কাবু করেছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র দিয়ে। দেশী-বিদেশী শক্তি, প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীকে সফলভাবে ব্যবহার করে – ১৯৯৬ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের রাস্তায় নামিয়ে, ২০০৭ সালে উত্তর পাড়ার লোকদের রাস্তায় নামিয়ে। বিএনপি এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের খেলায় পরাজিত হয়েছে – শোনা যায় ২০১৪-সালের একতরফা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তারা গোটা কয়েকবার উত্তর পাড়ার লোকদের উপর ভরসা করে ধরা খেয়েছে। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের এই খেলায় একটি পক্ষ পরাজিত হওয়ায় নির্বাচনের নামে গণতন্ত্রের যে সলতেটুকু নিভু-নিভু ছিলো তাও নিভে গেছে। বিএনপি‘র সৌভাগ্য ১৯৯০ পরবর্তী নির্বাচনী গণতন্ত্র হত্যায় ইতিহাসে তাদের নামের বদলে আওয়ামী লীগের নাম সর্বাগ্রে থাকবে। মাঝে ১৯৯৬ সালে ‘স্বেচ্ছায়‘ ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্বিঘ্ন ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিহাসও অবশ্য আওয়ামী লীগেরই থাকবে। যদিও বিচারপতি শাহাবুদ্দিনকে ‘বিশ্বাসঘাতক‘ বলে তারা নিজেরাই সে ইতিহাসকে কালেমালিপ্ত করেছে। শাহাবুদ্দিন সাহেব তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন বা বিএনপি‘কে ক্ষমতায় যেতে দিবেন না এই ‘সরল‘ বিশ্বাসে তারা নির্বিবাধে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন কি-না তা ইতিহাস বিচার করবে। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮-এ তারা বিএনপি-কে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের খেলায় পরাজিত করার সফলতার জন্য নয় বরং জনগণকে ‘সফলভাবে‘ ক্ষমতাহীন করার দায়ে তাদের অতীতের যা কিছু অর্জন ধুলায় মিশে গিয়েছে। যারা ভাবছেন বড় কয়েকটা ব্রিজ, ফ্লাইওভার দিয়ে জনগণের সাথে তাদের এত বড় বিশ্বাসঘাতকতাকে হোয়াইট ওয়াশ করবেন, তারা এখনও পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের চিন্তার চেয়ে বড় হতে পারেন নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপ থেকে জার্মানিকে মাত্র ছয় বছরের মাথায় কন্টিনেন্টাল ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতি ও শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য ইতিহাস হিটলারকে মনে রাখে না, রাখে তার পরবর্তী জঘন্য কুকর্মের জন্য। বাংলাদেশের বর্তমান স্বৈরশাসকদের এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া আবশ্যক।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের লড়াইয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের মালিক, জনগণের কি হবে? জনগণ কি রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরে পাবে? তাদের এজেন্সি কী? তাদের সংগঠিত করার গণতান্ত্রিক শক্তি কারা? যদি কেউ না থাকে আদৌ কেউ দাড়াতে পারবে? ফ্যাসিস্ট রেজিম যে অবস্থা তৈরি করেছে তাতে যেকোনো গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানকে হামলা-মামলা, হত্যা, গুম করে থামিয়ে দিতে চাইবে। ঢাকসু‘র ভিপি নূর ও তার সহযোগীদের ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের নগ্ন হামলা তারই নিদর্শন। প্রশ্ন হচ্ছে তরুণরা কি এই মামলা-হামলা, মৃত্যু, নির্যাতনের ভয়কে জয় করে, এই নিপীড়নবাদী ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করে সংগঠিত হতে পারবে? এই বঙ্গের কয়েক শ‘ বছরের ইতিহাস বলে, তারা পারবে। দুটো কারণে:
কারণ-১:
সর্ব-ভারতের বিগত কয়েকশ‘ বছরের ইতিহাসে দেশী-বিদেশী দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই-প্রতিবাদ-বিদ্রোহে এই বঙ্গের মানুষই সম্মুখসারিতে ছিলো, এবং সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে। অত্যাচারি, জবরদখলকারী শাসকদের হৃৎকম্পন এই বঙ্গের ইতিহাস ও এদেশের ঘুরে দাঁড়ানো জনগণ। অবশ্যই যেকোনো জনগোষ্ঠীকে শৃঙ্খলিত করা যায় এবং দেশে-দেশে, যুগে-যুগে সে ইতিহাস ভুরি ভুরি। কিন্তু কোনো জনগোষ্ঠীর ইতিহাস যদি দ্রোহের হয়, তা অত্যাচারি শাসকদের জন্য দুঃস্বপ্নের।
কারণ-২:
গণতান্ত্রিক যুগের আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় যেসব দেশে স্বৈরশাসকগণ জনগণকে ক্ষমতাহীন করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় ছিলো বা আছে, অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেদেশগুলোর বেশিরভাগের অন্যতম প্রধান সমস্যা ট্রাইবাল সমাজ এবং জনসংখ্যার বৈচিত্র: কমপক্ষে একাধিক বড় গোত্র-উপজাতির উপস্থিতি। এবং ট্রাইবাল সোসাইটি ও সংস্কৃতিতে সহিংসতার উপস্থিতি, ও ক্ষমতানীতি ও রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ (জিরো-সাম) অবস্থান তৈরির লড়াইয়ের কারণে যেকোনো একটি প্রধান (Dominant) ট্রাইব ক্ষমতা দখল করে অন্য ট্রাইবগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতাহীন করে ফেলতে পারে। ট্রাইবগুলোর মরা অথবা মেরে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতা (Survival Instinct) যেকোনো একটি পক্ষের ক্ষমতা সংহতকরণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। অবশ্যই অন্যান্য নিয়ামকেরও উপস্থিতি থাকে, কিন্তু অপ্রধান হিসেবে। বাংলাদেশের স্বৈরশাসকদের জন্য দুঃস্বপ্ন হচ্ছে এখানকার জনসংখ্যা মোটাদাগে সমজাতীয় (Homogeneous)। আমাদের যেসব উপজাতি নৃগোষ্ঠী রয়েছে তারা সংখ্যায় কম। যার ফলে জনগণের মধ্যে গোত্রীয় বিভাজন নেই। এখানে এক ভাই এ দল করে তো, আরেক ভাই অন্য দল করে। ধর্ম ও সেক্যুলারিজম নিয়ে যে একটা নকল দ্বন্দ্ব ফেরী করা হতো, তথাকথিত সেক্যুলারিস্টদের ক্ষমতা জবরদখলের মাধ্যমে সে বিভাজনের ইতি ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও যে পক্ষ-বিপক্ষ খেলা ছিলো, তা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিসমাপ্তি (যদিও যার প্রক্রিয়া নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে], কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনার‘ দাবিদারদের ক্ষমতা জবরদখলের মাধ্যমে সেটিরও অবসান হয়েছে বলা চলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের সামনে লড়াই পরিস্কার: গণতন্ত্রের সাথে সম্পর্কহীন রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে নতুন রাজনীতি গড়ে তোলা। যেকোনো জাতির জন্যই প্রথাগত রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন রাজনীতি গড়ে তোলা একটি বড়, দীর্ঘ লড়াই এবং পথটি কণ্টকাকীর্ণ। ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগের রাজনীতির বাইরে গত ১১৪ বছরে বাংলাদেশে নতুন কোনো রাজনীতি দাড়ায়নি বা গড়ে উঠেনি। বর্তমান প্রধান দুটি দলের একটি আওয়ামী লীগ সেই মুসলিম লীগের আওয়ামী সংস্করণ এবং আরেক দল বিএনপি মুসলীম লীগের রক্ষণশীল অংশের সম্মিলন। আদর্শের বিচারে তারা কেউই নতুন রাজনীতি তৈরি করতে পারেনি। এক দল ১৯৭১ সাল নিয়ে রাজনীতি করেছে গত ৫০ বছর এবং আত্মহত্যাও করে ফেলেছে – এখন লাশ দাফনের বাকী। আরেক দল গত ৪০ বছর হাবুডুবু খেয়েছে নতুন পরিচয়ের সন্ধানে। এবং মুসলিম লীগের রক্ষণশীলতার শেকড় থেকে দূরে সরে গিয়ে তারাও মৃত্যুপথযাত্রী।
১১৪ বছরের মুসলীম লীগের রাজনীতি প্রতিস্থাপন কঠিনতম কাজ, কিন্তু সমযোপযোগী, করতেই হবে। নতুন বাস্তবতায় জনগণের সামনে নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে হবে। ইট-কাঠের উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি নয়, মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেবে এই রাষ্ট্রের মানুষ কোথায় যাবে, তাদের গন্তব্য কী – সে পরিচয় সংজ্ঞায়িত করতে হবে। নাগরিকত্বের পরিগঠন, রাষ্ট্রের মালিকানার স্বরূপ, দায়িত্ব, বিশ্বব্যবস্থায় কোন আত্মমর্যাদা নিয়ে তারা এই রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করবে – সেটি স্পষ্ট করতে হবে। এটিই হতে পারে নতুন রাজনীতির প্রাথমিক আলাপ।
সুতরাং, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পরিগঠনের এই সুবিশাল কাজটি কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং রাজনৈতিক চিন্তার মৌলিক পরিবর্তনের, ঔপনিবেশিক সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে সংস্কার, প্রয়োজন হলে প্রতিস্থাপন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী প্রশাসন তৈরির। ব্যাপক মাত্রায় জনগণকে সংঘটিত করে একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সত্যিকারের সেই গণতান্ত্রিক পরিগঠন কঠিন কাজ। এটি কয়েক মাস বা কয়েক বছরের লড়াই নয়, এটি একটি সুদীর্ঘ সংগ্রাম। এটি ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, জনগণকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই। কেবল তরুণরাই এ ধরনের দীর্ঘ লড়াইয়ের মঞ্চ তৈরি করতে পারে। দেশে-দেশে তরুণরাই বড়-বড় দুঃসাহস দেখিয়েছে, নতুন ইতিহাস তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশেও তরুণদের মধ্য থেকেই সে লড়াই শুরু করতে হবে।
25 August 2019, Colombo