‘জয়দেশ’-এ আইনের শাসন

(একটি কল্পিত অনুগল্প। কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে মিলিয়া গেলে তাহা কেবলই কাকতাল মাত্র)

একদা ‘জয়দেশ‘ নামে সুজলা-সুফলা-মীরজাফর-মনসুর-এ ভরা এক দেশ ছিলো। আশেপাশের রাজ্যের লোকে কয় জয়দেশের রাণী না-কি ভীষণ চালাক, ভীষণ চতুর। তিনি না-কি জয়দেশে যাহা চান তাহাই ঘটে। যদিও দুষ্টু লোকেরা মিথ্যা-মিথ্যি দাবী করে প্রজারা না-কি রাণী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দু:শাসনে ভেতরে-ভেতরে ভীষণ ক্ষুব্ধ। কিন্তু রাণীর ‘লগিবৈঠা-বাহিনী‘, ‘হেলমেট-বাহিনী‘, ‘বন্দুকবাহিনী‘, ‘ক্রসফায়ার-বাহিনী‘ নামীয় ভয়ানক-সব বাহিনীর কাছে দুষ্টু প্রজারা কাবু প্রায়।


তো একবার ‘জয়দেশের‘ রাণীর মতিভ্রম হইলো। তিনি কি ভাবিয়া মত ঠিক করিলেন দুষ্টু প্রজাদের কিছুটা ‘আইনের শাসন‘ দেওয়া যাক। তিনি সভাসদদের ডাকিয়া বলিলেন, ‘আইনের শাসন‘ বস্তুটি কি জিনিস, শোনাও তো।“

নওহর রাজভী নামের এক বিখ্যাত রাজ পণ্ডিত দুরু-দুরু কণ্ঠে বলিলেন, ‘রাণীমশাই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তো আইনের শাসন বলিতে তো অনেক কিছুই আছে, তবে মোটাদাগে পাঁচটি মানদণ্ড মানিয়া চলিলে তাহা যথার্থ আইনের শাসন হইবে।“

রাণী তো বেজায় খুশী। “মাত্র পাঁচটি মানদণ্ড?“ রাণী নওহার রাজভী পণ্ডিতকে জিজ্ঞাসা করিলেন।
“আজ্ঞে হ্যাঁ, মাত্র পাঁচটি“। রাণী বলিলেন, “এটাতো কোনো ব্যাপারই না, পণ্ডিত মশাই, বলিয়া ফেলুন“। নাওহর পণ্ডিত বলিতে শুরু করিলেন:

“১। আইনের চোখে সবাই সমান। (অর্থাৎ ধনী-গরিব, সরকার-বিরোধী দল, নারী-পুরুষ, ধর্মীয়-অধর্মীয়, জাত-বেজাত – আইনের চোখে সবাই সমান। কেহ তাহার রাজনৈতিক, আর্থিক, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বিশেষ কোনো সুবিধা পাইবেন না।)

২। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করিবে (অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপের কাছে তাহারা নতি স্বীকার করিবে না)।

৩। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দায়িত্বপালনে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিবে (অর্থাৎ নিজেদের আচরণের নির্ধারিত মানদণ্ড মানিয়া চলিবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে দেশের মালিক জনগণের সহিত যেভাবে আচরণ করিতে হয় তাহা মানিয়া দায়িত্বপালন করিবে; কাউকে ধরিয়া আনিতে বলিলে বাঁধিয়া আনিবে না; গ্রেফতার করিতে বলিলে কোমরে দড়ি পরাইবে না; অভিযুক্তকে মর্যাদার সহিত গ্রেফতার করিবে, ক্রসফায়ারে দিবে না প্রভৃতি)।

৪। নির্বাহী বিভাগ বা সরকার আইনের আওতায় কাজ করিবে (অর্থাৎ রাজ্যের সভাসদ, নেতা, লোকজন অপকর্ম করিতে চাহিলেও আইন প্রয়োগকারীদের বাধার সম্মুখীন হইবে; রাস্তায় উল্টো পথে চলিতে গেলে পুলিশ থামাইবে; রাজ্যের উজির-নাজির, মন্ত্রী-এমপিরা চুরি করিলে দুর্নীতি দমন কমিশন ধরিবে; যেকেউ রাণী, রাজপুত্র-রাজকণ্যা, ডিসি, এসপিকে আইন ভাঙার (for both commission or omission) দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইতে পারিবে)।

