আগুন, উপজেলা নির্বাচন, ও চৈনিক স্টাইলের শাসনব্যবস্থা

১। ঢাকার আগুন লইয়া কিছু ভাবনা। ঢাকায় বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুনের পর গত দুই দিনে যে হারে আগুন সবদিকে ছড়াইয়াছে তাহার তিনটি ব্যাখ্যা থাকিতে পারে। (ক) এগুলো সত্যি-সত্যিই দুর্ঘটনা। (খ) চৈনিক সামরিক কৌশলবিদ সান জু শত্রুকে বধ করিবার অনেক উপদেশ দিয়াছেন, তাহার মধ্যে একটি হইলো শত্রুকে সরাসরি মোকাবিলা না করিবার গেলে কৌশলে তাহার মনোযোগ অন্যদিকে সরাইতে হইবে (through diversionary attacks), তারপর তাহার উপর ঝাপাইয়া পড়িতে হইবে। এসব দুর্ঘটনা শত্রু বধের চেষ্টা কিনা তাহা শত্রু বধ হইলেই বুঝা যাইবে। (গ) একটা বেনামি প্রবাদ আছে (অনেকে বলে স্ট্যালিন বলিয়াছেন) যে, একজন মানুষের মৃত্যু বিয়োগান্ত ঘটনা, কিন্তু লক্ষ মানুষের মৃত্যু কেবল পরিসংখ্যান। এটি ব্যক্তি থেকে ঘটনায় রূপান্তর করা যায়। বাংলাদেশে ইদানিং একটা নতুন ট্রেন্ড পরিলক্ষিত হয়, এটা পরিকল্পিত কি-না পাঠক বিচার করিবেন। যখন একটি শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ ঘটনা সংবাদে আসিলো, রাতারাতি সারা বাংলাদেশের বহু শিশু নির্যাতনের খবর আসিতে থাকিলো। ইভটিজিং-এর একটা প্রতিবেদনের পর শতশত ইভটিজিংয়ের খবর আসিতে থাকিলো। একটা আগুনের পর বহু আগুনের সংবাদ আসিতে শুরু করিলো। এখন এইটা যদি সাংবাদিকদের বোধোদয়ের কারণে হইতো তাহা হইলে এক কথা, কিন্তু এইসব সংবাদ কয়েকদিন পর হারাইয়া যায়। এমন নয় যে ওইসব ঘটনা আর ঘটে না, কিন্তু ঘটনা আড়াল করিবার প্রয়োজন ফুরাইয়া যাইবার কারণে সেগুলো আর সংবাদের পাতায় আসে না। সুতরাং এটা স্পষ্টত যে কিছু লোক বহু সংবাদের পরিসংখ্যানের ভিড়ে একটি ‘বিয়োগান্ত‘ সংবাদকে হারিয়ে যেতে দিতে চায়। সেই জন্য তাহারা নতুন ঘটনা তৈয়ারি করেন কি-না জানি না, কিন্তু তাহারা যে সংবাদ তৈয়ার করেন তাহা নিশ্চিত বটে। ঢাকার আগুন নিয়ে কোনটি সত্য তাহা পাঠকের বিবেচনার জন্য রাখিলাম।

