বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন একবার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন। তথাকথিত ’আরব বসন্ত’ চলার সময় মধ্যপ্রাচ্যের এক পণ্ডিত উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘বাংলা বসন্ত’ কবে আসবে? উনি জবাব দিয়েছিলেন এই বসন্ত বাঙালি ষাট/সত্তরের দশকে পার করে এসেছে। বাঙালি বা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ পরিবর্তনের প্রত্যাশায় বারবার রাস্তায় নেমেছে। যার সর্বশেষ উদারহণ ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার-পতন আন্দোলন। দুঃখজনকভাবে সাধারণ জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বরাবরই প্রতারিত হয়েছে। যারা জনগণকে ‘মুক্তির’ স্বপ্ন দেখিয়েছে তাদের অনেকেই পরবর্তীতে যতটা না সমাজ, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি নিজের, পরিবারের, আত্মীয়-স্বজনের ভাগ্য পরিবর্তনে নিয়োজিত থেকেছে।
সমাজ পরিবর্তনে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রগতি একটি বড় নিয়ামক। মানুষের দৈনিন্দিন জীবন-যাপনে সেই অগ্রগতির ছোঁয়া লাগে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক মিথষ্ক্রিয়ায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটা গরীব দেশ যাই করুক, যে পরিস্থিতিতেই পড়ুক, যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়া সাধারণত এগিয়েই যায়। ধীরলয়ে অথবা দ্রুততার সাথে। এই লয় নির্ভর করে নেতৃত্ব এবং জনগণের সৃজনশীলতা ও কর্মস্পৃহার উপর। এর পাশাপাশি যোগ হয় বিশ্বায়নের শক্তি। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মাঝে কিছু স্বপ্নচারী মানুষ রয়েছেই যারা নিজেদের ও অন্যদের ভাগ্য বদল করতে চায় – এই সম্মিলিত শক্তি দেশকে, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শত অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির মাঝেও। মানুষ এগিয়ে যাওয়ার রোল মডেল খুঁজে নেয়। গ্রামে-গঞ্জে, মফস্বলে।
মৌলিক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে মানুষের মাঝে সাধারণভাবে কিছুটা নিস্পৃহা কাজ করে। তবে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন সাধনে বিদ্যমান নিরবতার দুটো কারণ রয়েছে বলে মনে করি: এক দিকে রয়েছে মানুষের অতীত আন্দোলন-সংগ্রামের ফসলগুলো ক্রমাগত ছিনতাই হয়ে এলিটদের কাছেই চলে যাওয়ার ইতিহাস। অবশ্য এর ভিন্ন কিছু আশা করাটাই দুঃসাহসী স্বপ্ন। মানুষের বিপ্লবের ইতিহাস ভিন্ন কিছু বলে না। যার ফলে বারংবার প্রতারিত বোধ করা মানুষ সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। বিশ্বাস সৃষ্টির প্রচেষ্টাও যুগে-যুগে, রাষ্ট্রে-সমাজে কম পরিলক্ষিত হয়। আমার কমিউনিটির মানুষ কেন আমাকে বিশ্বাস করবে, কখন করবে, কতটুকু ত্যাগের বিনিময়ে সেটি সবসময়ই একটি বিরাট প্রশ্ন? আমি মনে করি দু’ভাবে একটা সমাজে বা রাষ্ট্রে মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হতে পারে: প্রথমত, মানুষের মাঝে যদি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা যায় যে যেসব পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে তা আসলেই হবে, এবং যারা পরিবর্তনের কথা বলছে তাদের প্রতিও বিশ্বাস রয়েছে। এই বিশ্বাস শব্দটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাসের সাথে শিক্ষা ও অন্যান্য যোগ্যতার প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি সততা, নৈতিকতা, ও সক্রিয়তার প্রশ্নও আছে। মানুষ সাধারণত দেখতে চায়, জানতে চায় পরিবর্তন চাওয়া মানুষগুলোর ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ নিজের আরাম-বিলাস ত্যাগের ইতিহাস, ঝুঁকি নেওয়ার ইতিহাস, অঙ্গীকারের দৃঢ়তা। উদাহরণস্বরূপ: রাজনীতিক মাহমুদুর রহমান মান্না দীর্ঘদিন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁদের আকাঙ্ক্ষার সাথে সম্ভবত খুব বেশি লোক দ্বিমত করবেন না। কিন্তু কেন মানুষ বিশ্বাস করবে যে তিনি বা তাঁর অনুসারীরাও বদলে যাবেন না? কেন তাঁকে বিশ্বাস করতে হবে? বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কথাবার্তা বলা ব্যতিরেকে কোনো সুনির্দিষ্ট কাজে জড়িয়েছেন যাতে জনস্বার্থ রক্ষা করা যায়? যেমন ধরুন, শেয়ার বাজারে লক্ষ মানুষের পুঁজি হারানোর ঘটনায় মানুষের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অসংখ্য মিছিলের মাঝে তিনি বা তাঁদেরকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাঁরা মতিঝিল গিয়ে রাস্তায় বসে পড়েননি, মানুষের জন্য পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হননি। এসব ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র লড়াই মানুষ মনে রাখে, এভাবেই বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি হয় যে, এতো আমাদেরই একজন, আমাদের জন্য মার খাচ্ছেন। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানুষ লাগবে। সেজন্য ঝুঁকি নিতে হবে। দ্বিতীয় আরেকভাবে পরিবর্তন সূচিত হতে পারে যদি অপশাসন নিজ থেকেই ধ্বসে পড়ে। একটা বড় ঝুঁকি তৈরি হয়, লক্ষ-লক্ষ সাধারণ মানুষ রাতারাতি জীবন-জীবিকার সংকটে পড়ে। বাংলাদেশের মতো একটা বিস্ফোরোন্মুখ দেশ শাসন করা খুব একটা সহজ নয়। এখানে এ কারণেই দীর্ঘমেয়াদে স্বেচ্ছাচারী শাসন অসম্ভব। এই ফল আউটের জন্য কেউ অপেক্ষা করলেও করতে পারে। তবে এই ফল আউট ব্যাপকমাত্রায় বিশৃঙ্খল, নৈরাজ্যের হতে পারে যা নিয়ন্ত্রণে প্রকারান্তরে সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হতে পারে এবং যার ফসল চূড়ান্ত বিচারে আবারো এলিটদের একটা গ্রুপই ক্যাপচার করে ফেলতে পারে। সেজন্যই মানুষের মুক্তির জন্য মানুষের সংগ্রামের বিকল্প নেই। সেই সংগ্রামটা দীর্ঘ, কণ্টকাকীর্ণ, কষ্টসাধ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে পথে হাঁটার মানুষ কম হয়। যারা হয় তারা বরণীয় হয়। সত্যিকারের নেতা হয়।
কিন্তু একটা সমাজে নেতৃত্ব গ্রহণ বা একজন নেতা তৈরি একটা প্রক্রিয়ার অংশমাত্র। একজন নেতা দীর্ঘ পরীক্ষিত, ট্রায়াল এন্ড এরর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদিত হয়। যেমন, বাংলাদেশে যারা দীর্ঘ সময় ধরে গণতন্ত্রের, মানুষের অধিকারের সংগ্রাম করেছেন (কিংবা আপোষও করেছেন) তাঁরা এক বা দুই প্রজন্ম আগের। সেই প্রজন্মের সুফলভোগী বর্তমান রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীসমূহ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, কিংবা সমসাময়িক ‘নির্বাচন-কেন্দ্রিক গণতন্ত্র’ সেটি ওই লড়াইয়েরই ফসল। এখন এটাকে পরবর্তী পর্যায়ে নেওয়ার জন্য যে বিকল্প নেতৃত্ব দরকার বা একটা বিকল্প ন্যারেটিভ তৈরি প্রয়োজন তা রাতারাতি কোনো বিষয় নয়।
একজন ব্যক্তি নিজের বাস্তবতা, অবস্থান পরিবর্তন করতে তার জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় ব্যয় করে ফেলে। একটি নির্দিষ্ট সমাজের একগুচ্ছ মূল্যবোধ পরিবর্তন এরূপ শত, হাজারো ব্যক্তির শিক্ষা, অভ্যাস, আচরণ পরিবর্তনের বিষয়। সেজন্যই একটা সমাজ ব্যবস্থা কখনো এক, দুই বা দশ বছরে পরিবর্তিত হয় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলে যায়। একটা রাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিবর্তন এরূপ শত-সহস্র সমাজের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পরিবর্তনের সমষ্টি। ক্ষমতার পট-পরিবর্তন ভিন্ন বিষয়, ব্লিপ বা সাময়িক একটি বিষয়। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের রাজনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ যেখানে একটি সত্যিকারের কল্যাণমূখী, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা মানুষের অন্তর্জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণা, সম-অধিকারের ধারণা, সহিষ্ণুতার পাঠ ব্যক্তি-পরিবারের নর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে লড়াই দীর্ঘ।