৫। আইন সবসময় অনুমিত থাকিবে (অর্থাৎ জনগণ জানিবে কি অপরাধের জন্য কোন আইন প্রযোজ্য এবং সেই অনুযায়ী তাহারা ব্যবসা-বাণিজ্যের শর্ত ও নিজেদের আচরণবিধি নির্ধারণ করিবে; রাজার লোকজন কিছু অসৎ লোককে সরকারি সুবিধা পাইয়ে দিতে (কর বা শুল্ক ছাড় পাইবার জন্য) রাতারাতি কোনো এসআরও (statutory regulatory order – SRO) ইস্যু করিবে না; আগামী কল্যের আইনে গতদিনের অপরাধের বিচার হইবে না (retrospective effect))।

‘জয়দেশ‘-এর রাণী নওহর পণ্ডিতের উপর ভয়ানক ক্ষীপ্ত হইলেন। “কিসব আলতু-ফালতু কথা বলিতেছেন, পণ্ডিত মশাই!“ “এতসব মানিলে আমি ‘শাসন‘ করিবো কিভাবে? এই জন্য আপনাকে কাড়ি-কাড়ি টাকা দিয়া উপদেষ্টা বানাইয়াছি, যে আমার গদি লইয়া টান দিবেন?“

নওহর পণ্ডিত বলিলেন, “ভুল হইয়া গিয়াছে রাণী মহাশয়, আসলে আইনের শাসন বলিয়া ছিলেন তো, সেজন্য ভাবিয়াছিলাম আইন শাসন করিবে, কিন্তু আপনিই যে রাষ্ট্র, আপনিই যে আইন তাহা ভুলিয়া গিয়াছিলাম।“

নওহার পণ্ডিত বলিতে থাকেন, “রাণী মহাশয়, চিন্তা করিবেন না। আপনি যেভাবে বলিবেন সেই মতো আইনের শাসনের তত্ত্ব সাজাইয়া দিবো। আপনি তো জানেন, গার্ভার্ড স্কুলে কতশত গুরু-ছাগলকে নতুন আইন শিখাইয়াছি!“ “আপনার গুণমুগ্ধ সন্তানও তো আমার ভেড়ার পালের অংশ।“

রাণী বললেন, “তা জানি, তা জানি। এইজন্যই তো আপনার মতো পণ্ডিতকে কাড়ি-কাড়ি টাকা দিয়া রাখিয়াছি। যেন আমার ‘ধর্শন‘-কে ছড়াইয়া দিতে পারেন। এখন আমার মতো একটা আইনের শাসন তত্ত্ব দাড় করাইবেন।“

নওহার পণ্ডি বলেন, “জো আজ্ঞা রাণী মহাশয়। আপনি বলুন।“

রাণী বলিলেন, “ধরুন আপনার ১ নম্বর শর্তের কথা। আমার রাজ্যে এসব সমান অধিকার আপনি কোথা পাইবেন? এখানে আমি যাহা বলি তাহাই আইন। দ্যাখেন না, আমার সভাসদরা কি করে সব আদেশের জন্য আমার পান্থপানে চাহিয়া থাকে?!“ “এছাড়া, আমি তো ‘খওমী-জননী‘ – আমি কিভাবে, কোথা হতে সমানদৃষ্টি পাইবো?“

পণ্ডিত বলিলেন, “ভারী সমস্যা।“ রাণী আরও বলিতে থাকিলেন, “আমার রাজ্যে আপনি বিরোধী দল পাইলেন কোথায়, আর তাহাদের বলিতে কি বুঝায় বুঝিলাম না!! আমার রাজ্যে আমি যাহাকে সরকার বলি সেই সরকার, যাহাকে বিরোধী দল বলি, সেই বিরোধী দল – দ্যাখেন না হুরশাদ, হিনু-দের আমি যে গোয়ালে রাখি তাহারা সেই গোয়ালে যায়? এখন আপনি আপনার তত্ত্ব ঠিক করিবেন, কিভাবে এটাকে আইনের শাসনে সাজাইবেন।“

নওহর পণ্ডিত গার্ভাডে তত্ত্ব টুইস্ট করায় ভারী ওস্তাদ তথাপি এই দুষ্টু রাণীর তত্ত্ব ঠিক করায় ভারী দুশ্চিন্তায় পড়িয়া গেলেন। তিনি বলিলেন, “মহামাণ্য রাণী, আমাকে কিছু সময় দেন। কিন্তু বাকী শর্তগুলোর কি হইবে?“

রাণী বলিলেন, “আপনার ২ নম্বর শর্তটাও খতরনাক! আমার রাজ্যে আমি যাহা বলি তাহার বাইরে কি কেউ যেতে পারে? দ্যাখেন না, আমি প্রধান বিচারপতির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কিভাবে টাকা ঢুকাইয়া দিয়া তাহাকে ফাঁসাইয়া দিয়েছি? দেখেন না আমি মাঈদুল না কোন এক ফটুগ্রাফারকে আমার বিরুদ্ধে বলিবার অপরাধে ১০০ দিন জেলের ভাত খাইয়েছি, ধরে ইচ্ছামতো মাইর দিয়েছি? দ্যাখেন না, আমি ‘বন্দুকবাহিনী‘-কে বলিয়াছিলাম – ‘কিসের প্রজা, কিসের ভোট, রাতের বেলায় মার ব্যালট‘ – তাহারা কিভাবে আমার কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করিয়াছে?! আপনি এইসব দেখিয়াও বলিতেছেন তাহারা কাহারও কথা যেন না শুনে?! আপনার সাহস তো কম না?“

নওহর পণ্ডিত চিন্তায় পড়িয়া গেলেন, ভাবিলেন, গার্ভাডের চাকুরিতেও ইহুদিদের দালালী করিতে হইয়াছে, কিন্তু এই মহিলা তো আরও খতরনাক! তারপর সম্বিত ফিরিয়া পাইয়া বলিলেন, “জাহাপনা, আমার ভুল হইয়া গিয়াছে, আমি এই শর্তটাও ঠিক করিয়া নিবো“ “বাকী শর্তগুলো তো ঠিক আছে?“ – নওহর পণ্ডিত আমতা-আমতা করিয়া জানিতে চাহিলেন।

রাণী গম্ভীর হইয়া বলিলেন, ৩ নম্বর শর্তটা একটু বদলে দিয়া বলিতে হইবে “রাণীই সার্বভৌম, রাণীই রাষ্ট্র! তিনি যাহা বলিবেন, যেভাবে বলিবেন – সেটিই আইনপ্রয়োগকারীদের আচরণ বিধি“ “তিনি যাহাকে যেভাবে ধরিয়া আনিতে বলিবেন, তাহারা সেমতে কাজ করিবেন। বদ-দের আদর করিয়া আনিবেন, জেলের হাসপাতালে পোলাও-কোর্মা খাওয়াইবেন, আর ওই দুষ্টু মাঈদুল ফটুগ্রাফারের মতো নাখান্দা-নালায়েকদের ধরিয়াই কিল-ঘুষি দিবেন, রক্ত বাহির করিতে না পারিলে চাকুরি থাকবে না। আর ওই যে ওলিয়াশ-আলীর মতো বজ্জাত কেউ ঘাড় ত্যাড়ামি করিলে গায়েব করিয়া দিবেন।“ “শুনেন, এখানে আমিই রাষ্ট্র, আমার কথাই আইন – বুঝেছেন? সেভাবে শর্তটি ঠিক করেন।“ নওহর পণ্ডিত কাচুমাচু করে বলিলেন, “জো হুকুম, রাণী“

রাণী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া কি যেন ভাবিতেছেন। নওহর পণ্ডিত ভাবিলেন বাকী শর্তগুলো মনে হয় ঠিক আছে। তারপরও নিশ্চিত হইতে তিনি রাণী মহোদয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন: “৪ ও ৫ নম্বর শর্ত নিয়া আপনার কোনো আপত্তি নেই তো, মহামান্য রাণী?“

রাণী চমকিত হইলেন, হঠাৎ সম্বিত ফিরিয়া পাইয়া উচ্চকণ্ঠে নওহার পণ্ডিতকে ধমক দিয়া বলিলেন, “খামোশ পণ্ডিত। তোমার তো আক্কেলই নাই। তোমারে চাকুরি দিয়া ভুলই করিয়াছি মনে হচ্ছে। ১, ২, ৩ নম্বর শর্তের সংশোধন দেখিয়া তুমি বুঝিতে পারো নাই যে ৪ ও ৫ নম্বর শর্তের অস্ত্বিতই নাই?“ “আমার রাজ্যে আমার মন্ত্রী, সভাসদ, রাজপুত্র ও রাজকন্যারা যাহা চাইবে সবই তাহাদের। সকল ব্যাংকের ভল্ট তাহাদের জন্য উন্মুক্ত। রাষ্ট্রের সকল কোষাগার তাহাদের জন্য উন্মুক্ত। তবে হ্যাঁ, এসব সম্পদ এমনি-এমনি নিলে তাহারা অলস হইয়া যাইতে পারে। সেজন্য তাহাদেরকে ক্রাশিয়া দেশের সাথে বড় অস্ত্র চুক্তি করিতে হইবে, আকাশে ওই যে পাতিলের ডাকনার মতো কি একটা ওড়ায় ওইগুলো উড়াইয়া তারপর কয়েক মিলিয়ন ডলার কমিশন খাইতে হবে। নকল সংকট তৈরি করিয়া প্রজাদের মাথার উপর কাঠাল ভাঙার অপকৌশল রপ্ত করিতে হইবে। এমনি এমনি খাইতে দিবো না, অপকর্ম করিয়া খাইতে হইবে।“ “কি বলো পণ্ডিত, কিছুটা অপকর্ম করিয়া টাকা লুট করিলে তো আইনের শাসনের ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না, দিনশেষে কর্ম তো, তাই-না?“

নওহর পণ্ডিত মাথা নাড়িয়া বলেন, “জ্বি রাণী মহাশয়“ “আপনার অনেক দয়া। আপনার ‘জয়দেশ‘ রাজ্যের এই আইনের শাসন দুনিয়ার বুকে সেরা। আর কোথাও মিলিবেে না এই স্বপ্নের রাজ্যের দেখা। আপনারা প্রজারা দেখেন না কবরের মতো শান্ত, তাহারা আপনার আইনের শাসনে বেজায় খুশি, বিমুগ্ধ। আমি পরের বার গার্ভাডে পড়াইতে গেলে শিক্ষার্থীদের আপনার ‘রাণী স্কলারশীপ‘-এর আওতায় আপনাকে নিয়া থিসিস করিতে বলিবো। “

রাণী স্মিতহাস্যে বলিলেন, এই না হয় আমার পণ্ডিত। তিনি উজিরকে ডেকে কানে-কানে বলিলেন, “আগামী বছরের ‘বাঈশে পদক‘ তালিকায় আমি নওহর রাজভী পণ্ডিতের নাম চাই।“ উজির বলিলেন, “যথা আজ্ঞা রাণী মহাশয়।“ রাণী ইঙ্গিতে উজিরকে কি যেন বলিলেন। উজির প্রহরীকে ইশারা দিলেন। হঠাৎ বাইরে স্লোগান: ‘জয়দেশ‘ ‘জয় রাণী‘, ‘রাণী মহাশয় চিরজীবি হোক‘!

রাণী ‘নকল‘ প্রজা সমাবেশে উপস্থিত হইয়া নকল হাসি হাসিয়া বলিলেন, “আমি তো কোনো স্বীকৃতি-ফিকৃতি চাই নাই, আমার কিছুই দরকার নাই (শুধু ‘ঘনভবন‘ ছাড়া)। আমি সবকিছু প্রজাদের উজাড় করিয়া দিয়াছি। আমি তো সম্প্রদান কারক। বালক প্রজারা, তোমরাই আমার সব।“

রাণী অত:পর উজিরকে ডাকিয়া বলিলেন, “আগামী বছর তোমার ছেলেকেও আমি সভাসদ করিতে চাই, সাথে করিয়া নিয়া আসিও।“ উজির রাণীর পাঁ ছুয়ে সালাম করে বলেন, “রাণী আম্মাজান আপনার পদতলে আমার এবং আমার সন্তান দুইজনেরই বেহেশত।“

*দ্রষ্টব্য: উপরের গল্পটি সম্পূর্ণ কল্পিত। এর সকল চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত কিংবা মৃত কোনো ব্যক্তি, অথবা কোনো ঘটনার সাথে মিল পাওয়া গেলে তাহা নিতান্তই কাকতাল মাত্র।

২৪ মার্চ ২০১৯

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান