রাজনৈতিক আলাপে আমি আমার ভারতীয় বন্ধুদের দুইটা বিষয় প্রায়ই বলতাম, এখনো সুযোগ পেলেই বলি। প্রথমত: ভারত নামটা বর্তমান ভারত রাষ্ট্র ছিনতাই করেছে। এই ভারতীয় উপমহাদেশে যারা বাস করতো, তারা সবাই ভারতীয়। যেমনটা ইউরোপের দেশগুলো ইউরোপীয়। ইউরোপের কোনো দেশ তো নিজের নাম ‘ইউরোপ’ রাখেনি। তেমনিভাবে, ভারতীয় উপমহাদেশেও ভারত নামটা কেউ নেওয়া উচিত ছিলো না। ভারতীয় ভূখণ্ডে ভিন্ন-ভিন্ন রাষ্ট্র হবে। এখানে বাংলাদেশ হয়েছে, পাকিস্তান হয়েছে, হিন্দুস্তান হতে পারে। কিন্তু ঐতিহাসিক পরিচয়ে সবাই ভারতীয়। ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্যের ভাগীদার এই অঞ্চলে বসবাসকারী সকল দেশ, সকল মানুষের। প্রাচীন ভারতের যে ঐতিহ্য সেটি আমাদের পূর্ব-পূরুষদের – যারা কলকাতা, মাদ্রাজ, দিল্লি, বোম্বে ভ্রমণে, পেশাগত কাজে গিয়েছে, নিজেদের ভিন রাষ্ট্রের কেউ না ভেবে। কিন্তু বর্তমান ‘ভারত’ নামে যে ভূখণ্ড – সেখানকার রাজনীতিকরা ভারত নামটাকে ছিনতাই করেছে।
দ্বিতীয়ত: বঙ্গের ইতিহাস। বঙ্গ দেশ একটি নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ধারণা। এখানে অন্য জাতি-গোষ্ঠীর লোকজনও মিলে-মিশে ছিলো। কিন্তু রাষ্ট্র ও সীমানার নামে বঙ্গে কোনো বিভাজন ছিলো না। রাজায়-রাজায় সীমানা ভাগ-বটোয়ারা হতো, কিন্তু মানুষকে কেউ ভাগ করতে পারেনি, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, গতিবিধি, চলাফেরা কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, কিংবা কেউ চেষ্টাও করেনি। আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণাও এখানে এসেছে ইউরোপের বহু পরে। যে বঙ্গের ইতিহাস আমরা জানি, যেখানে এপার-ওপার বলে কিছু ছিলো না, তাও তো প্রায় হাজার বছর। বিভাজনটা কৃত্রিম, বিংশ শতকের শুরুর দিকে বৃটিশদের বিভাজনের রাজনীতি-সূচিত। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে যে বিভাজনটা হলো তার বয়স প্রায় ৭০ বছর হলো। আমি মানুষকে বলি হাজার বছর ধরে পথচলা একটা নৃগোষ্ঠীর এই বিভাজনটি কৃত্রিম। টিকবে না। কিভাবে কি হবে সেটি তর্কসাপেক্ষ। আমি আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলি বর্তমান ভারত রাষ্ট্র যেদিন পূর্ণ গণতন্ত্রের অধিকারি হবে, রাষ্ট্রের চেয়ে মানুষ বড় হয়ে উঠবে, যেদিন মানুষের অধিকারের দাবিগুলো বন্দুকের নলের বদলে গণভোটে নিষ্পত্তি হবে সেদিন ভারত রাষ্ট্র বলে আমরা যেটিকে চিনি, জানি সেটি বিলুপ্ত হবে। আমি আরো বলি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার সাথে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দেশ দুটো যায় না। গণতন্ত্র ও বহু জাতিগোষ্ঠীর সহাবস্থান আপাত দৃশ্যমান বাস্তবতা হিসেবে হাজির হলেও, মোটাদাগে ধারণাটা রোমান্টিক। গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইউরোপেই রাষ্ট্র বলতে আমরা যেটি দেখি সেটি বড়-বড় নৃগোষ্ঠীগুলোর এক-একটা সীমানা মাত্র। সেখানে ভিন্ন জাত-পাতের লোক থাকে, কিন্তু তারা সংখ্যায় স্বল্প, সত্যিকার অর্থেই সংখ্যালঘু। কিন্তু একাধিক বড় নৃগোষ্ঠীর সম্মিলন নিয়ে একটি বৃহৎ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর চিন্তাটা গোড়া থেকেই গলদ। রাজনীতি বিজ্ঞানে গণতন্ত্রের সূত্রমতেই এগুলো টিকবে না। কিন্তু যদি সুপারস্ট্রাকচারকে মানুষের চেয়ে বড় করে টিকিয়ে রাখা হয় সেটি হবে একটি নিপীড়নবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং অন্তর্নিহিতভাবে দুর্বল, ক্ষণস্থায়ী।
গণতন্ত্রে একটা শক্তিশালী ধারণা আছে যে গণতন্ত্রের চূড়ান্ত অবস্থায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব যেখানে নাগরিকত্বের ধারণা জাতি-গোষ্ঠীর পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠবে এবং রাষ্ট্রের নৈবর্ক্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তি করবে। কিন্তু গণতন্ত্রের তাবৎ ইতিহাসে গুটিকয়েক দেশ স্বল্প সময়ের জন্য ছাড়া সেই মানদণ্ড কখনোই উৎরাতে পারেনি। একুশ শতকে এসেও না। সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র ধারণায় বহু জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যালঘুরা স্বভাবতই কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ফরাসী রাজনীতি বিজ্ঞানী এলেক্স ডি তকভিল (Alexis de Tocqueville) ১৮৩৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘আমেরিকায় গণতন্ত্র’ (Democracy in America) নামক গ্রন্থে এই প্রবণতাকে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র’ (Tyranny of the Majority) হিসেবে অভিহিত করেছেন। দুর্ভাগ্য, প্রায় শতবছর পরও মার্কিন গণতন্ত্র সেই ফাঁদ থেকে বেরুতে পারেনি। ইউরোপ শুরু থেকেই শিক্ষাটা নিয়েছে। সেখানে দেদারসে রাষ্ট্র গঠন হয়েছে। ইউরোপে প্রায় প্রতিটি নৃগোষ্ঠী তাদের স্বাধীন সত্ত্বা পেয়েছে। বহুজাত, গোষ্ঠীজাত রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ইউনিয়ন, কনফেডারেশন এগুলো হতে পারে। কিন্তু একটি রাষ্ট্র কাঠামো যেটি মানুষের চেয়ে বড় হয়ে দাড়ায় সেটি টিকবে না। হতে পারে বৃহৎ রাষ্ট্রটি নিজেই নিজের ভারে নুইয়ে পড়বে, ভেঙে পড়বে। হতে পারে মানুষ আত্ম-অধিকারের দাবিতে আরো সোচ্চার হবে, অধিকার আদায় করে নেবে। ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক এই ভাঙা গড়া আমাদের জীবদ্দশায় হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। বিভাজনটি হয়তো আরো ৫০ বা ১০০ বছর টিকবে। কিন্তু সীমানার ভাঙা-গড়া তো আমাদের জীবদ্দশায়ই বহু দেখছি, বিভিন্ন জাতিতে-গোষ্ঠীতে। ইতিহাস বলে-কয়ে তৈরি হয় না। আমি সুদূরে বিশ্বাসী। জয় বাংলা!