
বাংলাদেশ মহাকাশে তার প্রথম স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। এই গৌরবের অংশীদার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক। এই মাহেন্দ্রক্ষণকে উদযাপনে সকল সংকোচ দূরে ঠেলে রাখা যায়। উদ্যোক্তা, আয়োজক, নির্মাতা – সবাইকে ধন্যবাদ জানানো যায়। প্রতিটি জাতির ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকগুলো থাকে, আজ ১২ মে ২০১৮ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এরকমই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কেন নিচে বলছি। হিসেবে-নিকেশের অনেক বিষয় আছে, কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের এ ক্ষণটি উৎযাপন করা উচিত বৃহত্তর স্বার্থে।
আমাদের দেশের চায়ের স্টল, গলির দোকানের আড্ডার বেশিরভাগে জুড়ে থাকে কাঁদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি, পারস্পরিক কুৎসা, গীবত প্রভৃতি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কল্যাণে একদিন/ ২৪ ঘণ্টা বা এক সপ্তাহের জন্য হলেও যদি মানুষ মহাকাশ নিয়ে কথা বলে, স্যাটেলাইট নিয়ে কথা বলে – তার একটা বিপুল সাংস্কৃতিক চেতনাগত আঙ্গিক রয়েছে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে হাজারো তরুণ, শিক্ষার্থী যদি এই উপলক্ষে টিভিতে ফ্যালকন – ৯ রকেটে করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মহাকাশ যাত্রা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়, যদি লক্ষ তরুণ এই দৃশ্য দেখে শিহরিত হয় – এবং তাদের মধ্য থেকে যদি ৫০ জন, ১০০ জন তরুণও যদি ভাবে আমি মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে আরো জানতে চাই, পড়ালেখা করতে চাই, গবেষণা করতে চাই – এই চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্ন দেখার প্রভাব সুদূর।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের পাবনার রূপপুরে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার পর (যেটি এরকম অনেক বিচারেই যুগান্তকারী বলেই মনে করি – ঝুঁকি, সংশয় সব নিয়েও) সরকারি নীতি-নির্ধারকদের উৎসাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে দেশের সর্বপ্রথম ‘নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগ চালু হয়েছিলো। মনে আছে, সংবাদটিকে যুগান্তকারী আখ্যা দিয়ে একটি ছোট্ট মন্তব্য লিখেছিলাম। জাতি হিসেবে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সফিস্টিকেশন এখনো আঁতুড়ঘরে। যারা আমাদের হাতি-ঘোড়া মেরেছি জাতীয় ইতিহাস লিখেন বা পড়ে শোনান তারা বাহুল্য করেন। আমাদের এখানে হাজার বছরের ইতিহাসেও পদ্ধতিগত, মৌলিক জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণার ইতিহাস দুর্লভ। পৃথিবীর নানা জাতির চেয়ে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে যোজন-যোজন পিছিয়ে। তো এই অজপাড়া গাঁয়ের জন্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অথবা মহাকাশ স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সূচনা, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের বিষয় পড়ানোর উদ্যোগ – এসবই আমি মনে করি আমাদের কালচারাল ব্যারিয়ার ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ। অনেক যোগ-বিয়োগের ভিড়েও এই অদেখা অর্জনটি দেখার চোখ কম। দেশের আপামর তরুণদেরকে সাহসী করে তুলতে এগুলো দৃঢ়তর উদ্যোগ।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের এই সফল উদ্যোগের সাথে SingTel-এর কাজি হাফিজ আল হাসান ভাই জড়িত। উনার প্রতিষ্ঠান SingTel ফ্রেঞ্চ কোম্পানী Thales এর সহযোগী হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের জন্য বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি, দেখাশোনা প্রভৃতি কারিগরি বিষয় নিয়ে দিন-রাত কাজ করছেন। বছর দেড়েক আগে উনি আমাকে ফোন করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের মেধাবী, আগ্রহী কিছু তরুণ চেয়েছিলেন যাদেরকে উনি গড়ে তুলবেন, এবং দেশে-বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে এই নতুন, সম্ভাবনাময় খাতটির জন্য তৈরি করবেন। আমি আমাদের কম্পিউটার বিজ্ঞানের কিছু সদ্য পাশ করা শিক্ষার্থীকে উনার কাছে পাঠাই। এরই একজন ওমর শাহজালাল শান্তনু। ছেলেটির আগ্রহ ও উচ্ছ্বাসের কারণে তাকে আমি নিজে হাফিজ ভাইয়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। হাফিজ ভাই বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, দেশে-বিদেশে টেলিকমিউকেশন্সে নিয়ে কাজ করা অসম্ভব মেধাবী, কিন্তু বিনয়ী একজন মানুষ। আমার কাছে তার বড় পরিচয় তিনি একজন ক্রিকেট পাগল মানুষ। প্রথম সাক্ষাৎকারে উনি শান্তনুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ক্রিকেট খেলতে পারো’! যাই হোক শুরুর কফি আড্ডার পর হাফিজ ভাইয়ের সাথে দেখা হলে ছেলেদের কথা জিজ্ঞেস করতাম, যে তারা কে কেমন করছে। ইতোমধ্যে শান্তনুদের প্রশিক্ষণে ফ্রান্স পাঠানো হয়েছে। হাফিজ ভাই ছেলেগুলোর মেধা, দক্ষতা দেখে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। আমাকে কয়েকবার বলেছেন এ ছেলেগুলো এত মেধাবী যে এদেরকে আমরা ধরে রাখতে পারবো না। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশের মেধাবী উদ্যোক্তা কাজি হাফিজ আল হাসান, মেধাবী তরুণ ওমর শাহজালাল শান্তনুদের মতো শত-শত মেধাবীদের আগ্রহের দুয়ারও উন্মোচিত করেছে। তাদেরকে শিহরিত করেছে যে মহাকাশ নিয়ে বাংলাদেশের জন্যও কাজ করা যায়। এর কতটুকু আর্থিক মূল্য বের করবেন আপনি? যারা হিসেবের যোগ-বিয়োগ করছেন তাদের জন্য তোলা রইলো।
আমরা যারা শুধুই সমালোচনা করি…
সরকারের সমালোচনা হবেই। সরকার মাত্রই জনগণের সমালোচনার পাত্র হবে। জনগণ, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী দল, পেশাজীবী সংগঠন, নাগরিক সংগঠন – সবার কাজ সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া। দুনিয়ার সকল সরকারকেই এ জাতীয় সমালোচনা সইতে হয়, হবে। আমাদেরকেও সরকারের সমালোচনা করতে হবে। যৌক্তিক সমালোচনাগুলো তীব্রভাবেই করতে হবে। আঘাত আসলেও। কেন, কি কারণে ফেনী জেলার ফতেহপুরে মাত্র ২০০ মিটার বা তারো কম একটি ওভারপাস করতে ৬ বছর লাগবে? আমরা যেখানে পারমাণবিক চুল্লি করছি, মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছি সেখানে ২০০ মিটার ওভারপাস করতে কেন দুইবার, দুটির প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করতে হবে? যারা প্রথমবার ব্যর্থ হয়েছে তাদের কি শাস্তি হয়েছে? কেন ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো ব্যস্ত মহাসড়কে বিকল্প যান চলাচলের ব্যবস্থা না করে, রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দিয়ে ওভারপাসটির কাজ করতে হবে? হাজার-হাজার মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলা হলো? সরকারের জবাবদিহিতা কোথায়? অথবা ফার্মার্স ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতে জনগণের হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তদন্ত কোথায়? শাস্তি কোথায়? কমিশন কোথায়? কেন সত্যানুসন্ধান ছাড়া, অপরাধীদের শাস্তি ছাড়া জনগণের শত-শত কোটি টাকা দিয়ে লুটেরাদের আবারো বেইল-আউট করা হচ্ছে? এইসব কঠিন প্রশ্নের জবাব সরকারের কাছে চাইতে হবে। সরকার জনমতকে গুরুত্ব দিলে এগুলোর সঠিক উত্তর দিবে, সুশাসনে কাজ করবে, আর সরকার যদি থোড়াই কেয়ার করে, সেক্ষেত্রে ইতিহাসের অমোঘ নিয়তি, রায়ের জন্য তাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
কিন্তু সব বিষয়ে মোটাদাগে সমালোচনা হিতে বিপরীত হতে পারে। এতে সমালোচনার মেরিট নষ্ট হয়। কারণ একটা পর্যায়ে বিষয়টা ‘ও তো সমালোচনা করবেই’ জাতীয় ক্লিশে-তে হারিয়ে যায়। এতে পক্ষ-বিপক্ষের লাভ-ক্ষতি হয় না – কারণ তারা ইতোমধ্যে তারা তাদের অবস্থান ঠিক করে নিয়েছে। কিন্তু এই লেবেলিং-এ সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হয় মধ্যপন্থীরা, সাধারণ আমজনতা যারা এ বা বি দলে নেই। তাদের বোকা ভাবা অনুচিত হবে। সকল মানুষেরই একটা স্তর পর্যন্ত রিজনিং করার সক্ষমতা রয়েছে। যখন দেশে বিদ্যুতের হাহাকার, দিনে ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিং তখন তারা কুইক বা স্লো যে রেন্টাল বিদ্যুৎই পায় গলে যায়, কৃতার্থ হয়। সেই মুহূর্তের সমালোচনাটা হতে হয় ভারসাম্যপূর্ণ – বিদ্যুতের জন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়, এবং তার পাশাপাশিই আপনি লাভ-ক্ষতির নির্মোহ হিসেব, কিংবা হাজারো কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগটার দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারেন। একইভাবে ফ্যালকন-৯ -এ চড়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যখন মহাকাশে ছুটছে এবং সারাদেশের টেলিভিশনে সে দৃশ্য দেখাচ্ছে – তখন বাংলার ঘরকুনো সাধারণ মানুষের বেশিরভাগই হয়তো এটি দেখে শিহরিত হয়েছে যে ’ওই, বাংলাদেশের রকেট যায়’। এটি তাদের জন্য পজিটিভ কালচারাল শক। কালচারাল ব্যারিয়ার ভাঙাও। বাংলাদেশ মহাকাশে এই আলোচনাটা এই নিয়ে মাত্র দু’বার হলো। সুতরাং আপনি অনেক চেষ্টা-কসরত করে স্যাটেলাইটের লাভ-ক্ষতি নিয়ে এখন হৈ-চৈ করার অর্থ হচ্ছে নির্মোহ বিশ্লেষক হিসেবে আপনার বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে বিরোধী দলের কর্মীর ভূমিকায় নিজেকে নিয়ে আসা। স্যাটেলাইটটির হিসেবে অবশ্যই গলদ থাকার সম্ভাবনা প্রচুর, অন্য লুটপাট গুলোর মতো এখানেও নয়-ছয়ের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এর লাভ বাড়িয়ে কিংবা ক্ষতি কমিয়ে বলাও হয়তো হয়েছে। একজন নির্মোহ বিশ্লেষক হিসেবে এই নিটিগ্রিটি, হিসেব-নিকেশ অবশ্যই তুলে ধরতে হবে, তবে পার্শ্ব নোট হিসেবে। ইতিবাচক দিকগুলোও তুলে ধরে। বিশ্লেষক, গবেষক, বুদ্ধিজীবিদের জন্য সবচেয়ে আত্মঘাতী হচ্ছে এ বা বি-এর কর্মীর ট্যাগ পাওয়া।