বাংলাদেশে চরমপন্থার বিপদ লড়তে হলে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তবের লোকজনকে সামনে রেখে স্ট্রাটেজি ঠিক করেন। ইমাম সাহেবদের বলেন, হেফাজত, জামাত, আলিয়া, কওমী কাউকে বাদ না দিয়ে, সবাইকে ডেকে বলেন এগুলোর কড়া প্রতিবাদ করতে। তাদের মধ্য থেকে প্রতিবাদ আসলে বাংলাদেশে এটা ঠাঁই পাবে না। কিন্তু তাদেরকে আরো বিচ্ছিন্ন করলে, শত্রুগণ্য করলে, আরো বিভাজন তৈরি করলে, বাংলাদেশ একটা এক্সপ্লোসিভ এটম বোমায় পরিণত হবে, কারণ জঙ্গিবাদকে আমরা ষড়যন্ত্র আর যাই বলি তার রিক্রুট কিন্তু ওই সহজ-সরল ধার্মিক লোকটি যার মধ্যে ক্রোধ রয়েছে, ঘৃণা রয়েছে, কিছু করতে না পারার অসহায়ত্ব রয়েছে।
এই ক্রোধের উৎস প্যালেস্টাইনে, কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর ৬০ বছরের নিষ্পেষণ, গণহত্যা; ইরাক, আফগানিস্তান, কিংবা সিরিয়ায় মার্কিনিদের হাতে প্রাণ হারানো লক্ষ-লক্ষ মুসলিম পরিবারে আর্তনাদ। এর উৎস হচ্ছে অটোমানদের ক্ষমতা হারানোর পর থেকে যখন মুসলমানরা জেরুজালেম থেকে উৎখাত হলো, মধ্যপ্রাচ্য ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চরা ভাগ করে নিলো তখন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলমানরা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা হারায়নি। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তারা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা হারালো, ভারতবর্ষে তারো আগে তারা ব্রিটিশদের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা হারালো। ওসমানীয় সম্রাজ্যের শাসনের সাথে প্রকৃত ইসলামের সম্পর্ক কতটুকু সে যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করাই যায়। কিন্তু ক্রুসেডেও প্যালেস্টাইন/জেরুজালেম না হারানো মুসলমানরা অটোমানদের পতনের পর সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতাই হারালো। এগুলোই পাশ্চাত্যের প্রতি তাদের ক্রোধ, ঘৃণার মূল কারণ। এটি ক্ষমতারও লড়াই যেখানে মুসলিমরা এখন পরাজিত পক্ষ। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো পরবর্তীতে তথাকথিত স্বাধীনতা পেলেও তারা আর আল-কুদস ফিরে পায়নি, জেরুজালেমের দখল বুঝে পায়নি। প্যালেস্টাইনের লক্ষ-লক্ষ মুসলমানকে তাদের নিজ ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেনি। এসব বিষয়ই সকল মুসলমানের মনে পাশ্চাত্যের প্রতি (যাদের কাছে তারা ক্ষমতা হারিয়েছে) প্রচণ্ড ক্ষোভ, ঘৃণার উৎস।
তথাকথিত আল-কায়েদা বা আইসিস বা জঙ্গিদের রিক্রুটাররা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের এসব ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে লোকজনকে রিক্রুট করে। বাংলাদেশেও রিক্রুটাররা এটি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে এখানকার ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলিমরাও ভিক্টিম। কিন্তু তাদের ক্ষোভ, ঘৃণা প্রতিদিন বাড়ে যখন জেরুজালেমে প্যালেস্টাইনীদের রক্ত ঝরে, কাশ্মীরের মুসলমানদের রক্ত ঝরে, ইরাক-সিরিয়ায় সিআইএ-পেন্টাগণের যুদ্ধে তারা ভাইয়ের গুলিতে ভাই হারায়।
কিছু মানুষের ক্রোধ, ঘৃণা, অসহায়ত্বকে পুঁজি করে পর্দার অন্তরালের রিক্রুটারগণ ‘জিহাদী’ রিক্রুট করে। অনেক ’জিহাদী’ জানেও না তারা কার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে। যে আমেরিকার মহা-পরাক্রমশালী ডিপস্টেট, এনএসএ, পেন্টাগন, ও সিআইএ – ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ করেন, তারাও কোনো এক রহস্যজনক কারণে আইসিস বা আলকায়েদার সোশ্যাল-মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করেন না। বরং আইসিসের সার্ভারের নিরাপত্তা দেন ক্যালিফোর্নিয়ার টেক ফার্ম। মার্কিন সরকার আইসিসের অবৈধ তেল বিক্রির টাকা ঘরে আসাতেই খুঁশি। যদিও মার্কিন সরকার মাত্র ২৪ ঘণ্টায় উত্তর কোরিয়ার পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা ডাউন করে দিতে পারেন। তারা চাইলেই পারেন, কিন্তু করেন না। কোনো এক রহস্যজনক কারণে করেন না! তারা কেন আইসিস, আল-কায়েদার প্রচার-প্রোপাগাণ্ডা বন্ধ করেন না বা নির্বিঘ্নে চালাতে দেন – এর মাঝেই হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর নিহিত।
তথাপি, ষড়যন্ত্রকারীদের উপর দায় চাপিয়েই কেবল পার পাওয়া যাবে না। কেন ‘ধার্মিক’ লোকজন এত সহজে একটা মিথ্যা ধর্মযুদ্ধের আহ্বানে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন, খুব সহজেই রিক্রুট হচ্ছেন, বা নিরপরাদ মানুষ হত্যা করাকেও জায়েজ মনে করছে, তার উত্তর খুঁজতে হবে মুসলমানদেরকেই। অটোমান সম্রাজ্য-উত্তর তাদের ক্ষমতাহীন পৃথিবীতে তাদেরকে কেউ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবে না এবং তলোয়ার দিয়ে, পুরনো জিহাদী শ্লোগানেও ক্ষমতা ফিরে পাওয়া যাবে না। ক্ষমতা ফিরে পেতে হলে তাদেরকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বা ইরানের পথ ধরতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমরবিদ্যা সবকিছুতে স্বাবলম্বী হতে হবে এবং অন্যদেরকে ছাড়িয়ে যেতে হবে – তাহলেই তাদেরকে কেউ ক্ষমতাহীন করার বা ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার প্রশ্ন আসবে না। দিনশেষে লড়াইটা জ্ঞানের। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়লে কোনো জিহাদেই কাজ হবে না। এছাড়া কোনো ষড়যন্ত্রকারী তাদেরকে সহজে ষড়যন্ত্রের জালে বা ফাঁদে ফেলবেন আরা তারাও অবুঝ শিশুর মতো ফাঁদে পড়ে যাবেন এটিও মানার নয়।
সেজন্যই লড়াইটা হতে হবে দ্বিমূখী: ১) ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কেও সতর্ক থাকতে হবে, তাদের ফাঁদ বুঝতে হবে, ২) এই জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করতে হলে যে বা যারাই পর্দার অন্তরালে রিক্রুট করুক, যে উদ্দেশ্যেই করুক, যে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাস্তবায়নেই রিক্রুট করুক, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিম যেন তাদের রিক্রুট হতে না পারে, রিক্রুটারদের ফাঁদে না পড়ে, সেজন্য সার্বজনীন সচেতনতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের অপরিহার্য বাস্তবতা হচ্ছে এটি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এখানকার মুসলমানরা সারা-বিশ্বের মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতি থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করতে পারবে না, বিশেষ করে এই গোলকায়নের যুগে। সুতরাং সার্বজনীন, সর্বব্যাপী সচেতনতা ছাড়া জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তি মিলবে না। ইমাম-মোল্লা-মৌলবী কারোই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিংবা কাউকেই বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। ধর্মপ্রাণ মুসলিম দাবিদার সবাইকে যেমন সামনে এগিয়ে সম্মিলিতভাবে, সামাজিকভাবে এর প্রতিরোধ সূচনা করতে হবে, তেমনি সরকারকেও সবাইকে আস্থায় নিয়ে এর প্রতিরোধ করতে হবে। এর মাধ্যমেই এই ভয়াবহ বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। ধর্মকেও রক্ষা করা সম্ভব। কেবল যড়যন্ত্রকারীদের গালি দিলে কোনো ফয়সালা হবে না। আল্লাহ বাংলাদেশকে রক্ষা করুন…