২। গত দুই সপ্তাহ ধরিয়া বাতাসে কিছু কথা ভাসিতেছে যে ক্ষমতাসীনরা তাহাদের পায়ের তলার মাটির অনুপস্থিতি বুঝিতে পারিয়া এবং সম্ভাব্য অশনিসংকেত বিবেচনায় লইয়া বিএনপি‘র সহিত কিছু একটা সমঝোতা করিতে চায়। তাহারা না-কি বিএনপি-কে প্রস্তাব দিয়াছে যে খালেদা জিয়াকে মুক্তির বিনিময়ে বিএনপির ‘পাশ করাইয়া দেওয়া‘ সংসদ সদস্যগণ যাহাতে সংসদে গিয়া এই অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেয়। বিএনপির ওই সাংসদদের হুমকি, টাকা-পয়সার লোভ সবই দেখানো হইতেছে। অনেক বিএনপি সাংসদ না-কি তাহাতে রাজীও হইতে পারে। কিন্তু মুশকিল হইলো বেগম খালেদা জিয়া। তিনি সম্ভবত তাঁর ‘আপোষহীন‘ চরিত্রের পরীক্ষা দিবেন বলিয়া বিগড়াইয়া আছেন। এবং সেভাবেই থাকিবেন। আমি মনে করি বেগম জিয়ার হাতেই এখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির সমাধান। তিনি বাকশালকে বৈধতা দিবেন না-কি গণতন্ত্রের এই কঠিন পরীক্ষায় নিজেকে সমর্পণ করিয়া হইলেও শাসকদের রাতের ঘুম হারাম করিবেন – তাহার উত্তর বেগম জিয়ার কাছে। বেগম জিয়ার বিগত শাসনামলকে আমি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উল্টোযাত্রার শুরু হিসেবে আখ্যায়িত করিলেও এই মুহূর্তে বেগম জিয়া যদি অবৈধ শাসকদের হুমকি-ধামকি, লোভ সামলাইয়া তাহাদের পাতা ফাঁদে পা দিতে অস্বীকার করেন তাহা হইলে তাঁহাকে ভিন্নভাবে বিবেচনা করিবো, স্যালুট জানাইবো। এই স্বৈরাচার ডুবন্ত। ইহা ঐতিহাসিক পরিহাস যে বাংলার জনগণ নিরবে, অহিংস আন্দোলনের মতো ভোট বর্জন করিয়া এই শাসকদের সমস্ত লেজিটিমেসি ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। তাহারা এখন কেবল ততদিন শাসন করিবে যতদিন পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনি তাহাদের পিছনে থাকিবে। মুশকিল হইতেছে বাহিনীগুলোর মতিগতি বোঝা সবসময়ই দায়। বাংলাদেশে ১৯৭৩ পরবর্তী সকল অবৈধ শাসকগণ ক্ষমতার চূড়ায় থাকিয়া চরম পতন দেখিয়াছে। যাহারা ভাবিতেছেন দাদারা হেলিকপ্টার পাঠাইয়া রক্ষা করিবে, তাহাদেরকে সাম্প্রতিক মালদ্বীপ, শ্রীলংকা ও নেপালের ইতিহাস পাঠ করিবার অনুরোধ করিবো। দাদারা ওই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোও রক্ষা করিতে পারে নাই। বাংলাদেশ তো বহুত খতরনাক রাষ্ট্র – সেটার ইতিহাস আছে।

৩। সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশের দ্বৈত ভূমিকা এবং জনগণের কঠিন জবাব:

যদি বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের কু-উপদেষ্টারা বাংলাদেশে চীনা স্টাইলের শাসনতন্ত্র (যেখানে রাষ্ট্র কমিউনিস্ট পার্টির, স্থানীয় নির্বাচন জনগণের) কায়েম করিবার কুবুদ্ধি শাসকদের দিয়া থাকেন – অর্থাৎ জোর-জবরদস্তি করিয়া রাতের-আঁধারে ডাকাতি করিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা নিলেও স্থানীয় নির্বাচনে ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ‘ মোতাবেক তাঁহার একান্ত ব্যক্তিগত আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসন তথাকথিত সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করিলেই জনগণ নাচিতে-নাচিতে ভোটকেন্দ্রে হাজির হইবে, তাহারা উপজেলা নির্বাচনে ইতোমধ্যেই টের পাইতেছেন যে বাংলাদেশ চীন রাষ্ট্র নয়। এইখানে আপনাদের বাপ-দাদারা বাকশাল করিতে গিয়াও পারেন নাই, সুতরাং আপনাদের এই নয়া চিন্তাও ব্যর্থ হইবে। বঙ্গদেশের রাষ্ট্রচিন্তার বয়স হাজার বছর না হইতে পারে, কিন্তু এখানকার নাঙ্গা-ভুখা মানুষজন দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করিবার দেশী-বিদেশী সকল ঐতিহাসিক অপচেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে। ইতিহাস না জানিলে ইতিহাস পড়িয়া লন। প্রস্তুত থাকুন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান