
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আমি একটি সংসদীয় আসনের একজন প্রার্থীর ক্যাম্পেইন পরিচালনা দলের সাথে গবেষণার আগ্রহ-জনিত কারণে যুক্ত থেকে নির্বাচনটিকে মাঠপর্যায়ে সরাসরি, ঘনিষ্ঠভাবে দেখার ও পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছি। সে আলোকে নির্বাচনে সংঘটিত ব্যাপক অনিয়ম ও ভোট কারচুপির দৃশ্যসমূহ সরাসরি দেখার ও জানার সৌভাগ্য হয়েছে। নির্বাচনে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের কিভাবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্ব থেকে ও নির্বাচনের দিন পর্যন্ত দীর্ঘসময় ধরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একচ্ছত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মামলা, গ্রেফতার, হয়রানি করা হয়েছে তা সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করার মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতির এক তিক্ত অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হয়েছি।
অত্যন্ত ঘৃণ্য যে ব্যাপারটি ঘটেছে তা হলো ৩০ ডিসেম্বরের ভোট ২৯ ডিসেম্বর রাতের বেলায় হয়ে যাওয়া। আমি নির্বাচনের পূর্ব রাতে অন্তত ১৫-২০টি ফোন কল পেয়েছি যেখানে বিরোধী দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমাকে জানিয়েছে কোথায়, কিভাবে পুলিশ ও সরকারি দলের লোকজন মিলে ব্যালট পেপারে সিল মারছে। প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের অনেককে বাধ্য করা হয়েছে আবার অনেককে টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ‘ করা হয়েছে। রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে কোথাও কোথাও বাক্সেও ভর্তি করা হয়েছে আবার কোথায় সকালে তা বাক্সে ভরা হয়েছে। তবে শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ রাতে ভোট দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বরং ভোটের দিন কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিরোধী দলের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া এবং ভোট কেন্দ্র জবরদখল করে বাকী ভোটগুলো বাক্স-ভর্তি করা হয়েছে। কিছু কেন্দ্রে সকালে মাত্র দুই থেকে তিন ঘণ্টা সঠিকভাবে ভোট চললেও, সকাল ১১টা থেকে ১১:৩০-এর মধ্যে প্রায় সব কেন্দ্র সরকার দলীয় ক্যাডাররা জবরদখল করে নেয়। এই দুষ্কর্মে নেতৃত্ব দিয়েছে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন। সামরিক বাহিনী এক অদৃশ্য কারণে নিষ্ক্রিয় থেকে রাষ্ট্রের মালিকানা ছিনতাই হয়ে যাওয়া দেখেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে এই দুষ্কর্মের সহযোগীও হয়েছে। এভাবে রাতের ভোট ডাকাতি এবং দিনে-দুপুরের প্রকাশ্য গুণ্ডামীর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাত থেকে ছিনতাই করে নেওয়া হয়েছে। জনগণ তাদের প্রতিনিধিত্বশীল শাসকের বদলে বর্তমানে একদল জবরদখলকারীর হাতে জনগণ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দী হয়ে গেলো।
পরবর্তীতে সারাদেশের সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবদের সরাসরি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিনিময়ে এটি নিশ্চিত হয়েছি যে ভয়াবহ অনিয়মটি শুধু আমার পর্যবেক্ষণকৃত নির্বাচনী আসনটিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না – বরং সারাদেশে এই অনিয়মগুলো ঘটেছে। এ অভিজ্ঞতা সুখকর নয়, কিন্তু সময়ের পাঠকে সমৃদ্ধ করেছে।
এই লিখাটিতে লব্ধ অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ নেই (সেটি অন্য আরেক লেখায় তুলে ধরবো)। কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে যে ভয়াবহ অনিয়ম ঘটে গেছে তাতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এক গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে। এই ভয়াবহ অনিয়মের দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি ও প্রভাব সুনির্দিষ্টভাবে কিছু প্রতিষ্ঠানের উপর কিভাবে পড়তে পারে সে বিষয়টি আমি এই নিবন্ধে আলোকপাত করবো।
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে অনিয়মের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেছে অনেকেই। তবে এর বড় দায় শাসক দল আওয়ামী লীগের। কারণ তাদের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বেই এই ঘৃণ্য অপকর্মটি সংঘটিত হয়েছে। তথাপি আমার বিবেচনায় এই ঘটনার ফলে মোটাদাগে চারটি প্রতিষ্ঠান কাঠামোগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা আমি নিম্নে ক্রমানুসারে তুলে ধরছি। এর মধ্যে ১ ও ২ ক্রমের প্রতিষ্ঠানদ্বয় বর্তমান শাসকদল ও প্রধান বিরোধী দল দীর্ঘমেয়াদে (সম্ভবত স্থায়ীভাবে) রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার ঝুঁকিতে পড়লো। তাদের ঘুরে দাঁড়ানো প্র্রায় অসম্ভব ও দৈব ব্যাপার হবে। বাকী প্রতিষ্ঠানগুলো মেরামতে ও সেগুলোর উপর আস্থা ফেরাতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে।
১। আওয়ামী লীগ – ঐতিহ্যবাহী এই দলটি ‘ভোট ডাকাত‘ দল হিসেবে বাংলাদেশের আসন্ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। বর্তমান রেজিম জোর-জবরদস্তি করে টিকে থাকার চেষ্টা করবে এবং হয়তো কিছু সময় শাসন করবে (সেটি বছর, কয়েক বছরও হতে পারে, কিংবা কমও হতে পারে)। কিন্তু তারা একটি দু:খজনক কিন্তু অনিবার্য বাস্তবতা তৈরি করেছে:: কোনো সরকারকে যখন বৈধভাবে অপসারণের আর কোনো পন্থা থাকে না তখন কি ঘটে তা সবার জানা। যারা জানেন না, তারা যদি বিশ্বের ইতিহাস না পড়েও থাকেন, তাহলে অনুগ্রহ করে প্রবীণদের কাছ থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের কথা জেনে নেন। বিপর্যয়টি হচ্ছে যেদিন তাদের এই পরিণতি ঘটবে তারপর থেকে এই দল আর দ্বিতীয়বার গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার অথবা জনগণের দুয়ারে কোনো আবেদন নিয়ে যাওয়ার নৈতিক বা আইনী অধিকার হারাতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী একটা বিশাল, ঐতিহ্যবাহী দলের জন্য ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ আত্মহত্যার দলিলে স্বাক্ষর করার মতো। আমার কথা লিখে রাখেন। তারা এই সাঙ্ঘাতিক ভুলটি না করলে সাময়িক ক্ষতি হতো। হয়তো তারা ক্ষমতা হারাতো, কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে বাংলাদেশ শাসন করার যে জটিল কাজ তার প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ফাঁকগলে জনগণের দুয়ারে দ্বিতীয়বার হাজির হওয়ার সুযোগ তাদের জন্য সবসময়ই খোলা থাকতো। হয়তো এবার অনেকেই তীব্র আক্রোশ নিয়ে তাদের অনেক নেতাকর্মীর ক্ষয়ক্ষতি করতো, কিন্তু আওয়ামী রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা থাকতো। রাজনীতি ব্যক্তি নয়, নীতি ও আদর্শের বিষয়। স্বীকার করি, এই নির্বাচনে পরাজয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীর ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি ছিলো, কিন্তু দলের জীবনকাল ব্যক্তির চেয়ে বড়। দলের, আদর্শের ক্ষতি করতে হয় না। দু:খজনক হচ্ছে, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব ব্যক্তি ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনের কথা চিন্তা করে জোর করে ক্ষমতায় থাকার যে কাজটি করলেন তাতে তাদের কিছু ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেলেও তারা তাদের প্রিয় দলটিকে চিরদিনের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়ে গেলেন। ব্যক্তির ক্ষয়ক্ষতি আওয়ামী লীগ কাটিয়ে উঠতো, কিন্তু আদর্শের পরাজয় দলটিকে অতল গহ্বরে ঠেলে দিলো যা থেকে দলটি আদৌ উঠতে আসতে পারবে কি-না প্রশ্নসাপেক্ষ – আমি মনে করি পারবে না। ১৯৭৪-এর বাকশাল-এর ধাক্কা কেটে উঠতে দলটির ২১ বছর লেগেছিলো এবং তাও সম্ভব হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীদের সীমাহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিও নেই, সেই নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনীও নেই। ২০১৮ সাল বা ২০২৮ (১ বা ১০ – যত বছরই এ সরকার জোর করে শাসন করুক-না-কেন)-এ পতনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠা আর সম্ভব হবে না।
২। বিএনপি – একটি রাজনৈতিক দল অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় যখন সেটি কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করার পর তা বাস্তবায়নের শক্তি হারায় অথবা কোনো অন্যায়কে প্রতিহত করার সক্ষমতা হারায়। বিগত দিনগুলোতে এবং বিশেষ করে গতকাল ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে বিএনপি প্রমাণ করেছে তাদের বিশেষ কোনো সাংগঠনিক শক্তি অবশিষ্ট নেই অথবা আরও স্পষ্ট করে বললে, এই চরম নিপীড়নবাদী রাজনীতিকে প্রতিহত করার ক্ষমতা তাদের নেই। এই পরিস্থিতির জন্য সরকারের তীব্র দমন-পীড়নকে আমি অর্ধেকটা দায়ী করি, পুরোটা নয়। বাকীটা হচ্ছে দল হিসেবে বিএনপির-ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতি না করতে পারার ব্যর্থতা। গণতন্ত্রের লড়াই করতে গেলে নিজেদের গণতান্ত্রিক হতে হয়। গত ১০ বছরে কেউ বলতে পারবে না বিএনপি বা তার কোনো একটি অঙ্গসংগঠন গণতান্ত্রিক পন্থায় তৃণমূলের কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে কোনো কমিটি করেছে। স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে দলটির নেতা নির্বাচন হয়েছে চরম অগণতান্ত্রিক পন্থায়। দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতন্ত্রের লেশমাত্র ছিলো না। যার ফলে দলটির চিন্তায় জড়তা-অসারতা এসেছে এবং এটি গণসম্পৃক্ত কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি। দলটি ধীরে-ধীরে নির্জীব হয়েছে, প্রাণশক্তি হারিয়েছে। তারা জনগণকে ব্যাপক সংখ্যায় তাদের পিছনে মাঠে নামার মতো আস্থা বা বিশ্বাস তৈরি করতে পারেনি বিধায় যখন জনগণের প্রধান মৌলিক অধিকারটি গতকাল ৩০ ডিসেম্বর ভুলুণ্ঠিত হলো, তখন আপামর জনসাধারণ ভেতরে-ভেতরে ক্রুদ্ধ হয়েছে, ক্ষিপ্ত হয়েছে, রাগান্বিত হয়েছে, এমনকি এই সরকারকে ঘৃণা করতেও শুরু করছে – কিন্তু বিএনপির ব্যালট রক্ষার দায়িত্ব নেয়নি, লাঠি-গুলির ঝুঁকির মুখে শয়ে-শয়ে তরুণ-যুবক বুক পেতে দেয়নি। ফলে এটি পরিষ্কার যে, আওয়ামী লীগ সরকার পুলিশ, বিডিআর, প্রশাসন, বিচারবিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সামরিক বাহিনীসহ দেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠানকে তাদের এই সমুদ্র-চুরির নির্বাচনে কাজে লাগানোর পর এই মহা-ডাকাতি ঠেকানোর জন্য যে ব্যাপকতায় জনগণকে উদ্দীপ্ত করার কথা তা করার ক্ষমতা এই মুহূর্তে বিএনপির নেই। সেটি কেন তার আত্মনুসন্ধান বিএনপিকেই করতে হবে। আমার বিশ্লেষণটি উপরে কিছুটা বলেছি – অর্থাৎ গত ১০ বছর জনগণের স্বার্থের পক্ষে জোরালো কোনো রাজনীতি করতে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। বাড়ি রক্ষা কিংবা মামলা থেকে রক্ষার রাজনীতি জনগণের রাজনীতি নয়। জনগণের রাজনীতি মানে কী, এবং সেটি কিভাবে করতে হয় সেটি নিয়ে আমার নিজস্ব ভাবনা আছে এবং তা অন্য কোনো প্রেক্ষাপটে বলতে পারি – তবে আমি মনে করি একটি বড় রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে সেটি বিএনপির নিজেদেরই জানা আছে। যাই হোক, মোটা দাগে বর্তমান নেতৃত্ব, ভাবনা, ও কৌশল নিয়ে বিএনপি‘র পক্ষে এই জগদ্দল পাথর সরানো সম্ভব নয়। এবং তা সরাতে না পারার ব্যর্থতা বিএনপির রাজনীতিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিবে। নতুন কোনো শক্তি নতুন পন্থায় সে কাজটি করবে এবং তার সুফল বিএনপি‘র ঘরে যাওয়ার সম্ভাবনা সামান্যই।
৩। গণমাধ্যম – গত দুদিন একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে। বর্তমান সরকার প্রমাণ করেছে যে তিন ডজন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লাইসেন্স দিয়ে একটা তথাকথিত ‘মুক্ত‘ গণমাধ্যমের আবহ তৈরি করা যায় আবার দরকার হলে টাকা ও হুমকি দিয়ে পুরোপুরিই তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের ক্যাম্পেইন টিম থেকে আমরা ভোটের দিন দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছি যে ১৫০টিরও বেশি ভোটকেন্দ্র পুলিশ ও শাসক দলের ক্যাডারদের দ্বারা জবরদখল হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো সাংবাদিক তা রিপোর্ট করেননি বা করলেও কেন্দ্র থেকে ছাপানো হয়নি বা প্রচার করা হয়নি। একটি টেলিভিশন চ্যানেল ২ মিনিট তাদের স্ক্রলে এটা দেখালেও পরপরই তা মুছে ফেলে। স্থানীয় সাংবাদিকরা আমাদেরকে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন যে তাদেরকে প্রচণ্ড চাপের মুখে রাখা হয়েছে এবং হুমকি দেওয়া হয়েছে যাতে নির্বাচনী অনিয়মের কোনো ঘটনা তারা প্রতিবেদন না করেন। অনেকের কাছ থেকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করারও খবর পেয়েছি। এম্বেডেড জার্নালিজমের নতুন বাস্তবতা চোখের সামনে দেখলাম। সরকার কঠোর সেন্সরশীপের মাধ্যমে নির্বাচনী সংবাদ প্রচার বা প্রসার নিয়ন্ত্রণ করেছে। মানুষ যেন সামাজিক মাধ্যমেও সংবাদ না পায়, শেয়ার করে সেজন্য মোবাইল নেটওয়ার্কের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। বড় বিপর্যয়টি ঘটেছে যখন দেখতে পাই যে বড়-বড় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীদের কেউ এই সেন্সরশীপকে চ্যালেঞ্জ করেনি এবং আপাত:দৃষ্টিতে নিরবেই মেনে নিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের সামনে বাস্তবতা হচ্ছে দুই-তিন ডজন টিভি চ্যানেল বা শত-শত গণমাধ্যম থাকলেও তারা সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করতে পারে – ভয়ে বা লোভে যে কারণেই হোক। সাংবাদিকতার এই ভয়াবহ নৈতিক অধ:পতন গণতন্ত্রের লড়াইকে আরও কঠিন করে তুললো সত্য, তবে যেখানে সারা দেশের মানুষ দেখেছে ও জানে যে তাদের চোখের সামনে এত বড় একটা ভোট ডাকাতি হলো কিন্তু টিভিগুলো বলছে যে ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন‘ হয়েছে – তখন সংবাদমাধ্যমের উপর মানুষের আস্থাটা তীব্র ঝাঁকুনি খেয়েছে। গণমাধ্যমের এই ক্ষত, অবিশ্বাস কীভাবে, কতদিনে কাটিয়ে উঠা যাবে নিশ্চিত নই।
৪। সামরিক বাহিনী – আমরা প্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গ, পুলিশ, বিচারবিভাগ ও নির্বাচন কমিশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নগ্ন দলীয়করণ ও তার সফল ব্যবহার ৩০ ডিসেম্বর কিংবা গত একমাস ধরে দেখলেও, সবার একটা প্রচ্ছন্ন আশা ছিলো সামরিক বাহিনী এই দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হতে অস্বীকৃতি জানাবে। মানুষের অধিকার রক্ষায় ন্যূনতম ভূমিকাটি পালন করে মানুষকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিবে এবং সেই ভোট সুষ্ঠুভাবে গুণে মানুষ যেন তাদের প্রকৃত প্রতিনিধি বেছে নিতে পারে সেটি নিশ্চিতকরণে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে। মানুষের মনে এই প্রত্যাশাটি ছিলো। তবে তারা একেবারেই কোনো ভূমিকা পালন না করলে মানুষ নিশ্চয়ই হতাশ হতো, কিন্তু যেটির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না তা হলো তাদেরই সহযোগিতায় আমাদের একটি ভোট কেন্দ্র দখলের ঘটনা। হবিগঞ্জ-১ আসনের অন্তত একটি কেন্দ্রে তাদের সহযোগিতায় কেন্দ্র দখলের অভিযোগ স্থানীয় সাধারণ মানুষ আমাদেরকে অবিশ্বাসের সুরে ফোন করে জানিয়েছেন। আমি নিশ্চিত গতকাল যা হয়েছে এই বাহিনীর জন্য সুখকর কোনো বিষয় নয়, এবং তাদের সামনে এত বড় ভোট ডাকাতির একটি ঘটনা ঘটার পরও যে তারা কিছু করতে পারেনি সে যন্ত্রণা বাহিনীটিকে অস্থির করে তুলবে। আগামী দিনগুলোর জন্য যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তার খেসারত জাতি হিসেবে আমাদের দিতে হবে। কেবল আশা করতে পারি যেন অল্পের উপর দিয়ে যায়।
পরিশেষে:
নির্বাচন ব্যাপারটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক অংশ। কারণ এটি গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত। গণতন্ত্রের বাকী শর্তগুলো পূরণ একটি চলমান প্রক্রিয়া, দেশ-জাতি-সংস্কৃতি ভেদে এর জন্য দীর্ঘসময় লাগতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রে নির্বাচন ছাড়া বাকী শর্তগুলো অর্থহীন। আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সেভাবে হয়নি, কিন্তু আমরা ন্যূনতম শর্তটি কোনোভাবে টিকিয়ে রেখেছিলাম। বাকী আশাগুলো টিকে ছিলো প্রথম শর্তটির উপস্থিতিতে। কিন্তু ২০১৪ সালে যা হলো, এবং যার চূড়ান্ত পরিণতি ছিলো ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮, এটি আমাদের ১৯৯০-পরবর্তী গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক। দু:খজনকভাবে আমরা ১৯৯০ পূর্ববর্তী বাস্তবতায় ফিরে গেলাম যেখানে আমাদেরকে আবারও গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্তটির জন্য লড়াই করতে হবে। একদিন আমরা ঠিকই সে অধিকারটি ফিরে পাবো। তখন আমরা রাষ্ট্রের ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক স্পিরিটে পুনর্নিমাণ করতে পারবো। তবে উপরিউক্ত তালিকার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান – ১ ও ২ নম্বর প্রতিষ্ঠানদ্বয় আর প্রাসঙ্গিক থাকবে কিনা সে সংশয়ের কথা লিখে রেখে গেলাম। আমি মনে করি থাকবে না। ১ নম্বর প্রতিষ্ঠান, যারা ক্ষমতায় আছে তারা ক্ষমতার বিকারে অন্ধ। বেশি দূর দেখার ক্ষমতা তাদের নেই। যার ফলে তাদের বর্তমান শাসনকাল সমাপ্ত হবার পরপরই তারা বুঝবে ৩০ ডিসেম্বর তাদের দলের রাজনৈতিক জীবনে কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। অন্যদিকে ২ নম্বর প্রতিষ্ঠানটি নেতৃত্ব ও ধারণার জড়তার জন্য ইতোমধ্যেই প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ সেকারণেই আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ কিছু।