জয়দেশ-এর দুই রাণী ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

(কাল্পনিক অনুগল্প – ঘটনা বা চরিত্র কাহারো সাথে মিলিয়া গেলে তাহা কেবলই কাকতাল মাত্র)


জয়দেশ-এ এক রাজার দুই-জন রাণী ছিলো। এক রাণীর নাম ‘বেগম‘ আরেক রাণীর নাম ‘শুখ‘। রাজা দুর্ঘটনাক্রমে ক্ষমতাচ্যুত হইবার পর রাণীদ্বয়ের সামনে রাজ্য শাসন করিবার দুর্লভ সুযোগ উপস্থিত হইলো। কিন্তু এক সিংহাসনের দাবীদার দুই রাণী হওয়ায় সভাসদগণ সংকটে পড়িলেন। অবশেষে তাহারা একটি উপায় হাজির করিলেন যে রাণীদ্বয় পালাক্রমে পাঁচ বছর পর-পর রাজ্য শাসন করিবেন।

প্রথম পালা ‘বেগম‘ রাণীর। তিনি প্রথম কয়েক বছর মনের সুখে রাজ্য চালাইলেন। কিন্তু ‘বেগম‘ রাণী সিংহাসনে বসিয়া যেন ক্ষমতার সাধ পাইয়া গেলেন। যতই সময় গড়াইতে লাগিলো তিনি ফন্দি আঁটিতে লাগিলেন কি করিয়া ‘শুখ‘ রাণীকে ক্ষমতা না দেওয়া যায়। ‘শুখ‘ রাণীও বেজায় চালাক। তিনি বুঝিয়া গেলেন ‘বেগম‘ রাণী তাহাকে সহজে সিংহাসন ছাড়িয়া দিবেন না। এই অচলাবস্থায় রাজ্যে সংকট দেখা দিলো। দুই রাণীর লড়াইয়ে রাজ্যের সভাসদগণ দুই ভাগ হইয়া গেলেন। সংকট যখন চরমে তখন শুখ রাণীর পক্ষীয় সভাসদগণ ‘বেগম‘ রাণীর পক্ষ ত্যাগ করিয়া বলিলেন ‘বেগম‘ রাণী সিংহাসন না ছাড়িলে তাহারা কাজ করিবেন না। সভাসদদের চাপে পড়িয়া ‘বেগম‘ রাণী খেলার নিয়ম মানিতে রাজী হইলেন এবং ‘শুখ‘ রাণীকে পাঁচ বছরের জন্য সিংহাসন ছাড়িয়া দিলেন।

‘শুখ‘ রাণীও বেগম রাণীর মতো সিংহাসনে বসিয়া প্রথম কয়েক বছর মনের সুখে শাসন করিলেন। ‘শুখ‘ রাণী যে প্রাসাদে থাকিতেন তাহা অতিশয় জাকজমকপূর্ণ। শুখ রাণী এর আগে কখনো এত বড় প্রাসাদ দেখেন নাই। বেকুব প্রজাদের স্মরণে আগের রাজা এই সুবিশাল প্রাসাদটির নাম রাখিয়াছিলেন ‘প্রজাভবন‘। এত-এত চাপরাশী, ফল-মুল, সুস্বাদু খাবার-দাবার, এত সুন্দর প্রাসাদ দেখিয়া শুখ রাণীর লোভ হইলো। তিনি সভাসদদের কাছে আবদার করিলেন প্রজাভবনটা যেন তাহাকে লিখিয়া দেওয়া হয়! শুখ রাণীর এই আবদারে সভাসদরা চমকিত হইলেন – ইহা কী করিয়া হয়! কিন্তু শুখ রাণী জেদ করিলেন প্রাসাদ তাহার চাই-ই-চাই। সভাসদগণ রাণীর জেদের কাছে নতিস্বীকার করিলেন। কিন্তু সমস্যা বাধিলো অন্য জায়গায় – শুখ রাণী ক‘ বছরের মধ্যেই তো সিংহাসন ‘বেগম‘ রাণীর নিকট ছাড়িয়া দিবার কথা, তখন ‘প্রজাভবন‘-টির কী হইবে? ইহা ছাড়া শুখ রাণী ইতোমধ্যে রাজ্যে নানা অশান্তি তৈয়ার করিয়াছেন।

‘প্রজাভবন‘-এ থাকিবার লোভে শুখ রাণী নিয়ম ভুলিয়া গেলেন। বেগম রাণীর মতো তিনিও সিংহাসন আঁকড়াই ধরিতে চাহিলেন। এই কাজে শুখরাণী সভাসদ ও রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর উপর ভরসা করিতে পারিলেন না। শুখ রাণী তাই সমগ্র রাজ্যে নিজের কিছু কুখ্যাত বাহিনী তৈয়ার করিলেন যাহারা তাকে সিংহাসনে টিকিয়া রাখিবে। এই কুখ্যাত বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিলো ‘জয়লাল‘ বাহিনী, ‘উজমান‘ বাহিনী প্রভৃতি। এসব বাহিনী রাজ্যের প্রজাদের উপর ভয়ানক অত্যাচার-নির্যাতন চালাইতে লাগিলো। শুখ রাণী সিংহাসন আঁকড়াইয়া থাকিবার লোভে এসব বাহিনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে লাগিলেন। শুখ রাণীর পাঁচ বছর ঘনাইয়া আসিতে লাগিলো। রাজ্যের সভাসদগণ শুখ রাণীর মনোভাব বুঝিতে পারিয়া কিছুটা চিন্তিত হইয়া পড়িলেন।

ওইদিকে বেগম রাণীও ফের সিংহাসনে ফিরিতে অস্থির হইয়া পড়িলেন। তাহারা বুঝিলেন শুখ রাণীর বাহিনীগুলোকে পরাস্ত না করিলে তিনি সিংহাসন ছাড়িবেন না। এবং শুখ রাণীর বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে পরাস্ত করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সভাসদগণ ও বেগম রাণী মিলিয়া তাই রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর সাথে আঁতাত করিলেন কী করা যায়। রাজ্যের সৈন্যবাহিনী সভাসদ ও বেগম রাণীকে দুশ্চিন্ত করিতে নিষেধ করিলেন। শুখ রাণী যখন এই ষড়যন্ত্র টের পাইয়াছিলেন তখন তাহার আর কিছুই করিবার ছিলো না। পাঁচ বছরের শেষ দিকে রাজ্যের সৈন্যবাহিনী শুখ রাণীর সমস্ত গুণ্ডা বাহিনীকে মারিয়া-কাটিয়া দেশান্তরী করিয়া দিলো এবং বেগম রাণীকে পুনরায় ক্ষমতায় বসাইলো।

বেগম রাণী দ্বিতীয়বার সিংহাসনে বসিয়া প্রথম দিন থেকেই ঠিক করিলেন যে দ্বিতীয়বার আর ভুল করা যাইবে না। এইবার প্রথম থেকেই শুখ রাণীকে কাবু করিয়া ফেলিতে হইবে যাহাতে চিরদিন শাসন করিতে পারি। বেগম রাণীর বড় রাজপুত্র ছিলো বেশ খতরনাক, নাম ‘তারাক‘। এতদিনে সে বেশ বড় ও হৃষ্টপুষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে। রাজপুত্র তারাক ভাবিলো তাহার মায়ের পর সেই সিংহাসনের দাবিদার, শুখ রাণীকে আর কোন সুযোগ দেওয়া যাইবে না। রাজপুত্র ভাবিলো শুখ রাণীর সব বাহিনীকে একেবারে নিঃশেষ করিয়া দিয়া নিজের বাহিনী তৈয়ার করিতে হইবে। পরিকল্পনা মাফিক রাজপুত্র তারাক প্রতীকী ‘বাতাস ভবন‘ নামীয় এক ভবন তৈয়ার করিলেন যাহার কাজ হইলো শুখ রাণী ও তার বাহিনীর প্রাণ বায়ু কাড়িয়া লওয়া এবং রাজ্যে তাহার নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। তাহার এহেন কাজে রাজ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো।

সভাসদ ও রাজ্যের সৈন্যবাহিনী ব্যাপক চিন্তায় পড়িয়া গেলেন। তাহারা যে বেগম রাণীকে সিংহাসনে আনিতে ভূমিকা রাখিলেন সেই জন্য তাহারা নিজেদের প্রতারিত ভাবিলেন। রাজপুত্র তারাক-কে তাহারা কোনোভাবেই বশে আনীতে পারিতেছেন না। রাজপুত্র না-কি ভীষণ বেয়াদপও, তাই তাহারা সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত থাকেন। রাজপুত্র শুখ রাণীর সকল বাহিনীকে কাবু করিয়া ফেলিলেন। একবার ভাবিলেন শুখ রাণীকে সরাইয়া দিলে কেমন হয় তাহলে সভাসদগণের সামনে আর কোনো বিকল্প থাকিবে না। এইরূপ ভাবিতে ভাবিতেই কাহারা যেন শুখ রাণীর উপর হামলা চালাইলো। শুখ রাণী কোনোমতে বাঁচিয়া গেলেও তাহার কিছু সাঙ্গপাঙ্গ পটল তুলিলেন। অনেকে বলাবলি করিতে লাগিলো ইহা রাজপুত্র তারাক-এর কাজ। রাজপুত্র কিছুই বলে না। প্রসঙ্গ আসিলে কেবলই মুছকি হাসে।

শুখ রাণীর জেদ চাপিলো যে রাজপুত্র ও তাহার মাতাকে শাস্তি দিতেই হইবে। শুখ রাণী সভাসদ ও রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর কাছে অনুনয়-বিনয় করিলেন যেন বেগম রাণী ও রাজপুত্রের একটা হাল করেন। তাহারা শুখ রাণীকে বলিলো যে তাহারাও রাজপুত্রের আচরণে সন্তুষ্ট নন। কিন্তু তাহারা শুখ রাণীকে বেগম রাণীর সময় শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে বলিলো।

বছর ফুরাইতে লাগিলো। শুখ রাণী কিছুতেই প্রজাভবনের স্মৃতি ভুলিতে পারেন না। বেগম রাণীর সময় শেষের অপেক্ষায় তাহার আর তর সইছে না। তিনি প্রজাভবনে তাহার কাটানো মধুর সময়গুলো রোমান্থন করিয়া স্মৃতিকাতর হইয়া পড়েন – আহা কত মধুর ছিলো প্রজাভবনের দিনগুলো! চাপরাশি-এত-এত-খাবার-দাবার-পাণীয়-ফলমুল! আহা কবে যে প্রজাভবন ফিরিয়া পাইবো!

বেগম রাণীর সিংহাসন ছাড়িবার সময় ঘনাইতে লাগিলো। কিন্তু বেগম রাণী ও রাজপুত্রের কোনো ভাবান্তর নাই। তাহাদের ভাবগতি দেখিয়া শুখ রাণী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়া পড়িলেন। সভাসদ ও সৈন্যবাহিনীর মতিগতি বুঝা দায়। শুখ রাণী নিজেকে আশ্বস্ত করিতে পারিলেন না। তিনি জানেন বেগম রাণী ও রাজপুত্র তারাক ঠিক তাহার মতোই সিংহাসন ছাড়িতে চাহিবেন না। রাজ্যের সৈন্যবাহিনী পূর্বে বেগম রাণীকে সাহায্য করায় শুখ রাণী তাহাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করিতেন না। শুখ রাণী পরিকল্পনা করিতে লাগিলেন কিভাবে বেগম রাণীকে শায়েস্তা করা যায়। তিনি রাজ্যের কিছু সভাসদকে হাত করিলেন, কিছু সৈন্যবাহিনীকেও কিনিয়া লইলেন। কিন্তু তাহাতেও তিনি পুরোপুরি আশ্বস্ত হইতে পারিলেন না।

শুখ রাণী অবশেষে পার্শ্ববর্তী ‘বরাত রাজ্য‘-এর রাজার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। বরাত রাজ্যের রাজা জয়দেশ-কে কব্জা করিবার জন্য দীর্ঘদিন চেষ্টা চালাইলেও ব্যর্থ হইয়াছেন। জয়দেশ এর রাজন্যবর্গ ও প্রজারা খতরনাক এবং বরাত রাজ্যের আধিপত্য মানিতে চাহিতেন না। বরাত রাজ্যের রাজা ভাবিলেন এই সুযোগ – একটা শুখ রাণীকে দিয়েই বরাত রাজ্যের স্বার্থ উদ্ধার করিতে হইবে। তাহাকে দিয়াই জয়দেশ-কে কাবু করিতে হইবে।

