দুইবার শখের বসে বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিলাম, দুইবারের পরীক্ষায় তিনবার ভাইবা (একটা পরীক্ষায় দুর্নীতির কারণে দু’বার ভাইবা হয়েছিলো। পরীক্ষা যখন দিবো মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়েই দিয়েছিলাম। তিনটা পছন্দ দিয়েছিলাম: পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ। পুলিশ কেন দিয়েছিলাম অনেকে হাসাহাসি করেছিলো। যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় দেখি আমার দেখা হলের বেশিরভাগ বড় ভাই শুধু বিসিএস’র গাইড পড়ে, ‘পুলিশ’ হতে চায়। তাদের দেখাদেখি আমিও দুইবার পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু ভাইবা বোর্ডে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক আশরাফ সাহেব আমাকে দুইটা ইংরেজি শব্দের বানান জিজ্ঞেস করেছিলেন। কোনো ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন নেই। মজা করতে বসেছিলেন যেন। পরে ওই অধ্যাপক সম্পর্কে অনেক আপত্তিকর কথাবার্তা শুনেছিলাম। তার আচরণ ছিলো ডিসগাস্টিং।
দুইবারের যাত্রায় আমি আমার এক্সপেরিমেন্টের সমাপ্তি টানি। এসব দুই নাম্বার লোকের মুখোমুখি আর হতে চাইনি। তাছাড়া বিসিএস বা সরকারি চাকুরি নামক বস্তুটিকে আমার আগাগোড়াই আনফেয়ার গেম মনে হয়েছে – ৫৫ ভাগ লোক আপনার চেয়ে শতগুণ কম মেধা নিয়েও কোয়ালিফাই করবে! যাচ্ছেতাই ব্যাপার। কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক যুক্তির লোক এসব মানবে না। পরে তো ভেতরের খবর আরো জানলাম। এসব কোটা দুর্নীতিবাজ লোকদের একটা হাতিয়ারও। আমাদের সময়ে আমার দেখা দুই চারজন ছেলে-মেয়ে যাদের আমরা মেধাবী বলে জানতাম বা বিবেচনা করতাম তারা ওই চাকুরিতে গেছে। বাকীদের বেশিরভাগ মিডিওকার। বিসিএস’র ওই পরীক্ষায় আপনার ক্রিটিক্যাল থিংকিং নিয়ে কোনো নাম্বারিং হবে না, আপনার ইন্টেলিজেন্ট ইনটুইশন, অ্যানালিটিক্যাল রিজনিং নিয়েও কোনো যাচাই-বাছাই হবে না। সমগ্র শিক্ষা পদ্ধতির মতো এখানেও আপনাকে সবজান্তা শমসের হতে হবে – দুনিয়ার তাবৎ ‘এনসাইক্লোপিডিয়া জ্ঞান’ নিয়ে আপনাকে পরীক্ষার হলে বসতে হবে। কিছু জিনিস মুখস্ত করে উগড়ে দিলে আপনি মেধা তালিকার ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকলে (আমার হিসেব মতে) মেধা কোটায় আপনি স্থান পেলেও পেতে পারেন। মেধা কোটার বাকী ৩৫-৪০ ভাগ পদ দলীয় কোটা, আত্মীয় কোটা (রাজনীতিকদের আত্মীয়, পিএসসি কর্মকর্তাদের আত্মীয়, সরকারি সচিব-উপসচিবদের আত্মীয় প্রভৃতি), টাকার কোটা ইত্যাদিতে চলে যাবে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করি (ভুলও হতে পারে, তবে সম্ভাবনা কম) যে বিসিএস-এ কোয়ালিফাই করা পরীক্ষার্থীদের ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীও জিআরই পরীক্ষায় ৩০০-ও পাবে না। এ্ গেলো মেধা কোটার কাহিনী। বাকী ৫৫ ভাগ হচ্ছে রাজনৈতিক মতাবলম্বী পুনর্বাসন প্রকল্প। আর কিছু বললাম না।
বাংলাদেশের মতো ’সর্ব অনিশ্চয়তার’ দেশে সরকারি চাকুরি অবশ্যই লোভনীয় ব্যাপার। অবশ্য আমার হল জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি কিছু ছেলে-পেলে ওইখানে যেতে চায় ‘ক্ষমতার’ প্রতি অকুণ্ঠ মোহ থেকে। তারা ক্ষমতা চর্চা করতে চায়। ব্রিটিশদের ’দালাল সিভিল সার্ভিসে’ জনগণকে নিষ্পেষণ করার জন্য একদল ‘সিভিল সার্ভেন্ট’ পোষা হতো। প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কে জনগণ তাদেরকে স্যার ডাকবে বলে শেখানো হয়। আর স্যার ডাকের প্রতি বাঙালির কী দুর্নিবার মোহ!! অনেক বড়-বড় লোকেরাও এখনো ব্রিটিশ রানীর সামনে হাটু গেড়ে স্যার উপাধি নিতে চান। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে স্যার ডাকলে আমার লজ্জা লাগে। আমেরিকায় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাদের কি সম্বোধন করবো – তারা বলে এখানে শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীরা ‘প্রফেসর’ ডাকে। আপনি রিডার, লেকচারার, সহকারী/সহযোগী অধ্যাপক যাই হোন, আপনাকে ‘প্রফেসর’ ডাকবে। কেউ কাউকে স্যার ডাকে না। প্রেসিডেন্টকে জনগণ মি. প্রেসিডেন্ট বলে। কেবল সরকারি কর্মচারী – পুলিশ, রাজস্ব কর্মকর্তা, বা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী – তারা জনগণকে স্যার ডাকবে। আপনার কানাকড়িও নেই – তবু তাদের চোখে আপনি স্যার, কারণ আপনার করের পয়সায় তাদের পোষা হচ্ছে। দুনিয়ার কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের করের টাকায় পোষা রাষ্ট্রের ‘সার্ভেন্ট’দের স্যার ডাকা হয় না। উল্টোটা হয়। রাষ্ট্রের কর্মচারীরা জনগণকে স্যার ডাকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু মেধাবী এই প্রভু হতে উন্মুখ থাকে। রাজনীতিকরা অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চান বিধায় জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক বানান না। ভৃত্যদের হাতে মালিকানা অর্পণ করেন।
তারপরও, যারা বিসিএস-সহ সরকারি চাকুরিতে কোটা-বিরোধী এই আন্দোলন করছেন, তাদের প্রতি ২০০ ভাগ সমর্থন থাকবে। কেউ চাকুরি করবে বলে আন্দোলন করছে, কেউ নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে। আমার সমর্থন নৈতিকতার জায়গা থেকে। ৫৫ ভাগ কোটা অন্যায্য, হঠকারিতামূলক এবং অবশ্যই সংশোধন দরকার। নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে ৫-১০ শতাংশ কোটা থাকতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের একটা করে বাড়ি করে দেন, পড়ালেখা ফ্রি করে দেন। জ্ঞানার্জন করুক, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করুক।
পাশাপাশি ‘বিসিএস’ বা সরকারি চাকুরিপ্রার্থী ভাই-বোনদের উদ্দেশ্যে ছোট্ট অনুরোধ থাকবে: প্রিয় ভাই ও বোনেরা, পৃথিবীটা সরকারি চাকুরির চেয়েও অনেক বেশি বড়। সত্যিই অনেক বিশাল। নিজের জগতটাকে এই ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরে নিয়ে যান। দেশ-বিদেশে তাকান। উচ্চ-শিক্ষা নিন। উদ্যোক্তা হোন। নিজেকে চ্যালেঞ্জ করুন। দুনিয়ার সেরা মানুষগুলোর কেউই সরকারি চাকুরে না। আপনিই সিদ্ধান্ত নিন বড় মানুষ / সেরা মানুষগুলোর একজন হবেন, না-কি সরকারি চাকুরি করবেন। সবার প্রতি শুভকামনা।