বরাত রাজ্যের রাজা শুখ রাণীকে বলিলেন রাজ্য-রাজ্য সম্পর্ক তো দেনা-পাওনার! তোমাকে আমরা সিংহাসন ও প্রজাভবন ফিরিয়া পাইতে সাহায্য করিবো। কিন্তু তাহার বিনিময়ে আমাদেরকে কি দিবে? শুখ রাণী যেকোনো মূল্যে বেগম রাণী ও রাজপুত্রকে সরাইতে চান। তিনি বরাত রাজ্যের রাজাকে বলিলেন – “জাহাপনা, আপনি মহান রাজ্যের মহান অধিপতি, আপনি যাহা কিছু চান তাহার বিনিময়ে হইলেও আমি আমি জয়দেশ এর সিংহাসন ও প্রজাভবন ফিরত চাই।“

বরাত রাজ্যের রাজা কহিলেন, “ঠিক আছে শুখ রাণী, আমরা তোমাকে সাহায্য করিবো। তুমি ক্ষমতায় আসিলে তোমার সভাসদে আমার লোক নিয়োগ করিতে হইবে। তোমার রাজ্যের সৈন্যবাহিনীতে আমার গুপ্তচর নিয়োগ করিতে হইবে। এভাবে তোমার রাজ্যের সকল জায়গায় আমার চর থাকিতে হইবে। আমি এমন ব্যবস্থা করিতে চাই যে যাহাতে তোমাকে আর কেউ সিংহাসন থেকে না সরাইতে পারে এবং জয়দেশ চিরকাল আমার কব্জায় থাকে।“

শুখ রাণী সব মানিলেন কিন্তু আমতা-আমতা করিয়া বরাত রাজ্যের রাজাকে কহিলেন, “জাহাপনা, আপনার সব যুক্তি মানিয়া লইলাম। কিন্তু আপনি জয়দেশ কব্জা করিয়া ফেলিলে প্রজারা মানিয়া লইবে কি-না তাহাতে আমি একটু চিন্তিত।“

বরাত রাজ্যের রাজা কহিলেন, “শুখ রাণী আপনি চিন্তা করিবেন না। আমরা এমনভাবে চর, অনুচর, গুপ্তচর আপনার সভাসদ, সৈন্যবাহিনী, প্রশাসন, বিচার-বিভাগ – সর্বত্র বসাইবো যে কেউ টেরই পাইবে না তাহারা আমার লোক। সবার অজান্তেই আমি জয়দেশ-কে কব্জা করিয়া লইবো। আপনি শুধু আমার পরামর্শ মোতাবেক লোক নিয়োগ দিবেন।“

শুখ রাণী ভাবিলেন যে কাজটা জয়দেশ-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হইবে, কিন্তু তাহার যে সিংহাসন ও প্রজাভবন চাই-ই-চাই! সেটা জয়দেশ কেন, সারা পৃথিবীর বিনিময়ে হইলেও! শুখ রাণী অবশেষে বরাত রাজ্যের রাজার সাথে গোপন চুক্তি করিয়া জয়দেশ-এ ফিরিলেন।

জয়দেশ-এর সৈন্যবাহিনীতে ইতোমধ্যে বরাত রাজ্যের রাজার লোকজন ছিলো। তিনি তাহাদের সাথে যোগাযোগ করিয়া বলিলেন যে একটা কাজ করিতে হইবে। তিনি তাহাদের আদেশের অপেক্ষা করিতে বলিলেন।

বেগম রাণীর সিংহাসনের মেয়াদ শেষ প্রায়। কিন্তু বেগম রাণী ও রাজপুত্র ঠিক করিলেন তাহারা কোনো মতেই সিংহাসন ছাড়িবেন না। সময় ঘনাইয়া আসিলো। সভাসদ ও রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিভক্তি দেখা দিলো। কেহ-কেহ রক্তপাতের আশংকায় সরাসরি শুখ রাণীকে সমর্থন করিতে অস্বীকার করিলেন। অপরপক্ষ সবাইকে সিংহাসনের পাঁচ বছরের নিয়ম দেখাইয়া বলিলেন বেগম রাণী যেন সিংহাসন ছাড়িয়া দেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইতেছিলো না। দৃশ্যত বেগম রাণী ও রাজপুত্রের কৌশলের জয় হইতেছিলো। তাহারা রাজপ্রাসাদ ও রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিলেন।

কিন্তু বরাত রাজ্যের রাজা তাহার পরিকল্পনা মোতাবেক অগ্রসর হইলেন। জয়দেশ-কে কব্জা করিবার এই সুবর্ণ সুযোগ তিনি কোনো মতেই হেলায় হারাইতে চান না। তিনি শুখ রাণীকে আশ্বস্ত করিলেন এবং পরিকল্পনা সাজাইতে তাহার প্রাসাদে ডাকিলেন। বরাত রাজ্যের রাজা শুখ রাণীকে কহিলেন, “একটা পরিকল্পনা তৈয়ার করিয়াছি তাহাতে আপনার সহযোগিতা লাগিবে।“

শুখ রাণী যেকোনো কিছুতে রাজী বলিয়া জানাইলেন। বরাত রাজ্যের রাজা বলিলেন, “আপনার রাজ্যের সৈন্যবাহিনীতে আমার কিছু চর আছে তাহারা আপনার পক্ষে কাজ করিবে। কিন্তু তাহারা সামনে থাকিতে পারিবে না। আপনাকে বেগম রাণীর অনুগত কিছু সৈনিক অফিসার যেভাবেই হোক হাত করিতে হইবে।“

শুখ রাণী ভাবিলেন রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর অনেকেই ইতোমধ্যে বেগম রাণী ও রাজপুত্র তারাকের উপর বেজায় ক্ষুব্ধ। এইটা কাজে লাগাইতে হইবে। কথা মতো শুখ রাণী বেগম রাণীর অনুগত কয়েক ডজন সৈনিক অফিসার যাহারা রাজপুত্রের আচরণে বিক্ষুব্ধ তাহাদের হাত করিলেন এবং তাহার তালিকা বরাত রাজ্যের রাজার হাতে হস্তগত করিলেন। পরিকল্পনা পাকা হইলো যে বরাত রাজ্যের চররা গোপনে বেগম রাণীর বিশ্বাসঘাতক সৈনিক অফিসারদের সহায়তা করিয়া বেগম রাণীকে সরাইয়া দিবে।

শুখ রাণী বরাত রাজ্যের রাজাকে কহিলো, “পরিকল্পনায় একটা সমস্যা রহিয়াছে।“

বরাত রাজ্যের রাজা জানিতে চাহিলেন, “কোথায় সমস্যা দেখিলেন?“

শুখ রাণী জবাব দিলেন, “যে সৈনিক ও অফিসারগণ আমার সিংহাসন ফিরিয়া পাইতে সহায়তা করিবে তাহাদের তো আমার শাসনে একটা অংশীদারিত্ব তৈয়ার হইয়া যাইবে। তাহারা আমার উপর চাপ বজায় রাখিবে, আমাকে আমার মতো শাসন করিতে দিবে না। আমার কাজে অসন্তুষ্ট হইলে তাহারা আমাকেও সরাইয়া দিতে পারে। জাহাপনা, আমি তো কেবল আপনার অনুগত দাস হিসেবে থাকিতে চাই, ওই বেয়াড়া অফিসারদের নয়। তাহাদের কী করিবেন?“

বরাত রাজ্যের রাজা কহিলেন, “শুখ রাণী আপনি বেশ বুদ্ধিমতি। এই বিষয়ে আপনার চিন্তা ঠিকই আছে। তবে আপনাকে জানাইতে চাই য়ে আমাদের গুপ্তচর বাহিনী আপনার আগেই এই পরিকল্পনা ঠিক করিয়া রাখিয়াছে। আপনি চিন্তা করিবেন না, আপনি সিংহাসনে আসিবার কয়েক মাসের মধ্যে ওইসব অফিসারকে খতম করিয়া দেওয়া হইবে যাহাতে আপনি নিশ্চিন্তে শাসন করিতে পারেন।“

শুখ রাণী বলিলেন, “তা বেশ পরিকল্পনা জাহাপনা। কিন্তু কাজটা করিবেন কিভাবে? কারণ অফিসারগণ তো রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছড়াইয়া-ছিটাইয়া কর্মে নিয়োজিত থাকিবে! সারা রাজ্যে খুন-খারাবি করা কি ঠিক হইবে?‘

বরাত রাজ্যের রাজা খানিকটা বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আমরা সারা রাজ্যে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া তাহাদের মারিবো কেন? তাহাদের এক জায়গায় জড় করাইয়া মারিবো! আপনি শুধু আমার কথামতো তাহাদের বদলি করিয়া একটা জায়গায় আনিবেন। অবশ্য আপনাকে সিংহাসনে বসাইবার পূর্বেই এই বদলির কিছু কাজ আমরা গুছাইয়া রাখিবো। বাকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আমাদের গুপ্তচর বাহিনী করিবে।“

শুখ রাণী আশ্বস্ত হইলেন। সব পরিকল্পনা পাক্কা।

যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ। এক গভীর রাত্তিরে বিশ্বাসঘাতক সৈনিক অফিসারগণ বেগম রাণীর প্রাসাদ ঘিরিয়া ফেলিলেন এবং তাহাকে সিংহাসন ত্যাগ করিতে বলিলেন। উপয়ান্ত না দেখিয়া বেগম রাণী সিংহাসন ত্যাগ করিলেন। রাজপুত্রকে সৈনিক অফিসার গ্রেফতার করিলেন।

সৈনিকগণ সভাসদ ও শুখ রাণীকে বলিলেন, “আপনাকে সরাসরি সিংহাসনে বসাইলে প্রজাগণ মন্দ বলিবে। একটু ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া বসাইতে চাই।“

শুখ রাণী কিছুটা চিন্তিত হইলেন সৈনিকদের আচরণে। তিনি তৎক্ষণাৎ বরাত রাজ্যের রাজার সাথে যোগাযোগ করিলেন যে সব কিছু ঠিক-ঠাক আছে কি-না। বরাত রাজ্যের রাজা শুখ রাণীকে আশ্বস্ত করিয়া কহিলেন, “রাণী আপনি চিন্তা করিবেন না। সবকিছুই ঠিক আছে। পরিকল্পনা একটু পরিবর্তন করিলাম আর কী।“

শুনিয়া শুখ রাণী আশ্বস্ত হইলেন। বরাত রাজ্যের রাজা তাহার অনুচর ও গুপ্তচরদের নির্দেশ দিলেন, বিশ্বাসঘাতক সৈনিকরা যাতে দুই বছরে শুখ রাণীকে সিংহাসনে না বসায়। কারণ বরাত রাজ্যের সামনে এক মহা সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে। এই সুযোগ কাজে লাগাইতে হইবে। শুখ রাণীকে সিংহাসনে বসাইয়া অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করিবো, কিন্তু এসব বিশ্বাসঘাতক সৈনিকদের দিয়া জয়দেশ-এ বরাত রাজ্যের যত শত্রু আছে তাহার কিছু নিধন করিতে পারিলে মন্দ হয় না। কিছু শত্রু নিধন শুখ রাণীর জন্য রাখিয়া বাকী সব শত্রুকে নিধন করিতে হইবে।

জয়দেশ রাজ্যের বিশ্বাসঘাতক সৈনিকগণ আসল ঘটনা বুঝিলেন না। তাহারা দুই বছর রাজ্য চালাইবার সুযোগ পাইয়াই খুশীতে আটখানা। রাজ্যের বিশ্বাসঘাতক সৈনিকগণ ক্ষমতা পাইয়া প্রজাদের উপর নানা নিপীড়ণ শুরু করিলেন। প্রজাদের জায়গা-জমি দখল, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে টাকা-পয়সা লুণ্ঠন সকল অপকর্মে জড়াইয়া পড়িলেন।

বরাত রাজ্যের রাজা তো মহাখুশী। তিনি তাহার গুপ্তচরদের নির্দেশ দিলেন জয়দেশ-এর প্রজাদের নিকট জয়দেশের সৈন্যবাহিনীর সর্বপ্রকার দুর্নাম রটাইতে যাহাতে প্রজাগণ সৈনিকদের ঘৃণা করে। ইহার ফলে বরাত রাজ্যের সুবিধা হইবে।

দুই বছর বরাত রাজ্যের রাজা এক ঢিলে দুই পাখি মারিলেন: প্রথমত, তিনি বরাত রাজ্যের শত্রু নিধন করিলেন অথবা নিধনের ব্যবস্থা করিয়া গেলেন; দ্বিতীয়ত জয়দেশের প্রজাগণের নিকট সৈন্যবাহিনীর দুর্নাম প্রতিষ্ঠা করিয়া পরস্পরের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি করিলেন।

দুই বছর অতিবাহিত হইবার পর, বরাত রাজ্যের রাজা তাহার গুপ্তচর ও জয়দেশের বিশ্বাসঘাতক সৈনিকদের নির্দেশ দিলেন শুখ রাণীর হাতে সিংহাসন বুঝাইয়া দিবার জন্য। কথা মতো কাজ, শুখ রাণী ব্যাপক ঢামাডোল পিটাইয়া সিংহাসনে পুনরায় আরোহণ করিলেন। এবং সিংহাসনে বসিয়াই প্রথম কাজ হিসেবে প্রজাভবন তাহার নামে লিখিয়া লইলেন! সভাসদদের বুঝাইয়া দিলেন যে এইবার তিনি সহসা সিংহাসন ত্যাগ করিতেছেন না।

সিংহাসনে বসিয়া শুখ রাণী বরাত রাজ্যের রাজার পরিকল্পনা মোতাবেক প্রথমেই আপদ বিদেয় করিতে নামিলেন। সকল বিশ্বাসঘাতক সৈনিককে তিনি এক স্থানে জড়ো করিলেন তিনি ভাষণ দিবেন বলিয়া। কিন্তু এক অজুহাতে তিনি ভাষণ দিতে গেলেন না। অতঃপর পরিকল্পনা মতো বরাত রাজ্যের গুপ্তচরগণ জয়দেশের দেশীয় অনুচরদের সহযোগিতায় জয়দেশের সৈনিক অফিসারদের উপর ঝাপাইয়া পড়িলেন। কাউকে চোখ উপড়াইয়া খুন করিলেন। কাউকে অঙ্গহানি করিয়া নালার পানিতে ভাসাইয়া দিলেন। কাউকে মাটির নিতে পুতিয়া ফেলিলেন। কাহারও স্ত্রী-কণ্যাকে ধর্ষণ করিলেন।

জয়দেশ-এর সৈন্যবাহিনী কিছু বুঝিয়া উঠিবার পূর্বেই কাজটি সম্পন্ন হইলো। কিছু সৈন্য হাপিত্যেশ করিলেও তাহাদের কিছুই করিবার ছিলো না।

শুখ রাণীর এখন আর ভয় নাই। তাহাকে যেসব বিশ্বাসঘাতক সৈনিক সিংহাসনে বসাইয়াতে কাজ করিয়াছে তাহাদের তিনি খতম করিয়া পুরস্কৃত করিয়াছেন। তাহার শাসনের প্রথম চ্যালেঞ্জ, প্রথম শত্রু তিনি নিধন করিলেন। বাকী রহিয়াছে বরাত রাজ্যের রাজার শত্রুগণ। তিনি ঋণ শোধ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাছাড়া বরাত রাজ্যের গুপ্তচরগণ এখন সারা রাজ্যে – সভাসদ, উজির, কাজী – সর্বক্ষেত্রে। বরাত রাজার কথা না শুনিলে টিকিয়া থাকা মুশকিল হইবে। অত:পর শুখ রাণী বরাত রাজ্যের সকল শত্রু এক-এক করে নিধনে নামিলেন। জয়দেশ রাজ্যের সভাসদ, সৈন্যবাহিনী – সবই এখন বরাত রাজ্যের কব্জায়। কেউ এখন আর দুই রাণীর পালা করিয়া শাসন করিবার নিয়ম বলে না। বেগম রাণীর কথা সভাসদ, সৈনিকদের কেউ এখন আর ভুল করিয়াও উচ্চারণ করে না।

শুখ রাণী সিংহাসনে পুনরায় অধিষ্ঠিত হইবার প্রায় এক যুগ হইতে চলিলো। জয়দেশের বরাত-রাজ্য-বিরোধী প্রজারা অনেক কিছু মানিয়া লইতে না পারিলেও, বরাত রাজ্যের গুপ্তচর ও শক্তিময় শুখ রাণীর বিভিন্ন বাহিনীর কাছে তারা নিরুপায়। ইতোমধ্যে বরাত রাজ্যের বেশিরভাগ শত্রু খতম হইয়াছে। শুখ রাণী জয়দেশ-এ তাহার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। বেগম রাণী ও তাহার পুত্রকে নির্বাসনে। শুখ রাণী এক প্রকার বিনা বাধায় জয়দেশ শাসন করিতে লাগিলেন।

কিন্তু বরাত রাজ্যের রাজা ভাবিতেছেন অন্য কিছু। তিনি এতদিন পর জয়দেশ কব্জা করিয়াছেন যে তাহা আর হাতছাড়া করিবার ঝুঁকি নিতে চান না। যদিও শুখ রাণী তাহার অনুগত দাস হইয়া জয়দেশ-এ তাহার পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করিতেছেন, বরাত রাজ্যের রাজা জানেন এক ঝুড়িতে সকল ডিম রাখিতে নাই। তাহার বিকল্প পরিকল্পনা রহিয়াছে যাহা শুখ রাণী অবগত নন। তাছাড়া জয়দেশ রাজ্যে শুখ রাণী কতদিন নিয়ন্ত্রণে রাখীতে পারিবেন তাহা নিয়া বরাত রাজ্যের রাজার দুশ্চিন্তা রহিয়াছে।

ইতোমধ্যে জয়দেশ-এ অস্থিরতার খবর আসিতেছে। প্রজারা ধীরে-ধীরে বুঝিতে পারিতেছে যে বরাত রাজ্য তাহাদের কব্জা করিয়া ফেলিতেছে। বরাত রাজ্যের রাজা, সভাসদ, গুপ্তচররাও ইতোমধ্যে বিকল্প পরিকল্পনা তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছে। শুখ রাণী রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হারাইলে অথবা রাজ্যে অস্থিরতা তৈয়ার হইলে পরিস্থিতি সামাল দিতে বরাত রাজ্যের গুপ্তচররা জয়দেশের সৈনিকদের মাঝে ইতোমধ্যে আরেকদল বিশ্বাসঘাতক তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছেন। প্রজাদের অসন্তোষ বাড়িয়া গেলে তাহারা শুখ রাণীকেও সরাইয়া দিয়া ছদ্ম একটি শাসন প্রতিষ্ঠা করিবে যেখানে বরাত রাজ্যের গুপ্তচররা পেছন থেকে সব কলকাঠি নাড়িবে। শুখ রাণী বেশি অজনপ্রিয় হইয়া উঠিলে বরাত রাজ্যের গুপ্তচররা নিজেরাও কিছু অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম ঘটাইয়া পরিস্থিতি ঘোলাটে করিয়া তাহাদের অনুগত সৈনিকদের সিংহসানের নিয়ন্ত্রণভার নিতে বলিবেন। বরাত রাজ্যের রাজা সেমতে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা জয়দেশ-এ তাহাদের গুপ্তচরদের নিকট হস্তগত করিয়াছেন।

শুখ রাণী অনেক বুদ্ধিমতি হইলেও বরাত রাজ্যের এসব পরিকল্পনা সম্পর্কে তাহার সম্যক ধারণা কতটুকু রহিয়াছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অথবা ধারণা থাকিলেও তাহার করিবার বিশেষ কিছুও নাই। বরাত রাজ্যকে বিশ্বাসঘাতক ভাবিবে বিধায় বরাত রাজ্যের রাজা শুখ রাণীকে এত কিছু জানিতে দেন না। আর বরাত রাজ্যের রাজা জানেন যে শুখ রাণী তার সাময়িক সেবাদাস মাত্র, তাহার এত জানিয়া কাজ কী! অতএব শুখ রাণী কিছুটা সত্য, কিছুটা মিথ্য জানিয়া, বরাত রাজ্যের পাতা ফাঁদে পা দিয়া মনের সুখে আরও কিছু কালের জন্য জয়দেশ শাসন করিতেছেন…

০৭ এপ্রিল ২০১৯

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান